
আবুল খায়ের টিটু ||
আসন্ন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে কুমিল্লার কাগজ আয়োজিত টক শো ‘ভোটের মাঠে কথার লড়াই’ এ কুমিল্লাকে নিয়ে আগ্রহী মেয়র প্রার্থীদের আকাক্সক্ষা এবং পরিকল্পনার চিত্র কিছুটা সামনে এসেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে সিটি কর্পোরেশন গঠন করা হলেও কুমিল্লা তার কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। পাশাপাশি এও প্রতীয়মান যে কুমিল্লা ব্যর্থ হয়েছে তার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বহন করতে। তাই হারানো দিনের জাবর কাটাই কি একমাত্র অবলম্বন? আর কী করে আবারো কুমিল্লা ‘পথিকৃৎ’ এর ভূমিকায় আবির্ভূত হবে? উন্নয়নে এই স্থবিরতার কারণে স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে কুমিল্লাকে নিয়ে কটাক্ষ করা এবং কুমিল্লার অগ্রগামিতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া কুমিল্লার সন্তানদের পীড়া দেয়। ‘রোম নগর (যেমন) একদিনে গড়ে ওঠেনি’, কুমিল্লা নগরও একদিনে গড়ে উঠবে, এমন প্রত্যাশা করা অবাস্তব। শহর থেকে নগর তকমা লাগায় যেভাবে রাতারাতি পরিবর্তন চোখে পড়েছে, তার বেশিরভাগই অপরিকল্পিত। তাই প্রয়োজন সুপরিকল্পিত উন্নয়ন। প্রাথমিক গুরুত্বের জায়গায় রয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। যেহেতু সকল কাজ একদিনে সম্ভব নয়, সেহেতু অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। এ অগ্রাধিকার নির্ধারণে পাঁচটি প্রস্তাবনাই এ লেখার অবতারণা।
১. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানিবদ্ধতা নিরসন: অসলো শান্তি চুক্তির নেপথ্য দর কষাকষির প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্র অসলো (২০২১)। বিশ^কে আড়ালে রেখে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দলের মধ্যে চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে দফায় দফায় তুমুল দর কষাকষি হয়। গাজা ও জেরিকো শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দল। ইসরায়েলি আইন কুশলী জানতে চায় যে প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি সরকার দাবি মোতাবেক গাজা ও জেরিকো শহরের নিয়ন্ত্রণ পেলে ঐ দুই শহরের বর্জ্য এবং কর সংগ্রহ করবে কি না? এ ধরনের ‘অহেতুক এবং অগুরুত্বপূর্ণ’ প্রশ্নকে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দল শরীরী ভাষায় নাকচ করে জানতে চায় ‘এ কেমন প্রশ্ন?’। ইসরায়েলি আইন বিশেষজ্ঞ মনে করিয়ে দেয় যে একটি সরকার এর প্রধান কাজ হচ্ছে ‘কর আদায় করা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা’। আমার কাছে এ সংলাপগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কুমিল্লা স্থানীয় সরকার কর আদায় করে নিয়মিতই। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কি সফলভাবে করে? বর্ষায় পানিবদ্ধতার কারণেই এ প্রশ্ন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সফলভাবে হলে পানিবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হলে দূষণ থেকে বাঁচা কঠিন। কুমিল্লা ইপিজেড এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শোধনাগার হয়ে বর্জ্য নির্গমনের কথা থাকলেও কুমিল্লা ইপিজেডে অজানা কারণে তা করা হয়না। এ ব্যাপারে কোন জবাবদিহিতাও নেই। ফলশ্রুতিতে নগরের দক্ষিণ অংশের জলাভূমির পানি দূষিত হয়ে জনজীবন প্রায় বিপন্ন। এ পানি ডাকাতিয়া নদীতে মিশে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করছে। জাতি সংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ১১ নং লক্ষ্যে নিরাপদ এবং টেকসই নগরের কথা বলা আছে। পরিবেশ এবং উত্তর প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য এবং নিরাপদ পৃথিবী রেখে যাওয়াই এসডিজি’র লক্ষ্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেখানে কুমিল্লা অসফল, সেখানে ‘টেকসই’ বর্জ্য ব্যবস্থানার বিষয়ে আলোচনা বাতুলতা মাত্র। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রিসাইকেল পদ্ধতি ব্যবহার করে কুমিল্লা এসডিজি পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে। সঠিক ও সুচারুরূপে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি নগরের প্রথম অগ্রাধিকার। কুমিল্লা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন?
২. নির্বিঘ্ন যাতায়াতে গণপরিবহন: জেলা শহর ফেনীতে ‘গ্রীন টাউন বাস সার্ভিস’ নামে একটি শহর পরিবহন আছে। ২০০৬ সাল থেকে এ সেবাটি চালু আছে। ফেনীর প্রধান প্রতিটি সড়কে রয়েছে সড়ক-বিভাজক। অথচ ভৌগোলিক আকার এবং জনসংখ্যা বিচারে তুলনামূলক বড় কুমিল্লায় এখনো কোন গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু নেই। কুমিল্লার যাতায়াত ব্যবস্থার করুণ দশাই এর জন্য প্রধানত দায়ী। নগরে পথচারী এবং যানবাহন এর কোনটিই নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে না। নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন জনবান্ধব এবং যানবান্ধব সড়ক ব্যবস্থা। যা কুমিল্লায় অনুপস্থিত। কুমিল্লায় এ গণপরিবহন না থাকাটা লজ্জার। তাই আমি চাই কুমিল্লার স্থানীয় সরকার সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং গণপরিবহন চালুকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করুক। এ অগ্রাধিকারের আওতায় রাস্তাগুলো প্রশস্ত হোক এবং গণপরিবহন চালু হোক। যে গণপরিবরহন নগরের এক প্রান্ত থেকে যুক্ত করবে আরেক প্রান্তকে। সহজ যাতায়াতের ব্যবস্থা নগরের কেন্দ্রের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
যানজট নিরসনে অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে থাকতে পারে টার্মিনালগুলোর অবকাঠামোগত সংস্কার। উদাহরণস্বরূপ জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনালের কথাই ধরা যাক। এই টার্মিনালে বাস প্রবেশ এবং বাহিরের ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নের অভাবে অনেক জায়গা থাকা সত্বেও যানজট লেগেই থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে টার্মিনালে আগত বাসগুলো প্রবেশের জন্য রাস্তার বামপাশ থেকে ডানপাশে যেতে অথবা সামনে গিয়ে পেছনে চালিয়ে টার্মিনালে প্রবেশ করতে যানজট লাগে। যদি বাম পাশ দিয়েই আন্ডারপাসের মাধ্যমে গাড়িগুলো টার্মিনালে যেতে পারতো তাহলে যানজট কমে যেতো বলে আমার মনে হয়। তবে এ বিষয়ে সড়ক প্রকৌশলীগণ নিশ্চই অধিকতর ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।
৩. পরিকল্পিত আবাসন: কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন প্রকাশিত ২০১৭-১৮ বাজেট পুস্তিকা অনুযায়ী নগরে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বাস। ভৌগোলিক অবস্থান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী স্থান হওয়ার কারণে কুমিল্লা বহু আগে থেকেই আবাস স্থাপনের জন্য আকর্ষণীয়। ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশন ঘোষণার পরপরই জমির দাম বেড়ে যায় এবং যত্রতত্র অপরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। সেই নেতিবাচক প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করতে কর্পোরেশন ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচনা আছে। দেরি হলেও এ বিষয়টিও অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা প্রয়োজন। উন্নত আবাসন ব্যবস্থা না থাকলে একটি নগর উন্নত হয়না। উন্নত আবাসন ব্যবস্থা করাও এক দিনের কাজ নয়। ধীরে ধীরেই হবে উন্নতি- এ ধারণায় যদি আমরা সহমত পোষণ করি তাহলে এখনই প্রয়োজন জনবান্ধব একটি আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ। যে আবাসন ব্যবস্থায় মানুষ স্বস্তির সাথে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। উন্নত আবাসন ব্যবস্থায় সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থার অধীনে ঘুমানোর জন্য যেমন চার দেয়াল বা বেড়া লাগবে, তেমনি ঘর থেকে বের হয়েই নিঃশ^াস ফেলার জন্য উন্মুক্ত স্থান থাকতে হবে। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় সবুজ পার্ক, খেলার মাঠ ও অন্যান্য সুবিধা ইত্যাদি থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বাড়ি বা ভবন থেকে বের হয়েই যাতে পর্যাপ্ত রাস্তা থাকে সে বিষয় নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়ি বা ভবনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কর্পোরেশন গৃহীত নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
৪. সদর দক্ষিণে আলোকপাত: বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টি প্রাক্তন কুমিল্লা পৌরসভার এবং ৯টি প্রাক্তন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ পৌরসভার। কুমিল্লা পৌরসভা দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা হলেও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ পৌরসভা গঠিত হয় ২০০৫ সালে। ভৌগোলিকভাবে ‘শহরতলী’ হিসেবে পরিচিত এই ৯টি ওয়ার্ডেও সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা হওয়ার পর অবকাঠামোগত পরিবর্তনে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে সদরের ১৮টি ওয়ার্ডের তুলনায় বেশিভাবে। কুমিল্লা শহরের মানুষেরা নিঃশ^াস ফেলার জন্য শহরহলীর এ ৯টি ওয়ার্ডে যেতো। সেখানে ছিল বাড়ি বাড়ি উঠান, পাড়ায় পাড়ায় খেলাধূলার পর্যাপ্ত জায়গা, ঝাপ দিয়ে গোসল দেয়ার জন্য অসংখ্য পুকুর এবং কুয়া। বড় উঠানের এক কোণে মঞ্চ বানিয়ে পরিবেশন করা হতো নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পরিবেশন হতো জারিগান ও লাঠি খেলা। এত সুন্দর প্রতিবেশ অথচ শহরের এত কাছে! দারুণ ছিল সে দিনগুলো। কিন্তু এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে আমরা হারিয়েছি উঠান, মাঠ এবং পুকুর। আমরা কেউই উন্নয়নের বিপক্ষে নই। কিন্তু এ অসুস্থ উন্নয়নতো জঞ্জাল বৈ কিছু নয়। সদরের তুলনায় সদর দক্ষিণ যেহেতু এখনো তুলনামূলক ফাঁকা, সেহেতু সেখানে বিশেষ আলোকপাত করা প্রয়োজন। পরিকল্পিত নগরায়ন সদরে কঠিন হলেও সদর দক্ষিণে তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। তাই সদর দক্ষিণের জন্য প্রয়োজনে আলাদা পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। পেতে পারে আপাত অগ্রাধিকার।
৫. গোমতী নদী ও সবুজায়ন: পৃথিবীর অধিকাংশ বিখ্যাত নগরগুলো কোননা কোন নদীর সাথে সম্পৃক্ত। নগর খ্যাতি অর্জন করে, নদীও। অর্থাৎ নগর ও নদীর নাম পরিপূরকভাবে ব্যবহার হয়। উদাহরণস্বরূপ লন্ডনের টেমস, রোমের টাইবার, প্যারিসের সেইন নদীর কথা উল্লেখ করা যায়। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ (আইকনিক) স্থাপনা এবং পর্যটন সুবিধা। মানুষ নগরকে মনে রাখে, নদীকেও। কুমিল্লার গোমতীও হতে পারে তেমনই পরিচয়বাহী নদী। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পূরণের পাশাপাশি গোমতীকে ঘিরে চাষ হতে পারে সবুজের। বাড়ানো যেতে পারে নাগরিক এবং পর্যটন সুবিধা। গড়ে উঠতে পারে আইকনিক কোন স্থাপনা। এ সুবিধা বাড়ানোটা যেন অতিমাত্রায় কৃত্রিম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সবুজকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃতিবান্ধব হতে হবে সে উন্নয়ন। গোমতীই হতে পারে নাগরিকদের নিঃশ^াস ফেলার উপযুক্ত স্থান। গোমতীই হতে পারে কুমিল্লাকে প্রতিনিধিত্ব করা সবুজ স্থান। তাই গোমতী হোক কুমিল্লার অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার।
পরিশেষ: কুমিল্লায় কোন উন্নয়ন হয়নি- একথা বলা যেমন অতিরঞ্জন, কুমিল্লা একটি উন্নত নগর বলাও অতিরঞ্জিত। আমার প্রস্তাবিত অগ্রাধিকারগুলো সিটি কর্পোরেশনের মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত আছে কি না আমার জানা নেই। যদি না থাকে, অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। দৃশ্যমান উন্নয়ন যেহেতু অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই নির্দেশ করে, সে কারণে আগামী মেয়র এবং কাউন্সিলরগণ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায় এ অগ্রাধিকারগুলো বিবেচনা করবেন। ইশতেহার বাস্তবায়নেও আগ্রহী হবেন- এ প্রত্যাশা আমরা করি।
গুণগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বিষয়েও অগ্রাধিকার নির্ধারণে আলোচনার প্রয়োজন। সেটা পরে একদিন।
[লেখাটি চূড়ান্তকরণে মতামত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কয়েকজন বন্ধু। তাঁদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ]
আবুল খায়ের টিটু: কুমিল্লা নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডের দিশাবন্দ গ্রামের অধিবাসী, এবং সহকারী অধ্যাপক (সুইডেনে শিক্ষা ছুটিরত), ফেনী ইউনিভার্সিটি। ইমেইল:
khayert2@gmail.com