
জুলফিকার নিউটন ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১১
আমার মার জীবনকে আমি এভাবেই বিবেচনা করি। তিনি ঐশ্বর্যেরপ্রতাপকে ছেড়েক্ষুদ্র সংসারের দুঃখকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই দুঃখ তাকে পীড়িত করেনি বরঞ্চ দীপ্তিময়ী করেছিল। শৈশবে এ সমস্ত আমি বুঝিনি। বড় হয়ে বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন হয়ে আমার মাতার কথা আমার মনে পড়েছে। মনীষী কবীর চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি, কখনো কোনো ব্যাপারে হতাশ হওনি? আমি উত্তরে বলেছিলাম, না আমি কখনো হতাশ হইনি, তার কারণ জীবন যাত্রায় উত্থান পতন তো থাকবেই। সেই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েই তো আমাদের যাত্রা। এই যাত্রা পথে যে সমস্ত বিঘ্ন উপস্থিত হয় সে বিদ্যাকে অতিক্রম করতে না পারলে আমি কি করে জীবনে সফলকাম হবো। প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন মনে রাখবে পৃথিবীতে কোনো কিছুই অনায়াসে পাওয়া যায় না, নিবিড়ভাবে অথবা সমগ্রভাবে পাওয়া যায় না যদিনা দুঃখের মধ্যে দিয়ে আমরা কঠিনভাবে না পাই। দুঃখের কারণেই জীবন দুর্লভ হয়েছে। গৌতম বৌদ্ধ মানব জন্মের কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলেন। তার সামনে প্রশ্ন ছিল কয়েকটি। জীর্ণতাই যদি সত্য হয়, দুঃখই যদি সত্য হয় এবং মৃত্যুই যদি অবধারিত হয় তাহলে মানুষ কেন জন্মগ্রহণ করলো? তিনি এ সমস্তকে অতিক্রম করার কথাই বলেছিলেন যার নাম তিনি দিয়েছিলেন নির্বাণ। আমার কাছে গৌতম বুদ্ধের দুঃখ অতিক্রম করার এই প্রক্রিয়াটি অপূর্ব মহিমামণ্ডিত বলে মনে হয়। বর্তমান কালের মানুষ তার কর্মের দায়ভাগের মধ্যে নিযুক্ত থেকে দুঃখের সর্ববিধ কল্লোল অতিক্রম করবে তাহলেই তো তার শান্তি এবং তাহলেই তোমৃত্যুর ঊর্ধ্বে তার প্রতিষ্ঠা।' তার কথাগুলো আমি আমার মতো করে বললাম।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রগবেষক ও অনুবাদক অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর কবি উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয় ছিল। তার গৃহ ছিল বিবিধ প্রকার প্রস্তর খণ্ডের সংগ্রহশালা। হীরক ছিল সেখানে, সমুদ্র তীরের নুড়ি পর্যন্ত তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। কত বিচিত্র তাদের রং এবং আকৃতি। অভিভূত হয়ে আমি তাঁর এই সংগ্রহ দেখেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাথরের প্রতি আপনার এ আগ্রহ হল কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন ‘সকল জীর্ণতাকে উপেক্ষা করে সকল আঘাতকে অতিক্রম করে যে শক্তির সংহতরূপে পাথরগুলো জেগে ওঠে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কিছু নেই। কত যুগের প্রতাপ সহ্য করে একটি কাষ্ঠখণ্ড হীরকে রূপান্তরিত হচ্ছে তা অবর্ণনীয়। সুতরাং পাথরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে যেমন ক্লেশকে অনুভব করা যায়, এবং অবশেষে জোতির্ময়কে অনুভব করা যায়। আমি তাই আজীবন এই পাথরই সংগ্রহ করেছি।' সাধারণভাবে আমাদের ক্ষুদ্র সংসারের মধ্যে আমার মা তার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড এবং শাসনের মধ্য দিয়ে তার ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তুলেছিলেন। আমি তাই তার কাছে চিরদিনের জন্য ঋতী এবং চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ। একটি অসহায় অবস্থা থেকে তিনি আমাকে দৃঢ়তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার অসাধারণ মহিমা আজও আমাকে সর্বমুহূর্তে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ শৈশবে মাতৃহারা হয়েছিলেন; কিন্তু শান্তিনিকেতনে একটি প্রার্থনা সভায় তিনি বলেছিলেন যে স্বপ্নে তিনি কখনো কখনো তার মাকে দেখেন এবং স্বপ্ন যখন ভেঙ্গে যায় তখন তিনি অনুভব করেন যে তার মা তার সঙ্গেই আছেন। অবিরাম জলধারা যেমন একটি প্রস্তরখণ্ডকে পরিচ্ছন্ন করে দেয় তেমনি তার জীবনধারাও তার মাতার অস্তিত্বের দ্বারা প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘প্রেম তো কিছু না দিয়ে বাঁচতে পারে না। মাতা জীবিত থাকুন বা নাই থাকুন তিনি আমাদের প্রেমে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন।
গ্রামের জীবনে রাতের বেলা মোমের বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফু দিয়ে বাতি যেই নিভিয়ে দিয়েছি তখনই পূর্ণিমার চন্দ্রের আলোক জানালা দিয়ে এসে আমাদের ঘরে পুরিপূর্ণ করে দিল। শৈশবেরসৃতিমাখা আলোয় উৎসাহিত হয়েছি, অভিভুত হয়েছি কিন্তু তাৎপর্য বুঝিনি। এখন মনে হয় আমরা ক্ষুদ্রের দ্বারা বৃহৎকে আড়াল করি! যখন মোমবাতিটি জ্বলছিল তখনতো চাদের আলো দেখা যায়নি কিন্তু। বাতি নিভে যেতেই চন্দ্রালোক সমস্ত কক্ষকে আপুত করে দিয়েছিল। এভাবেই মানুষ প্রতিদিন ক্ষুদ্রকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় আবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে হয়। তাই তো আমাদের জীবনে বঞ্চনা আছে অসহায়তা আছে এবং আছে বলেই মহত্বের মাধুর্য আছে, ত্যাগের বিভা আছে এবং অসার্থকতার মধ্যে সার্থকতার প্রদীপ আছে। এ কারণেই আমি স্থবিরতাকে স্বীকার করি না, স্রোতোবাহী নদীর মতন জীবনের গতিময়তাকে স্বীকার করি। এক একদিন বিকেলবেলা বাবা আমাকে এবং আমার ভাইবোনদের নিয়ে নদীর তীরে হাঁটতে যেতেন। নদীর তীর ছিল ফাঁকা। কিছু কিছু গাছ ছিল প্রধানতঃ বাবলা গাছ। বৎসরের কোনো কোনো সময় সে গাছগুলোর গা বেয়ে স্বর্ণলতা ছড়িয়ে থাকতো দেখতাম। নদীর তীরেই ছিল বাজার। বাজারের ছোট ছোট ঘর এবং সেখানে মানুষের চলাফেরা নদীর পাশ দিয়ে ভালোই লাগতো। নদীতে নৌকো বাঁধা থাকতো এবং বাজার সেরে লোকেরা নৌকো করে ওপারে চলে যেত। কোনো কোনো দিন আমাদের চলার সঙ্গে গ্রামেরও কিছু লোক এসে যোগ দিত। তারা চুপচাপ থাকতো। চতুর্দিকের শব্দগুলোর একটি আনন্দময় ধ্বনি নির্মাণ করে নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে যেত। বাবা পথ চলতে চলতে গিয়ে মাঝে তত্ত্বকথা বলতেন। সব যে বুঝতাম তা নয়। মনে হত। তিনি বলতে চান এই যে নদী এই যে মাটি এবং এই যে আশপাশের লোকালয় সবই বিধাতার সৃষ্টি। তিনি তার ইচ্ছা এবং আনন্দের জন্য সৃষ্টিকে বিচিত্র করেছেন। সকালবেলার দৃশ্য ছিল আরো সন্দর। সূর্যকিরণ যখন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তো তখন ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে জেগে উঠতো। আমাদের বাড়ির পাশের একটি পুকুরে লাল শাপলা ফুল ফুটতো সূর্যকিরণে সেই শাপলা ফুল দেখতে খুব ভালো লাগতো। প্রকৃতিদত্ত আবরণের বিচিত্রতায় পৃথিবী যে কত সুন্দর এবং কত মহিমাময় তা শৈশবে আমি যেভাবে বুঝেছি বড় হয়ে ঠিক সেভাবে অনুভব করিনি।
রবীন্দ্রনাথ তার একটি কবিতায় ‘ঝিকিমিকি আলোর খেলায় আমলকি বনের অধীরতার কথা লিখেছিলেন এবং আরো লিখেছিলেন যে নতুন পাতার কাঁচা সবুজ রং থেকে মানুষের রক্তে কিসের যেন খবর আসে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথের এ কথাগুলো পড়িনি কিন্তু আমার মনে হয় তিনি তার শৈশবের অবস্থাকেই এ কথাগুলোর মধ্য দিয়েই বর্ণনা করেছেন। শৈশবকালে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকি-যেমন আমলকি পাতার সঙ্গে, তেমনি নদীর স্রোতের সঙ্গে, তেমনি বাতাসের প্রবাহের সঙ্গে, তেমনি আকাশের মেঘমণ্ডলকে বিচিত্র রূপান্তরের সঙ্গে। এ অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না। আমরা শৈশবে যে জীবনধারা দেখেছি আমার চতুর্দিকে এখন সে জীবনধারা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বিভিন্ন মানুষকে দেখলাম বিভিন্ন রকমের বেশে এবং এসব মানুষের সামাজিক এবং ধর্মীয় আচরণের মধ্যেও ব্যবধান ছিল। কাউকে দেখেছি মন্দিরে যেতে, সন্ধায় যেখানে কাসার ঘন্টা বাজতো এবং প্রতিমার সামনে পূজারী পূজার উপাচার রাখতো, কাউকে দেখেছি মসজিদে যেতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে। ছোটবেলায় খৃষ্টান কিংবা বৌদ্ধ এদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। কিন্তু এই যে হিন্দু এবং মুসলমান সামাজিকভাবে এবং ধর্মীয়ভাবে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতো এগুলো আমার কাছে অসম্ভব এবং অদ্ভুত মনে হয়নি। কৌতুহল যে না হত তা নয়। তাই মাকে জিজ্ঞেস করতাম যে এই রকম এক একজন এক এক রকম পোশাক পরে কেন, অথবা একজন পূজা করে একজন মসিজদে যায় কেন? আমার এখনো মনে আছে মা সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলেছিলেন বাবা চারদিকের গাছপালার, দিকে তাকিয়ে দেখতো সব গাছ কি এক রকম? সব গাছ কি এক রকম ফুল ও ফুল দেয়? সব গাছ কি সবল গাছ? কোনো গাছ বিরাট আকৃতির চতুর্দিকে ডালপালা ছড়ানো। কোনো গাছ লম্বা হয়ে ওঠে, কতকগুলো পাতা ছড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন সুপারি নারকেল! আবার কোনো গাছকে গাছই বলা যায় না। সেগুলো লতা, কিন্তু সবগুলো আসলে গাছই, অর্থাৎ সবারই জন্ম আছে, বৃদ্ধি আছে, ফলমূল দেবার আছে এবং অবশেষে মৃত্যুও আছে। মানুষও সেরকম। কেউ ধুতি পরে, কেউ পাজামা পরে, কেউ লুঙ্গি। কেউ মাথায় টুপি দেয়, কারো মাথায় বাবরি চুল, কারো মাথা সম্পূর্ণ কামানো। এদের মধ্যে যারা হিন্দু তারা মন্দিরে যায় পূজো করে, আর যারা মুসলমান তারা মসজিদে যায়। কিন্তু সবাই মানুষ। সবারই জন্ম হয় সবাই বড় হয় বিয়ে করে সংসারী হয় অবশেষে মৃত্যু ঘটে। সুতরাং মানুষকে কখনো অন্য মানুষ ভাবতে নেই অথবা অন্য কোনো রকম জীবন ভাবতে নেই। সবাই আমরা মানুষ হিসেবে এক। কিন্তু গাছে গাছে যেমন পার্থক্য তেমনি সামাজিক এবং ধর্মীয় আচরণ পার্থক্য আছে। মা কথাগুলো আরো সহজ করে বলেছিলেন এবং কিছু উদাহরণ দিয়েও বলেছিলেন। আমি অবিকল যে সেরকম উপস্থিত করতে পারলাম তা ঠিক নয়। তবে আমার বিশ্বাস মতে যতদূর সম্ভব মার বক্তব্যটুকু এখানে ঠিকই পেশ করেছি। আমার শৈশবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ ছিল না। কোনো বিরোধ ছিল না। রথের মেলায় উপস্থিত হত হিন্দু মুসলমান সকলেই। তেমনি ঈদের মেলায়ও হিন্দু মুসলমান সকলেই উপস্থিত হত। গ্রামে প্রকৃতির যে ঔদার্য নদীর যে স্নিগ্ধতা এবং বাতাসের যে অনাবিল প্রফুল্লতা সবগুলোই যেন সেকালের মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। বাবা মাঝে মাঝে আমাদের বোঝাতেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)প্রথমে সূর্যকে আল্লাহ ভেবেছিলেন এবং সূর্য ডুবে গেলে চাঁদকে। কখনো মেঘপুঞ্জকে কখনো তরঙ্গ বিক্ষোভকে আবার কখনোবৃক্ষকে। কিন্তু আবিষ্কার করলেন সব কিছুরই পরিবর্তন আছে। তখন মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে এই পরিবর্তন এবং শৃঙ্খলা তৈরি করেছে কে? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই খুঁজে পেলেন। যিনি সকল কিছুরই সৃষ্টিকর্তা এবং সকল কিছুকেই পরিচালনা করেন এবং যিনি সকল কিছুরই ঊর্ধ্বে তিনিই আল্লাহ তিনিই পরম বিধাতা। সুতরাং তিনি তার পিতা আজরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, আজর মূর্তি নির্মাণ করতেন তত্বকালীন সমাজের প্রচলিত দেবতাদের। হযরত ইবরাহীম (আঃ) সে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) বললেন যে, যারা কথা বলতে পারে না যাদের একেবারে কোনো ক্ষমতা নেই এবং যারা মানুষের হাতে তৈরি তারা কি করে মানুষের প্রভু হবে? এভাবেই একেশ্বরবাদিতার জন্ম হয়। আমরা মুসলমান হিসাবে হযরত ইবরাহীমের (আ:) ধারায় অগ্রসর হয়ে রসূলে খোদা কর্তৃক পরিশুদ্ধ একটি ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী যেখানে মূর্তি পূজা নেই। হিন্দু মূর্তি পূজা করে, তারা তাদের মতো চলে। তাদের ব্যাপারে আমাদের মাথা গলানো ঠিক নয়, যেমন আমাদের ব্যাপারেও তারা মাথা গলাবে না। আমরা আমাদের বিশ্বাসে অটল থাকবো। আমার অল্প বয়সে বাবা কিংবা মা এসব কথা আমাকে বলতেন। আমি যে সব কথা বুঝতাম- তা নয়, কিন্তু এটা বুঝেছিলাম যে আমাদের সমাজের একটা নিজের ধর্ম পদ্ধতি আছে এবং আচরণ পদ্ধতি আছে, সে পদ্ধতিগুলো আমার অনুসরণ করা কর্তব্য। (চলবে...)