
প্রভাষ আমিন ||
বাংলাদেশ
এখন নির্বাচন কমিশনশূন্য। অনেক আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি
বিদায় নিয়েছে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন; যাদের শুরুটা
হয়েছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে, শেষটা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি
করপোরেশন নির্বাচনে। শুরু এবং শেষটা ভালো হলেও মাঝে তারা অনেক কলঙ্ক
কুড়িয়েছে তারা। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারণে তাদের বিরুদ্ধে
নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংসের অভিযোগ আনেন অনেকে। ভালোবাসা দিবসে বিদায় নিলেও
নুরুল হুদা কমিশন দেশের মানুষের ভালোবাসা পাননি।
নির্বাচন কমিশন গঠনে
প্রণীত আইন অনুযায়ী গঠিত অনুসন্ধান কমিটি এখন নতুন কমিশনের জন্য যোগ্য লোক
খুঁজছে। এরইমধ্যে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে
নাম চেয়েছে। চার দফায় বৈঠক করেছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বিভিন্ন
সূত্র থেকে পাওয়া ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশও করেছে অনুসন্ধান কমিটি।
এখন চলছে যাচাই-বাছাই। তাদের জন্য বরাদ্দ সময় অনুযায়ী আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি
অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম পাঠাবে। সেই তালিকা থেকে ৫
জনকে বেছে নেবেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মধ্য একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং
অনধিক চার জনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন
রাষ্ট্রপতি। আর নতুন কমিশনের কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। নানান কারণে
নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নতুন
কমিশনের।
কারা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন, তার যোগ্যতা আইনে নির্ধারণ
করা আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা
হিসেবে আইনে বলা হয়েছে, ‘তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স ন্যূনতম ৫০
বছর হতে হবে এবং কোনও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা
বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।’ অনুসন্ধান
কমিটি ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে আইনে বর্ণিত যোগ্যতা
অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মতো
যোগ্য লোকের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সংবিধানে আইনের আলোকে নির্বাচন কমিশন
গঠনের কথা থাকলেও এতদিন আইনই ছিল না। এই প্রথম আইনের আলোকে নির্বাচন কমিশন
গঠিত হতে যাচ্ছে। আগে আইন না থাকলেও যারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা
নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সবাই নতুন আইনের আওতায়ও
যোগ্য ছিলেন। এখন পর্যন্ত কোনও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন
কমিশনারের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। তার মানে অতীতের সব
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা এবং সততা নিয়ে
কোনও প্রশ্ন নেই। তারপরও তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পাননি।
বরং বেশিরভাগের নাম উচ্চারিত হয় ঘৃণার সঙ্গে।
নির্বাচন কমিশনারদের
যোগ্যতা যেমন আইনে নির্ধারিত; তেমনি তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতাও
নির্ধারিত। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব
পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন
হইবেন।’ সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব
পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’
গণপ্রতিনিধিত্ব
১৯৭২-এ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বিস্তৃতভাবে বলা আছে। নির্বাচনকালে
সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন
কমিশন নির্বাচনি আচরণবিধি মানতে যে কাউকে বাধ্য করতে পারেন। সংবিধান এবং
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তাতে চাইলে নির্বাচন কমিশন কারা
ক্ষমতায় আছে না আছে সেটা বিবেচনা ছাড়াই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বেশিরভাগ নির্বাচন কমিশনই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ
করেননি। তাদের যে এত ক্ষমতা আছে, সেটাই বোধহয় তারা ভুলে যান বা জানেন না।
এটা
ঠিক, বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচন কমিশনারদের দায়িত্ব পালন সারাক্ষণ
সুতার ওপর হাঁটার মতো। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি সাধারণ জনগণের নজর
থাকে। আর নির্বাচন যত ভালোই হোক, পরাজিত প্রার্থী বা দল কখনোই তা মেনে নেন
না। তাই কোনও নির্বাচন কমিশনেরই সবার প্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কে কী
বললো না বললো সেটা বিবেচনায় না নিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি সংবিধান ও আইনের
অধীনে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করেন; তাহলে অন্তত তারা নিজের বিবেকের কাছে
স্বচ্ছ থাকতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের কয়জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা
নির্বাচন কমিশনার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তারা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব
পালন করেছেন? কেন করেননি, কেন করতে পারেননি, কে তাকে দায়িত্ব পালনে বাধা
দিয়েছে; এমন কথাও তারা কখনও বলেন না। তার মানে তারা আসলে স্বেচ্ছায় নিজেদের
স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেন। কোনও আইন বা সংবিধানে এই রোগের কোনও ওষুধ নেই।
নির্বাচন
কমিশনের দায়িত্ব হলো নির্বাচন অনুষ্ঠান। কেমন নির্বাচন? সুষ্ঠু, অবাধ,
অংশগ্রহণমূলক। নির্বাচনের মাঠ হতে হবে সবার জন্য সমান। এখন প্রধান নির্বাচন
কমিশনার যদি বলেন, আমাদের দায়িত্ব হলো সময় মতো নির্বাচন আয়োজন করা। কোন দল
এলো, না এলো সেটা আমাদের দায়িত্ব নয়। ভোটারদের কেন্দ্রে আনার দায়িত্বও
নির্বাচন কমিশনের নয়। বা মানুষ তো কেন্দ্রে মারা যায়নি। তাহলে বুঝতে হবে,
তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নন।
কেউ যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার
বা নির্বাচন কমিশনার হওয়াকে চাকরির পাঁচ বছরের এক্সটেনশন মনে করেন, তাহলে
কিছু বলার নেই। অথচ এই পবিত্র দায়িত্ব হতে পারে একজন ব্যক্তির সবচেয়ে বড়
অর্জন। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আর কোনও লাভজনক পদে নিয়োগ পাওয়ার
সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনারেরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়া অন্য কোনও
লাভজনক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে তারা কেন সরকারের মন রাখতে গিয়ে
নিজেদের সারা জীবনের সব অর্জন বিসর্জন দেন?
অনুসন্ধান কমিটি ৩২২ জনের
নামের তালিকা প্রকাশের পর অন্তত দুজন নিজেদের নাম প্রত্যাহারের অনুরোধ
করেছেন বলে দেখলাম। আইনজীবী শাহদীন মালিক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে দেওয়া
চিঠিতে লিখেছেন, ইসির কোনও পদের জন্য তিনি বিবেচিত হতে চান না। আর সাবেক
সচিব হেদায়েতউল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি তার সারা জীবনের
অর্জন ধ্বংস করতে চান না। আবার সাবেক আমলাদের অনেকে নিজেদের নাম
অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তদবির করেছেন বলেও শুনেছি।
সুশীল সমাজের
প্রতিনিধিরা অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সৎ,
যোগ্য, দক্ষ, নিরপেক্ষ, সুবিধা না নেওয়া, স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের খুঁজে
বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। আগেই বলেছি, দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা
নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মতো যোগ্য লোকের অভাব নেই। আসল দরকার হলো
মেরুদণ্ডওয়ালা সাহসী লোকের। যিনি মন্ত্রী, প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের
ওপর বলে দিতে পারবেন, আপনি এটা করতে পারবেন না। তেমন সাহসী লোক থাকলে
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব নয়।
একটা গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এক
রাজার অসুখ হয়েছে। কোনও ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। এক কবিরাজ
বললেন, সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলেই রাজা ভালো হয়ে যাবেন। সবাই ভাবলো, এটা
কোনও ব্যাপার হলো। পাইক-পেয়াদা বেরুলো সুখী মানুষের খোঁজে। কিন্তু
হা-হতোস্মী। ‘সুখেরই পৃথিবী, সুখেরই অভিনয়, যত আড়ালে রাখো, আসলে কেউ সুখী
নয়...’ খুঁজতে খুঁজতে এক কুঁড়েঘরে এক লোক পাওয়া গেলো, যিনি সত্যিকারের
সুখী। সবাই বললো, ভাই তোমার একটা জামা দাও। রাজার জীবন বাঁচাতে হবে। কিন্তু
সুখী মানুষের নির্বিকার জবাব, আমার তো কোনও জামা নেই। সেই রাজার অসুখের
মতো আমাদের দেশে গণতন্ত্রও আজ অসুস্থ। গণতন্ত্রকে সুস্থ করতে দরকার পাঁচ জন
সাহসী মানুষ। অনুসন্ধান কমিটি সেই সাহসী মানুষদের খোঁজে নেমেছে। দেখা
যাক, তেমন সাহসী মানুষ তারা খুঁজে পান কিনা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ