
প্রভাষ আমিন ||
একসময়
অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে বা পাঠশালায় দিয়ে শিক্ষককে বলতেন, মাংস আপনার,
হাড্ডি আমার। এই গাধাকে পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে দেন। শিক্ষকরাও মনের সুখে
ছাত্রদের পেটাতেন। আমাদের ছেলেবেলায় অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না। তবে
শিক্ষকরা কারণে-অকারণে শিক্ষার্থীদের নানারকম শাস্তি দিতেন।
ছাত্রের
পিঠে বেত ভাঙা তো আছেই; বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা, ব্যাঙ হয়ে বসে থাকা,
কপালে চাড়া নিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা, কান টানা, চুল টানা,
পেটের চামড়া টেনে ধরা, ডাস্টার ছুঁড়ে মারা; অভিনব সব শাস্তি আবিষ্কার করতেন
আমাদের শিক্ষকেরা। কারণে তো শাস্তি দিতেনই, অকারণেও মারতেন।
তবে আমরা
চেষ্টা করতাম, সে মারের দাগ লুকিয়ে রাখতে। কারণ শিক্ষক নিশ্চয়ই কোনো
অপরাধের কারণেই মেরেছে। তাই বাড়িতে আরেক দফা মার খাওয়ার ঝুঁকি ছিল। তা মার
খেয়েও সেটা হজম করে নিতাম। এখনও প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুলের শিক্ষকদের
ভয় পাই। কদিন এক শিল্পপতির ছেলের সাথে পরিচয় হলো। সেই ছেলেও এখন বাবার
ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
পরিচয়ের পর্বে হাত মেলানোর
সময় নাম শুনে চমকে উঠলেন। বললেন, আমি তো শুধু চমকে উঠেছি। আপনার নাম শুনলে
আমার ছোট ভাই ভয়ে পালিয়ে যেতো। কারণ হিসেবে বললেন, তাদের এক গৃহশিক্ষক
ছিলেন, যার নাম প্রভাষ, ছেলেবেলায় তারা দুই ভাই মানুষ হয়েছেন সেই শিক্ষকের
কড়া শাসনে। শিল্পপতি পিতারও সমর্থন ছিল সেই শিক্ষকের প্রতি।
সেই দিন গত
হয়েছে অনেক আগেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর শারীরিক শাস্তি দেয়ার কোনো
সুযোগ নেই। মাদ্রাসায় এখনও কিছু নির্মমতা ঘটে বটে, তবে সাধারণ শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তির চল নেই। আমিও শিক্ষার্থীদের
শুধু শারীরিক নয়, মানসিক শাস্তিরও বিপক্ষে। পড়ালেখাটা যেন আনন্দের হয়, ভয়ের
নয়। আমাদের ছেলেবেলায় শিক্ষকরা আমাদের শাস্তি দিয়ে ভালো করেননি।
এখন যত
সহজে বলছি, তখন এটা বলার মত সাহস ছিল না। তবে ছেলেবেলায় এত শাস্তি দেয়ার
পরও শিক্ষকদের যেমন ভয় পেতাম, তেমন শ্রদ্ধাও করতাম, ভালোওবাসতাম। পঞ্চাশ
পেরিয়েও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যাই।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছি; তবুও শিক্ষকদের সামনে নতমুখেই
দাঁড়াতাম।
শাস্তির সুযোগ না থাকলেও শিক্ষকরা নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের শাসন
করবেন। শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,
মর্যাদার সম্পর্ক থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকলে
নষ্ট হবে শিক্ষার পরিবেশ। এত কথা মনে এলো সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও
বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে। আন্দোলনে
স্পষ্ট দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে- একদিকে শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে শিক্ষকরা।
এটা
তো হওয়ার কথা নয়। শিক্ষকরা যদি মমতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতেন,
তাদের মনের ক্ষোভ-বেদনার কথা শুনতেন, তা নিরসনের চেষ্ট্ াকরতেন ছোট্ট
আন্দোলন আজ এমন অনড় অবস্থানে যেতো না। এই লেখা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা টানা
চারদিন আমরণ অনশন করছেন, শীতে খোলা আকাশের নিচে না খেয়ে শুয়ে আছে; এরচেয়ে
বেদনাদায়ক দৃশ্য আর কী হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল
একজন প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে। সেই প্রভোস্ট সরেও গেছেন, কিন্তু
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামেনি। বরং প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি এখন
উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে গিয়ে ঠেকেছে। শুরুর দিকে যথাযথভাবে
শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনা করা হলে পরিস্থিতি আজ এই জায়গায় আসতো না। ১১
দিন ধরে অচল থাকতো না বিশ্ববিদ্যালয়টি। ছোট্ট আন্দোলন নানা উসকানি পেয়ে আজ
বিশাল আকার ধারণ করেছে।
ছোট্ট এই আন্দোলনকে বড় করার দায় আছে ছাত্রলীগের,
পুলিশের। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেই ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে, আর তৃতীয় দিনে
পুলিশের নির্মমতা আন্দোলনকে উত্তাল করে তুলেছে। অবরুদ্ধ উপাচার্যকে উদ্ধার
করার নামে গত ১৬ জানুয়ারি পুলিশ যেভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে,
লাঠিচার্জ করেছে, সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়েছে, শটগানের গুলি ছুড়েঁছে।
পরে
আবার পুলিশ শিক্ষার্থীদের নামে মামলাও করেছে। প্রভোস্টের পদত্যাগের
আন্দোলনকে যথাযথভাবে ম্যানেজ করতে না পেরে ছাত্রলীগ ও পুলিশকে হামলা করার
সুযোগ করে দেয়া অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। শিক্ষার্থীদের
আগলে রাখার দায়িত্বও শিক্ষকদেরই। পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা
চালাচ্ছে, তখন কোথায় ছিলেন শিক্ষকরা। তারা কেন পুলিশের সামনে ঢাল হয়ে
দাঁড়ালেন না।
তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আবেগ যতটা আছে, যুক্তি ততটা
দেখা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে ছাত্রলীগ এবং পুলিশের বিরুদ্ধে
আন্দোলন হতে পারতো। হঠাৎ উপাচার্য কেন টার্গেট হলেন, বোঝা যাচ্ছে না।
উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গিয়েই পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে, এটা
ঠিক। কিন্তু উপাচার্য নিশ্চয়ই পুলিশকে হামলার নির্দেশ দেননি। পুলিশী হামলা
ছাড়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ করেননি শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও
শাহজালালের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ আনতে পারেননি কেউই। তার
বিরুদ্ধে অসততার কোনো অভিযোগ নেই। বরং বলা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার
কঠোর অবস্থানই তার জন্য কাল হয়েছে। সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু উন্নয়ন
কাজ হওয়ার কথা। বর্তমান উপাচার্য বহাল থাকলে, সেই উন্নয়নকাজে অনিয়মের সুযোগ
নেই বলেই একটি মহল চাইছে তিনি সরে যান।
তবে আন্দোলনে থাকা
শিক্ষার্থীদের সাথে সেই স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা তাদের আবেগ থেকেই
আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের
নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি সরকারি দলের সমর্থক। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ
দেয়ার পর তিনি কঠোর হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু এসব তো তার
অযোগ্যতা হতে পারে না। ধরুন, এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের জয় হলো, উপাচার্য
পদত্যাগ করলেন; তাতে কী অর্জিত হবে? সরকারের পছন্দের একজন নতুন উপাচার্য
আসবেন। তাতে কী ঊনিশ-বিশ হবে?
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আবেগের সাথে আমি
একমত। অবশ্যই তাদের ওপর পুলিশী হামলার বিচার হতে হবে। কিন্তু তারা যেভাবে
অনড় অবস্থান নিয়েছে, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল বেগম
সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচারণের
অভিযোগ দিয়ে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষকদের ধাওয়া দেয়, অবরুদ্ধ করে
রাখে; সেটাও তো অসদাচরণই। তারা দাবি আদায়ে যতটা অনড়, আলোচনায় ততটা আগ্রহী
নয়। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানালেও তারা ঢাকায়
না এসে, শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেট যেতে বলেছেন।
২৩ শিক্ষার্থীকে আমরণ
অনশনে রেখে আলোচনা না করলে সমাধানটা হবে কোত্থেকে। তবে আবেগ হোক, যুক্তি
হোক; যে কোনো শর্তে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগেই
সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে আমি সবচেয়ে খুশি হবো। আমার ২৩ জন ভাই-বোন চারদিন
ধরে না খেয়ে আছেন; এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আলোচনা করে হোক, এমনকি
উপাচার্যের পদত্যাগে হলেও সমস্যার সমাধান হতে হবে। তবে আমি মনে করি না,
একজন ব্যক্তির পদত্যাগে সবকিছু বদলে যাবে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে
অনেক অনিয়ম আছে। উপাচার্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকের
বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত দুর্নীতির অভিযোগ আছে। আমাদের নজর দিতে
হবে সেদিকে। বদলাতে হবে পুরো ব্যবস্থা।
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।