
মামুন রশীদ ||
আমাদের জাতীয় জীবনে অসংখ্য অর্জন, যার স্বীকৃতি বিশ্বেও মিলছে। সেসব অর্জন আমাদের জন্য সম্মান বয়ে আনছে। আমাদের আত্মতুষ্টি লাভের সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার না চাইতেও আমরা এমন কিছু অর্জন করছি, বা আমাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের নামের পাশে যোগ হচ্ছে, যা আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে না। আমাদের অবহেলা, অসচেতনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্বহীনতাকেও স্পষ্ট করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচক (একিউআই) নিয়মিত প্রকাশ করে। সংস্থাটির ২৫ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের মান মাত্রায় ঢাকার পয়েন্ট ১৮১। পয়েন্টের ভিত্তিতে দূষণের তালিকায় আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। আর এদিন ১৯৪ মান মাত্রা নিয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম অবস্থানে ছিল চীনের বেইজিং।
বায়ুদূষণের মান মাত্রায় আমরা এবারই যে প্রথম শীর্ষ দশে স্থান পেলাম, তা কিন্তু নয়। এর আগেও আমরা শীর্ষ দশের তালিকায় ছিলাম। এমনকি এ তালিকায় প্রথম হওয়ারও অগৌরব আমাদের হয়েছে। আমাদের বায়ুদূষণের মাত্রা এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে যে, বৈশ্বিক এ তালিকায় আমরা প্রায়ই কখনো প্রথম স্থানে থাকছি আবার কখনো দ্বিতীয়। এবারে যখন আমরা দূষণের তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছি, তখন আমাদের রাজধানীতে বায়ুদূষণের মান ১৮১। এর সঙ্গে আরও একটি তথ্য যোগ করি, চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমরা দূষণের তালিকায় প্রথম হয়েছিলাম। সে সময়, ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী আমাদের রাজধানীতে বায়ুদূষণের মান ছিল ২৩৫। যে পয়েন্টকে চিহ্নিত করা হয় ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে।
বায়ুদূষণ পরিমাপের জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, সেই প্রযুক্তির সাহায্যে দেখা হয়, একটি নির্দিষ্ট স্থানের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর পরিমাণ। এই বস্তুকণার উপস্থিতির ওপর নির্ভর করেই পরিমাপ করা হয় বায়ুর মান। বায়ুদূষণ পরিমাপক সংস্থাটির হিসাবে, বায়ুর মান ০ থেকে ৫০ থাকলে ওই স্থানের বায়ু ভালো। আর মান ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’। আমাদের দুভার্গ্য বা সৌভাগ্য যাই বলি না কেন, চমকে ওঠার মতো খবর হলো- বায়ুমান নির্ধারণের এই হিসাব অনুযায়ী আমাদের রাজধানীতে বায়ুর মান সর্বোচ্চ ৩৩২ উঠেছিল। এবং তা চলতি বছরেই। আমাদের বায়ুদূষণের মাত্রা, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সহনীয় যে মাত্রা তার চেয়ে ছয়, সাড়ে ছয়গুণ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার এ উদাহরণ স্পষ্ট করে বায়ুর মান।
নির্মল বায়ু সেবন স্বাস্থ্যকর জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। অথচ আমরা বঞ্চিত হচ্ছি নির্মল বায়ু সেবন থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা এবং আমাদের রাজধানীর বায়ু যে খুবই অস্বাস্থ্যকর তা বুঝতে কোনো ইনডেক্সের প্রয়াজন নেই। খালি চোখেই এটি স্পষ্ট। ফলে আমাদের রোগশোকেরও কমতি নেই। বায়ুদূষণের প্রভাব নানাভাবে পড়ছে মানুষের জীবনে। সংবাদপত্রে নানা ধরনের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উদ্ধৃত করে রাজধানীতে বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় রাজধানীবাসীর আক্রান্ত হওয়ার খবর নিয়মিতই প্রকাশ পায়। আমাদের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর ২০২০ সালে তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত শিশু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছিল তাদের শতকরা ৪৯ শতাংশ শিশুই ছিল শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। বায়ুদূষণের ফলে যেসব রোগের বিস্তার, সে জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বায়ুদূষণ যে কতটা ভয়াবহ ঝুঁকি ও ক্ষতি মানবজীবনের জন্য, তা বোঝার জন্য আরও একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণ না থাকলে ঢাকাবাসীর আয়ু বাড়ত সাড়ে ৭ বছর। অর্থাৎ বায়ুদূষণ না থাকলে রাজধানীর একজন মানুষ প্রায় সাত বছর সাত মাস সময় বেশি বাঁচতেন। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, বায়ুদূষণের কারণে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। বায়ুদূষণের কারণে আমাদের আয়ু কমার এ ধারা কিন্তু বাড়ছেই। কারণ বায়ুদূষণের কারণে ১৯৯৮ সালে যেখানে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস। ২০১৯-এ এসে তা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে। আর ২০২১ সালে এসে প্রায় সাড়ে সাত বছরে । অর্থাৎ বায়ুদূষণ যেভাবে যে গতিতে বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে আমাদের গড় আয়ুও।
বায়ুদূষণ নিয়ে এই এত কথা, এখন প্রশ্ন আসতে পারে ঢাকাসহ সারাদেশে বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ছে কেন? বাড়ছে, কারণ বাতাসে বাড়ছে ধূলিকণার পরিমাণ। আর বাতাসে ধূলিকণা ছড়ানোর পেছনে প্রধানত দায়ী আমরা। এ ছাড়া আমরা যেখানে সেখানে থুথু ও কফ ফেলি। প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে জৈব জ্বালানি পোড়ানোর পরিমাণ বাড়ছে। এ ছাড়া যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা, শিল্পকারখানা। এসব ভাটা ও কারাখানার ধোঁয়া থেকেও বায়ুদূষণ হচ্ছে। সেই সঙ্গে নির্মাণসামগ্রী থেকেও তৈরি হচ্ছে ধুলা। এর সবই বাতাসের সঙ্গে মিশে বাড়িয়ে চলেছে বায়ুতে ক্ষুদ্রকণার পরিমাণ। আমাদের বাতাসে ধূলিকণা ও দূষণের পরিমাণ জানার জন্য আরও একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করি। ঢাকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন ঢাকা শহরে রাস্তার পাশে যেসব গাছপালা আছে তাদের পাতায় জমা হয় ৪৩৬ টন ধূলিকণা। গবেষণা প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিমাসে জমা হয় ১৩ হাজার টন ধুলা। এসব ধূলিকণা বাতাসে মিশে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছে বায়ুদূষণ, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
ঠিক কী কী কারণে বায়ু দূষিত হয়, তার সবই আমাদের জানা। বায়ুদূষণের ফলে আমাদের কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তাও আমাদের জানা। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য আমাদের করণীয়, সে সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে আমাদের। তার পরও আমাদের বায়ুদূষণের পরিমাণ কমছে না। এ না কমার কারণ, আমরা জানা কারণগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছি না। আর কোথাও কোথাও সমাধানের উদ্যোগ নিলেও তাতে ঠিক আন্তরিকতা কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা অসঙ্গতও হবে না।
তবে এ কথা সত্য আজকের এ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। বায়ুদূষণের এই মাত্রা একদিনে বাড়েনি। বায়ুতে ক্ষতিকর উপাদান একদিনে বেড়ে আজকের পরিস্থিতিতে আসেনি। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের অসেচতনতা, জানার পরও আমাদের প্রতিকারের পথে না হাঁটার কারণেই বায়ুদূষণ আজকের মাত্রায় পৌঁছেছে। যার কুফলও আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আমাদের যেহেতু জানা, তাই আমাদের সম্মিলিতভাবে বায়ুদূষণ ঠেকাতে উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আন্তরিক হতে হবে। অন্যথায় আমাদের অসচেতনতা, দায়িত্বহীনতা শুধু আজকেই নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও ডেকে আনবে বড় বিপদ। দূষিত নগরীর তকমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের জন্য তৈরি করেছে নেতিবাচক ধারণা। দূষণ কমানোর মাধ্যমে এ ধারণার উন্নতি যেমন বৈশ্বিক ধারণা পাল্টাতে সহায়তা করবে তেমনি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটাবে। সুস্থ সবল জাতিই উন্নয়নের সোপান।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক