
প্রভাষ আমিন ||
সারাজীবন
শুনে এসেছি, স্কুলে ছুটির ঘণ্টাই সবচেয়ে মধুর। এই প্রথম দেখলাম স্কুল
শুরুর ঘণ্টা মধুরতম। করোনা আসলে গোটা বিশ্বকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে।
আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণ সবই বদলে গেছে। আমাদের এখন ‘নিউ নরমাল’ জীবনাচরণে
অভ্যস্ত হতে হচ্ছে।
দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খোলা তাই দেশজুড়ে এক অভাবিত
উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা
কর্মকর্তা সবার মধ্যেই সাজ সাজ রব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেগেছে উৎসবের রঙ।
দেড়বছর পর শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেয়া হয়েছে উৎসবমুখরতায়। কোথাও ফুল, কোথাও
চকলেট, কোথাও বেলুন দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো হয়েছে।
টেলিভিশনে
দেখলাম, এক শিক্ষার্থী বলছেন, দেড়বছর পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, এই
খুশিতে রাতে তিনি ঘুমাতে পারেননি। এ আনন্দ আসলে বলে বোঝানো কঠিন।
স্কুল-কলেজ খুললেও পুরোটা খোলেনি এখনও। উত্তরার চার নম্বর সেক্টরে চাইল্ড
হ্যাভেন স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি হয়েছিল সাহিল। করোনার কারণে কখনো
ক্লাশরুম দেখা হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে শুনে সেও তৈরি স্কুলে যাবে।
কিন্তু প্লে গ্রুপের ক্লাশ এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু এটা তাকে বোঝানো যাচ্ছিল
না। টিভিতে দেখেছে, স্কুল খুলছে, তাই সে স্কুলে যাবেই। সাহিলের মা স্কুলের
অধ্যক্ষকে ফোন করেন, যাতে তিনি সাহিলতে বোঝান। কিন্তু অধ্যক্ষও বোঝাতে
পারেননি। কান্নায় মামলা জিতে যায় সাহিল। তৈরি হয়ে, নতুন বই নিয়ে, নতুন
ড্রেস পরে স্কুলে হাজির হয় সাহিল। কিন্তু তার ক্লাশে সেই ছিল একমাত্র
শিক্ষার্থী।
তার স্কুলের প্রথমদিনের স্মৃতিটি অনন্যই বলা যায়। সাহিলের
মত এমন অনেরক শিক্ষার্থী আছে, যারা স্কুলে ভর্তি হলেও স্কুলের দেখা পায়নি।
সাহিলের কথাই বা বলছি কেন, যারা কলেজে পড়ে, তাদের অনেককেও কলেজ জীবনের
আনন্দ ছাড়াই কলেজ পাড়ি দিতে হবে। আমার ছেলে প্রসূন কলেজ ওঠার পরপরই করোনার
আঘাত। এখন খুলেছে বটে, কিন্তু কয়েকদিন ক্লাস করেই তাদের বসতে হবে এইচএসসি
পরীক্ষায়। তাই কলেজের মজাটা তাদের বোঝাই হলো না।
গত সপ্তাহে এই কলামের
শেষে লিখেছিলাম, ‘আমার ইচ্ছা হলো, যেদিন খুলবে, সেদিন দূর থেকে হলেও কোনো
একটা স্কুলের ক্যাম্পাস দেখবো। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে খেলছে, চিৎকার করছে,
হইচই করছে; এর চেয়ে সুন্দর কোনো দৃশ্য নেই।’ আমার ইচ্ছাটা পুরণ হয়েছে।
রোববার সকালে অফিসে আসার সময় বাসার সামনের সেন্ট যোসেফ স্কুল একটু দেখে
এসেছি। আমার ছেলে প্রসূনও এই স্কুলের ছাত্র। এখন অবশ্য সে কলেজে। আসলে
এতদিনে কলেজও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। করোনায় তারা কলেজেই আটকে আছে।
প্রসূনের
স্কুলের বেশিরভাগ সময় আমি তাকে দিয়ে আসতাম। প্রসূন স্কুলে ঢুকে যাওয়ার পরও
আমি অনেকক্ষণ গেটে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত
ক্যাম্পাস। সকালে শিক্ষার্থীদের এই কলকাকলী আমাকে সারাদিনের কাজের জ্বালানি
জোগাতো। আবারও বলছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের কলকাকলী, দুষ্টুমি, হইচই,
অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার দৃশ্য আসলেই স্বর্গীয়।
অপেক্ষাটা
শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষকদেরও। গমগমে ক্লাসরুমের যে অনুভূতি, তা কি আর
অনলাইনের ক্লাসে মেলে? প্রথম দিনে স্কুলে বা কলেজে খুব যে পড়াশোনা হয়েছে,
তা নয়। দেখা-সাক্ষাৎ, খুনসুটি, ওরিয়েন্টেশন, স্বাস্থ্যবিধিতেই কেটেছে
প্রথমদিন। প্রথম দিনে সবার নজর ছিল স্বাস্থ্যবিধির দিকে। স্বাস্থ্যবিধির
বিবেচনায় শিক্ষা প্রশাসনকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা মাস্ক
পরে সারিবদ্ধভাবে স্কুলে ঢুকেছে, গেটে তাদের তাপমাত্রা মাপা হয়েছে, ক্লাসেও
বসার ব্যবস্থা ছিল দূরে দূরে।
সব মিলিয়ে চমৎকার ব্যবস্থাপনা। তবে এতসব
উৎসবমুখরতার পাশেও শুয়ে আছে শঙ্কা। প্রথম তিনটি স্ট্যান্ডার্ড ধরলে অবশ্যই
শিক্ষা প্রশাসন জিপিএ-৫ পাবে। কিন্তু সাফল্য অর্জনের চেয়ে ধরে রাখা কঠিন।
প্রথম দিনে সবার নজর ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। মিডিয়া ছুটে বেড়িয়েছে এক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরাও মাঠে ছিলেন। সব মিলিয়ে আজকে সবাই তটস্থ ছিলেন।
তবে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধির প্রধম দিনের স্ট্যান্ডার্ডটা ধরে রাখতে
হবে। এখানে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এর আগে শপিং মল, গণপরিবহন,
পশুরহাটেও স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আর বজায় রাখা
যায়নি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধিতে শৈথিল্যের কোন সুযোগ
নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর করোনা সংক্রমণের
হার বেড়ে গিয়েছিল। এ বিষয়টি যেন আমাদের মাথায় থাকে।
এত সতর্কতার মধ্যেও
আজিমপুর গার্লস স্কুলে ক্লাসরুম নোংরা ছিল। শিক্ষামন্ত্রী সেখানে যাবেন
জেনেও পরিচ্ছন্নতার যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। আজিমপুর গার্লস স্কুলের
অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই শাস্তি যেন বাকি সবাইকে সতর্ক করে
দেয়। একটু ঢিলেমিই কিন্তু সকল উৎসবে জল ঢেলে দিতে পারে।
তবে
স্বাস্থ্যবিধি মানার কাজ শুধু শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা শিক্ষা প্রশাসনের নয়।
অভিভাবকদেরও বড় দায়িত্ব আছে। রোববার সকালে সেন্ট যোসেফ স্কুলের সামনে
অপেক্ষায় থাকা অভিভাবকদের অনেকের মুখে মাস্ক ছিল না। অনেক স্কুলের সামনেই
অভিভাবকদের ভিড় স্বাস্থ্যবিধির সমান্তরাল ছিল না। অভিভাবকদের মনে রাখতে
হবে, আপনার একটু খামখেয়ালি কিন্তু আপনার সন্তানকে ঝুকির মুখে ফেলতে পারে।
করোনায়
মৃত্যুর সংখ্যা এখন কমতির দিকে, সংক্রমণের হারও ৭এর ঘরে। এ কারণেই সরকার
খুব স্বস্তির সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে পেরেছে। করোনার এই নিম্ন গতিটা
আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমরা যদি ভাবি করোনা চলে গেছে, কোনো নিয়ম মানতে হবে
না, তাহলে তা আবার ভয়ঙ্করভাবে ফিরতে পারে। প্রথম দিনের উৎসবমুখরতার
পাশাপাশি এখন আমাদের নজর দিতে হবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার
ব্যাপারে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে দেড়বছরের ঘাটতি দেড়মাসে পোষানো যাবে
না। শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি ক্লাস বা পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেয়া না হয়।
আস্তে আস্তে সয়ে সয়ে তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
আরেকটা
খুব জরুরি কাজ, কারা কারা স্কুলে এলো না, কেন এলো না তা খুঁজে বের করা।
প্রথমদিনের অনুপস্থিতির তালিকা ধরে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষা প্রশাসন মাঠে
নামতে পারে। কেন স্কুলে এলো না, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। করোনায় অনেক
অভিভাবকের আয় কমে গেছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্যই হয়তো তার নেই।
আয় বাড়াতে সন্তানকে হয়তো কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। নারী শিক্ষার্থীদের অনেকের
হয়তো বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় স্কুল
কর্তপক্ষ সেই অনুপস্থিতির শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে
পারেন। কী করলে সেই শিশুটি আবার স্কুলে যেতে পারবে, তার একটা উপায় বের করতে
পারেন। সবাইকে ক্লাশরুমে ফিরিয়ে আনাটা খুব জরুরি। আমরা চাই সবাই সমান
সুযোগ পাবে, সমানভাবে এগিয়ে যাবে।
রোববার সারাদেশে যে উৎসবমুখর পরিবেশ
সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন বজায় থাকে। আমাদের যেন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের
মত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে না হয়। শিক্ষার্থীদের কলকাকলীর পবিত্র স্বর্গীয়
দৃশ্যটা যেন আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ