ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আমার শহর ‘কুমিল্লা’
Published : Tuesday, 24 August, 2021 at 12:00 AM, Update: 24.08.2021 2:17:24 AM
আমার শহর ‘কুমিল্লা’শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।
পর্ব-০৮
আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় যারা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অভিবাসী হয়েছেন, তারা কুমিল্লাকে বা কুমিল্লাবাসীকে কতটুকু ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন, এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শহর কুমিল্লায় তিন ধরনের অধিবাসী বাস করেন।
১.    আদি কুমিল্লা শহরবাসী।
২.    কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত কুমিল্লা শহরবাসী।
৩.    যারা কুমিল্লা জেলায় বাহির থেকে এসেছেন, তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার অধিবাসী, এখন তারা কুমিল্লা শহরবাসী হয়ে গেছেন। দেশ ভাগের পর ভারতীয় মুসলমানও এসেছেন, বিশেষত ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। তবে তাদেরকে ভিনদেশি মনে হয়নি কখনো।
কুমিল্লার আদি নিবাসীরা অধিকাংশই শহরতলিতে বাস করেন। তাদের পৈত্রিক ভিটা এবং জায়গাজমি এখন বাইরের লোক ক্রয়সূত্রে মালিক হয়ে প্রতিবেশী হয়ে গেছেন। আদি নিবাসীদের জীবনযাপনে ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যে ততটা উন্নতি লাভ ঘটেনি। অন্যদিকে পৈত্রিক ভিটার মালিক বংশানুক্রমে বিভাজনের ফলে এলাকাগুলো হয়ে গেছে জনবসতিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর। পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা তারা পাচ্ছে না। এ মূল্যায়ন সার্বিকভাবে বিবেচ্য নয়, তবে সংখ্যা বিবেচনায় ঐ শ্রেণি-পেশার লোকই বেশি।
কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে যারা শহর কুমিল্লায় এসেছেন, তার বিবিধ কারণ। কেউ ব্যবসা করতে, কেউ নিজ শহরে একটি আবাসন বা ঠিকানা স্থাপন করতে, কেউ ছেলেমেয়েদের উন্নত লেখাপড়া করাতে শহর কুমিল্লায় এসেছেন।
    এছাড়া কুমিল্লা জেলার বাহির থেকে যারা এসেছেন, তারা অধিকাংশই চাকরিজীবী। কোনো না কোনো চাকরিসূত্রে কুমিল্লায় এসেছেন, দীর্ঘদিন থেকেছেন, শহরটি ভালো লেগে যায়। এখানকার পরিবেশ, যাতায়াত সুবিধা, খাওয়া-দাওয়া, জিনিসপত্রের প্রতুলতা ও স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া, বিশেষত মাছ-তরিতরকারির সজীবতা, শহরে চলতে অল্পটাকায় বা পয়সায় রিক্সায় যাতায়াত ইত্যাদি নানা কারণেই বাহির থেকে এসে ব্যবসা বা অন্যকিছু সূত্রে শহরবাসী হয়ে গেছেন। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে দেখা গেছে, বাইরের লোকেরা আন্তরিকভাবে কুমিল্লাবাসীকে আপন করে নিতে পারেননি। কোথায় যেন একটি ফাঁক থেকে গেছে। কুমিল্লা শহরবাসী ঐ সকল অভিবাসীরা নাড়ির টানে নিজস্ব জেলা বা উপজেলা নামে সমিতি করে নিজেদের স্বাতন্ত্রিক অবস্থানকে বিঘোষণা দেন।
    বাহির থেকে আগত ঐসব অভিবাসীরা শহর কুমিল্লায় সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা দিতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন এবং পরোক্ষে একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি করে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। এখন শহর কুমিল্লা বা জেলা কুমিল্লাবাসীদের প্রতি তাদের ধারণা মিশ্র। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, কীভাবে ভূমিপুত্রদের পেছনে ফেলা যায় তার কৌশলও খুঁজে। ধরা যাউক জেলা প্রশাসক এসেছেন একজন সিলেটবাসী, শহর কুমিল্লায় বসবাসকারী সিলেট অধিবাসীরা এ ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা প্রাপ্তির জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টি করতে তৎপর হন। এরূপ বিভিন্ন বিভাগে অন্যজেলা থেকে কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আসেন, তাদের তখন স্থানিক আপনজনের সাক্ষাৎ মিলে। এমন কি শহর কুমিল্লায় অনেক সমিতি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, পরিষদ আছে, এগুলোর কর্মকর্তা মনোনয়নে শহর কুমিল্লাবাসীকে তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এক্ষেত্রে ভূমিপুত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে যে আন্তরিকতা ও সেবা মানসিকতা নিয়ে নিজেদেরকে নিবেদিত করবে, অন্যদের দায়িত্ব ততটা এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এসব কথায় যেমন আঞ্চলিকতা মানসিকতাটি তুলে ধরা হলো, অন্যদিকে বাস্তবতাকেও তো অস্বীকার করার জো নেই।
কুমিল্লা শহরের ভূমিপুত্র যারা, তারা জানে না, তারা কত সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যের শহরে পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছে, তারা জন্মভূমি হিসেবে মুগ্ধতায় আপ্লুত। যারা কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কুমিল্লা শহরে এসেছে, তাদের কাছে কুমিল্লা শহর ‘ভালোবাসার শহর’। তাদের মুগ্ধতায় হলো আকাশচুম্বী ও অহংকার-গৌরবের। আর যারা বাহির থেকে এসে কুমিল্লা শহরবাসী হয়েছেন তাদের কাছে কুমিল্লা শহর হলো ‘ভালোলাগার বাসযোগ্য শহর’। তাদের মুগ্ধতায় অনেকটা মিশ্র।
প্রতিযোগিতা সর্বক্ষেত্রেই আছে, তবে তার ধারায় নান্দনিকতা থাকা চাই। আমি ভিক্টোরিয়া কলেজে চাকরিকালীন একজন অন্যজেলার অধ্যক্ষ আসলেন। আমরা তাঁকে বরণ করে নিলাম। তিনি আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত ফায়দা আদায়ের পথ সুগম করতে শুরু করলেন। দেখা গেল-শিক্ষকরা চারভাগে বিভক্ত-হিন্দু-মুসলমান ভাগ, স্থানীয় ও বাহিরের শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষের ভাগ, কতিপয় দালাল শিক্ষক নিজের আওতায় রেখে সুবিধা আদায়ের জন্য এক ভাগ। প্রতিটি ভাগের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল বহুমাত্রিক। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে বিশেষত ভিক্টোরিয়া কলেজে যে একটা ঐক্যের ঐতিহ্য ছিল, তা ভেঙে যায়। ঐ অধ্যক্ষ অনেক আগেই চলে গেছেন, প্রয়াত হয়েছেন, রেশটুকু রয়ে গেছে। এটা না করলেই পারতেন। কারণ, অধ্যক্ষ একটি পদ নয়, প্রতিষ্ঠান। তার অবস্থান সার্বজনীন, দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই নিরপেক্ষতায় সমুজ্জ্বল। ফলে লক্ষ্য করেছি- এ কলেজ থেকে শিক্ষক ছাড়া যাঁরা অধ্যক্ষ ছিলেন এবং অবসর জীবনযাপন করছেন এ শহরেই, তাঁরা হারিয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ স্মরণ করে না, উদাহরণ হিসেবে তাঁদের নাম কেউ উচ্চারণও করে না। কেন? তার উত্তর জানা থাকলেও বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কেউ তাদের পরিচয় জানতে চাইলে বলে অধ্যক্ষ বা প্রফেসর অমুক। যেন অধ্যক্ষ/প্রফেসর বিশেষণটি পিতৃদত্ত।
    আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় অনেক শিক্ষকের বাস। তাঁরা বাড়িঘর করেই বসবাস করছেন। অনেক শিক্ষক শহরের বাইরে কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, থাকেন শহর কুমিল্লায়। একবার হিসাব করে দেখেছি- বেসরকারি বা সরকারি কলেজের শিক্ষক ছাড়াও শহর কুমিল্লায় সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ৩৮জন বাস করেন। আমি শিক্ষক ছিলাম, তাঁদের চিনি, নাম জানি বলেই এ পরিসংখ্যানটা দিতে পারলাম। কিন্তু শহরবাসী কি তাঁদের চিনেন, না জানেন? তাঁরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর করে বাস করছেন, সেখানে তাঁদের সাম্মানিক স্থানটি কি প্রতিবেশীরা তেমনভাবে মূল্যায়ন করেন? এই অবক্ষয়টা কিন্তু সামাজিক নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। তাঁরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে নিজের চাকরিকালীন অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেননি। সাধারণ নাগরিকের মতো মিছিলে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে সাধারণ হয়ে গিয়েছেন। নিজে তো পচলেন, পদটিকেও কলংকিত করলেন। আজ দেখা যায় ক্ষমতা বা পেশি শক্তির দাপটের কাছে এ পবিত্র আসনটিও বহু রঙে রঞ্জিত হয়ে গেছে। হাজার হাজার ছাত্র/ছাত্রীর অভিভাবক যখন কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে মাথা নত করে, তখন শিক্ষকের মর্যাদা রইল কই? এজন্য অযোগ্য প্রতিষ্ঠান-প্রধানরাই দায়ী। আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় আমার দেখা- কুমিল্লা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম জনাব হাফিজ উদ্দিন, ইউসুফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম জনাব মোঃ ইসহাক ও মরহুম জনাব হাসেদুল হক, ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মরহুম জনাব কুলসুম নূর, ঈশ্বর-পাঠশালার প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় সুকুমার কর, শৈলরানী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় সুচন্দ্রিমা রায় এবং ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মরহুম শফিকুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বর্গীয় মনীন্দ্রমোহন দেব, মরহুম এম,বি,চৌধুরী, ড. সিরাজুল ইসলাম, মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মরহুম আবদার রশীদ প্রমুখকে দেখেছি। তাঁদের সম্মুখে সকল শ্রেণি-পেশার লোক মাথা নত করে থাকতেন, সম্মান জানাতেন। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও আসনের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল খুবই উঁচুতে। তার কারণও আছে। আগে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতেন সরকারের শিক্ষা বিভাগ বা মন্ত্রণালয়, এখনও তাই। পার্থক্যটা হলো বর্তমানে শিক্ষা বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে অধ্যক্ষ বানিয়ে, তৈরি করে এবং ধাক্কাধাক্কি করে প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে আসতে হয়। তাই পথে পথে যানবাহন যে দাদন দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছে, এখন এরূপ নির্ধারিত পদগুলোতে আরোহণ করতে হয়।
    আমি ষাটের দশকে যে শহর কুমিল্লায় এসেছিলাম, এসে যা দেখেছিলাম, দেখে মুগ্ধ ও ঋদ্ধ বা সমৃদ্ধ হয়েছিলাম-তা অনেকটা হারিয়ে গেছে। জানতে ইচ্ছে করে, আগের মতো ছাত্ররা কি শিক্ষকদের সালাম-নমস্কার দেয়? কারণ, নিজ কানে শুনেছি, ছাত্র অধ্যক্ষের অফিসে তাঁর সামনে চেয়ারে বসে থাকে, অন্য শিক্ষক কক্ষে প্রবেশ করলেও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় না। ভাবতে কষ্ট হয়।
ক্রমশ

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫