ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ফিল্ড হাসপাতালের চেয়ে আইসোলেশন কেন্দ্র জরুরি
Published : Friday, 6 August, 2021 at 12:00 AM
ফিল্ড হাসপাতালের চেয়ে আইসোলেশন কেন্দ্র জরুরিডা. মুশতাক হোসেন ||

এ পর্যায়ে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক। সংক্রমণ ও মৃত্যুহারে এক দিনের রেকর্ড পরদিনই ভেঙে যাচ্ছে। ঈদুল আজহার পর থেকে ১৪ দিনের লকডাউন শেষ হতে চললেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুফল দেখছি না। প্রতিটি সূর্যোদয়ে আশা করছি, আজ হয়তো মৃত্যু ও শনাক্তের হার কমবে; কিন্তু তা হচ্ছে না। ঈদের বন্ধের কারণে গত মাসের শেষ সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা তুলনামূলক কম হওয়ায় শনাক্তের হার কম ছিল। কিন্তু ঈদের ছুটি-উত্তর নমুনা পরীক্ষার হার বাড়তে শুরু করায় শনাক্তের চিত্রও ঊর্ধ্বমুখী। সমান্তরালে বাড়ছে মৃত্যুহারও।

এই দফায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিপদাশঙ্কা এখানেই আরও বেশি। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণেই জানছি, মফস্বলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অনেকেরই রয়েছে অনীহা। কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও রোগীরা যাচ্ছেন বেশি অসুস্থ হওয়ার পর। অনেকেই প্রথমে মৌসুমি রোগ ভেবে তা গুরুত্ব দেননি। ফলে খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক এলাকায় করোনা যে একটা মরণব্যাধি- তা আমলেই নেওয়া হচ্ছে না! আমরা জানি, করোনা মরণব্যাধি হলেও সচেতনতা-সতর্কতায় এর প্রতিরোধ দুরূহ নয়। স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ অনুসরণই এর প্রধান রক্ষাকবচ। কিন্তু উদ্বেগ ও বিস্ময়ের হলো, অনেকে এ পথ অনুসরণ তো করছেনই না; উপরন্তু কেউ কেউ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। বিগত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী যে মর্মন্তুদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, এর পরও আমাদের দেশে অনেকের সচেতনতা-সতর্কতায় ঘাটতি দুর্ভাগ্যজনক।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রথমেই এখন জরুরি হলো, যত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন তাদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। সংক্রমিত অনেকেই অবস্থা গুরুতর হলে তবেই যাচ্ছেন হাসপাতালে। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সূত্রমতে, রোগীর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই তেমন কিছু করার থাকছে না। আগেই যদি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সবাইকে ফলোআপ করা হয়, তাহলে ইতিবাচক ফল আশা করা যায়। এই ফলোআপ যারা বাসাবাড়িতে থেকে করতে সক্ষম অর্থাৎ যাদের পৃথক ব্যবস্থাপনা আছে নিয়মকানুন অনুসরণের, তাদের টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব।

ফিল্ড হাসপাতাল নয়, প্রয়োজন অস্থায়ী আইসোলেশন কেন্দ্র। যারা নিজ ঘরে থেকে তা পারছেন না অথচ এই কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবী বা কর্মীদের মাধ্যমে তা প্রয়োজনের নিরিখে নিশ্চিত করা সম্ভব। এই ব্যবস্থাটা এমন হতে হবে যাতে রোগীর নিবিড় তদারকির বিষয়টি যথাযথভাবে সুনিশ্চিত করা যায়। এ কাজে থাকবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা, যারা দিনে অন্তত দু'বার রোগীদের পরিদর্শন করবেন। বাকি কাজটা করবেন চিকিৎসাসংশ্নিষ্ট প্রশিক্ষিত অন্য কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে আমরা শিক্ষানবিশ চিকিৎসকসহ সেবিকা কিংবা বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসা-শিক্ষার্থীদের কাজে লাগাতে পারি। দেশে এ রকম অনেক শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া কঠিন নয়।

আমি বিশ্বাস করি, দুর্যোগকালীন এ পরিস্থিতিতে সংশ্নিষ্ট সবাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন এবং এই সহযোগিতার রাস্তাটা সরকারে দায়িত্বশীলদেরই সৃষ্টি করে দিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা পালস অক্সিমিটারে অক্সিজেন মাপাসহ প্রাথমিক কাজগুলো সহজে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেনও ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের এ ক্ষেত্রে যুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বাসাবাড়িতে অক্সিজেন দেওয়ার নিয়ম অনেকেই জানেন না। তাতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অস্থায়ী আইসোলেশন কেন্দ্রে তা অনেকটা সহজ। প্রশিক্ষিত কর্মীদের উপস্থিতি থাকবে সার্বক্ষণিক। এসব ব্যাপারে যেসব ঘাটতি এখনও রয়েছে, তা দূর করতে হবে। এ ব্যবস্থা আশু নিশ্চিত করা জরুরি এ কারণে, যাতে ঝুঁকির মাত্রা হ্রাস করা যায়। যখন রোগীর কল্যাণে আর কিছুই করার থাকে না, তখন রোগীকে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়েই বা লাভ কী! অর্থাৎ করোনার ক্ষেত্রে পদে পদে সতর্কতা-সচেতনতা প্রয়োজন সবারই। শনাক্তদের আইসোলেশন ব্যবস্থা যদি যথাযথভাবে করা না যায় তাহলে ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে। একই সঙ্গে জরুরি সবারই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ। সেই সঙ্গে যে বা যারা বিভ্রান্তি ছড়ায় বা ছড়াচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

এর পরের অগ্রাধিকার হলো গণহারে টিকাদান। গণহারে টিকাদানের ব্যাপারে ইতোমধ্যে সরকার রোডম্যাপ দিয়েছে। এটুকুই যথেষ্ট নয়। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ জন্য সুচারু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। টিকার ব্যাপারে আমাদের সংকটের মেঘ এখনও কাটেনি। তবে এটুকু বলা যায়, আমরা টিকার ব্যাপারে যে খরার মধ্যে ছিলাম, তা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ বাকি। টিকাদানসহ করোনা প্রতিরোধে সব রকম ব্যবস্থার পুরোপুরি বাস্তবায়ন জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কঠিন। সংঘবদ্ধ সামাজিক শক্তির সমর্থন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত অপরিহার্য। প্রশাসনিক হুকুম, সেনাবাহিনী, পুলিশ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, নিবিড়ভাবে তাদের সম্পৃক্ত করে এই জরুরি কাজগুলো করতে হবে। শুধু চিকিৎসক কিংবা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ কিংবা যুক্ত করেও তা সম্ভব নয়।

আমরা গণটিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগেই বলেছি, এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যারা বলছেন, আমরা টিকার সংকট কাটিয়ে উঠেছি, তা সর্বাংশে সঠিক বলে মনে করি না। মাসে আমাদের এক কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। আমাদের হাতে কিন্তু এখনও সে অনুপাতে টিকা নেই। টিকা সংগ্রহে বারবার আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। টিকার আওতায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আনতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে বয়স্কদের প্রাধান্য দেওয়া জরুরি।

টিকাকেন্দ্রে আমরা উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করছি। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। এ অবস্থায় টিকাকেন্দ্রের পরিসর বিস্তৃতকরণের বিষয়টিও জরুরি। তাছাড়া টিকাদান প্রক্রিয়া একেবারে সহজ করা প্রয়োজন। সিংহভাগ মানুষের প্রযুক্তিগত ধারণা নেই।

টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। টিকা প্রদানে আমাদেরও সাফল্য আছে। আমাদের দেশে টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া এখনও প্রস্তুতি পর্বে। এই প্রক্রিয়া গতিশীল করা জরুরি। যৌথ কিংবা একক প্রচেষ্টায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। টিকা কার্যক্রমের সফলতার মধ্য দিয়েই আমরা ফিরে পেতে পারি স্বাভাবিক জীবন ও সব কার্যক্রম। স্বীকার করি, লকডাউন অনন্তকাল চলতে পারে না। তাতে জনদুর্ভোগ ও নানামুখী সংকট প্রকট হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তবে এ কথা আমলে রাখা প্রয়োজন, মানুষের জীবন-জীবিকায় কঠিন টান পড়া এবং অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সত্ত্বেও যদি এর মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে বিধিনিষেধ প্রলম্বিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জীবনের স্বার্থে অনেক কিছুই মেনে নিতে হবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেল সব ব্যবস্থার পরিসর বাড়িয়েও সুফল মিলবে না।

আরেকটি বিষয়, যদি বলি মানুষ এখন থেকে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলবে; তবুও রাতারাতি আমরা সুফল পাব না। এ জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। এর আগ পর্যন্ত যত কষ্টই হোক না কেন, বিধিনিষেধ বলবতের বিকল্প আছে বলে মনে করি না। সব ব্যবস্থাই হতে হবে সমন্বিত। সবার সক্রিয়তাও সমভাবে জরুরি। হাসপাতালগুলোতে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যতটা সম্ভব দ্রুত তা দূর করতে হবে। চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া গতিশীল করার পাশাপাশি এমনভাবে স্বাস্থ্যসেবা ঢেলে সাজানো জরুরি, যাতে একটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অন্য ক্ষেত্রে টান না পড়ে। ইতোমধ্যে করোনা-সংক্রান্ত আমাদের দায়িত্বশীল সবারই অভিজ্ঞতা কম সঞ্চিত হয়নি। এর আলোকেই সব পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক:রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর