
আনোয়ারুল হক ।।
এবারে বর্ষা এসেছে সময় মতোই।
মেঘের আড়ম্বরে দিগন্ত ছাপিয়ে মাঝরাতে, সকালে-বিকেলে, যখন খুশি তখন নামছে সে।
গভীর রাতে শুরু হবার পর থেকে ঝরছে তো ঝরছে।
যেন মেঘের দেবতা নীল-গিরিতে মৃগয়ায় যাওয়ার সময় উপুড় করে দিয়ে গেছেন জলের কলস।
যে জন্যে মাঝরাত থেকে অঝোর ধারায় ধরায় নেমে এসেছে জল-কুমারীরা। বেজেই চলেছে তাদের জলের ঘুঙুর।
থামার কোনো লক্ষণ নেই। ঝম্ ঝম্ ঝম্।
এদিকে
সকালে ঘুম ভেঙেই দেখে সময় টানটান। দ্রুত তৈরি হয়ে বর্ষাকে পৌঁছতে হবে
মতিঝিলের অফিসে। এমন বৃষ্টির দিনেও আলসেমি করে ঘরে বসে থাকার উপায় নেই।
সকাল নয়টায় মতিঝিলে গিয়ে নামতে হলে অন্তত দেড়-দুই ঘন্টা আগে ঘর থেকে বের
হতে হয়। তাই বেরিয়েছে বর্ষা।
কিন্তু বাহারি ছোট্ট ছাতায় বৃষ্টির কণা,
জলের ঝাপটা থেকে কোনভাবেই বাচাঁতে পারে না সে নিজেকে। ভিজে যাচ্ছে। তবুও এক
হাতে শাড়ি, অন্য হাতে ছাতা ধরে ধীরে ধীরে লঘু পায়ে মীরপুর বারো নম্বর বাস
স্টপেজের দিকে বর্ষা হাঁটছে। লঘু পায়ে।
ভাবলো, এই অবস্থায় কেউ কী
দেখছে ওকে ? দেখলে, বর্ষা নিজেই নিশ্চিত, তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না
কোন বিমুগ্ধ দর্শক। গতরাতে ঘুমের মধ্যে, আধো জাগরণে, টিনের চালে একটানা
বৃষ্টির শব্দে বর্ষা বুদঁ হয়ে যা ভাবছিলো স্বপ্নের মধ্যে সেটা শুধুই
স্বপ্ন। তারই রেশ ধরে সকালে ভেবেছিল, আজ সে অফিসে যাবে না।
এই বৃষ্টিতে কেউ অফিসে যায় ! না অভিসারে !
তবে আজ বর্ষার খুশি হওয়ার দিন। সে বৃষ্টি ভালোবাসে।
বৃষ্টিতে
নিজের সঙ্গে নিজের অভিসারে ভালো লাগছে তার শরীর ও মনে। ওর নামের জন্যই কি
না-বর্ষা, বৃষ্টি এলে খুব খুশি হয়। সেই ছোট্টবেলা থেকে আজ অবধি।
জানার পর থেকে বর্ষার কাছে মনে হয়, এই বৃষ্টি যেন রবিঠাকুরের গান। তার মনের বীণার তারে যে সুর হয়ে বাজে,
‘বাদল বাউল বাজায় বাজায় রে। বাজায় রে একতারা.....’।
হাঁটতে হাঁটতে বর্ষার বুকের ভেতর সাঁওতালি মাদল গুরু গুরু বেজে ওঠে-
-‘এমন দিনে তারে বলা যায় এই ঘন ঘোর বরিষায়...।’ মনে পড়ে।
ভাবনাটা এড়ানো গেলো না, মনের কথা কাউকে বলার মতো মনের মানুষ নেই ওর।
হয়নি এখনও। যার প্রশান্ত আকাশে, দুই বাহু বেষ্টনীর নিবিড় আশ্রয়ে তার দিন যাবে, রাত হবে স্বপ্নের মতো
প্রতিদিন অন্যরকম হবে দুজনে- দুজনার।
তাহলে বর্ষা কি দেখতে ভালো লাগার মতো মেয়ে নয় ?
তা
তো নয়ই। বর্ষা একাধিকবার দেখার মতো মেয়ে। বৃষ্টি জলের মতোই স্বচ্ছ তার
রূপ, মনোলোভা, সুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার সহপাঠী অনেকেই আগ্রহী ছিল
ওর প্রতি কিন্তু বর্ষারই কেন জানি- কাউকে মনে ধরেনি। নিজেকেই মাঝে মাঝে
প্রশ্ন করেছে সে, কেন হলো না ?
আবার জবাবটাও নিজেই দিয়েছে, যার ব্যাখ্যা করা যায় না।
জিজ্ঞেস
করলে বর্ষা কাউকে এই ‘কেন‘র ব্যাখ্যা দিতে পারে না। মন দেয়া নেয়ার বিষয়
কবে, কখন, কোথায় ঘটে যায় তা কী বলা যায়! বর্ষা তখন প্রশ্ন-কর্তাকে প্রশ্ন
করে,- বলো, বলা যায়?
তা এতদিন হলো না তো হলো না। ভালো, কিন্তু
মতিঝিল পাড়ায় কেউ কি আজও তার চোখে পড়েনি- চোখে ধরার মতো ? হয়-তো, হয়-তো বা
না। এমনই অনিশ্চিত বর্ষা।
আর চোখে পড়লেও তাকানোর মতো সময় কই তার ?
সকাল-সন্ধ্যা মাথা গুঁজে কেবল কাজ আর কাজ। সদা ব্যস্ত মতিঝিল পাড়ার
কর্পোরেট অফিস ওর। অন্যদিকে চোখ যাওয়ার মতো সময় হলে চাকরিটাই যাবে!
ফুরসত নেই। এই যে আজ ওর ইচ্ছে ছিল এই একটানা বৃষ্টিতে ঘরে বসে শুধু রবিঠাকুর। তা আর হলো কই?
বৃষ্টিতে ভিজে একসা হতে হতে জল ভেঙে ছুটে চলা।
কারণ না থাকলে কী যে ভালো লাগত অকারণ এই বৃষ্টিতে ভেজা। বর্ষায় বর্ষার অবগাহন অভিসার।
না, আর চলা যায় না। তাহলে এই ভিজে শাড়ি নিয়ে অফিসে আর পা রাখা যাবে না।
বাধ্য
হয়েই বর্ষাকে দাঁড়াতে হল বাই লেন রাস্তার পাশে ছোট্ট একতলা বাড়ির একচিলতে
বারান্দায়। বড়িটার টিনের চালে আকাশ ভেঙে জল ঝরছে এক ধারায়। ভালো লেগে গেল
ওর একাকী এইভাবে আধভেজা দাঁড়িয়ে থাকা।
ডান হাতের কব্জি উল্টে দেখলো
সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। চোখে পড়লো, রাস্তায় সামনে, ডানে-বাঁয়ে কেউ নেই।
একচিলতে বাড়িটার বাইরে বারান্দার দিকের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। চারপাশে
তাকিয়ে চোখে পড়লো, কী আর্শ্চয! বাসার ডানদিকে এক-টুকরো সবুজ ধানখেত। বামে
ঘন চিকন দুর্বা ঘাসের উপর খোলা হাওয়া এপাশ ওপাশ দোল খায় এমন একটি খেলার
মাঠ।
দুয়ের মাঝখানে একাকী বাড়িটি দাঁড়িয়ে, যেন একলা পথিক। বর্ষার মতোই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে।
এই অঝোর ধারা থামলেই- মনে হয়, যাবে কোথাও।
এইসব
ভাবতে ভাবতে বর্ষা একমনে গাইছিল-‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়...’ একটু জোরেই
গলা ছেড়ে আপন মনে গাইছিল সে। ভেবেছে, মাথার ওপর টিনের চালে জলসেনার
কুচকাওয়াজ ছাপিয়ে কে ই বা শুনতে পাবে ওকে। আশেপাশে তো কেউ নেই। তাই একের পর
এক গাইতে গিয়ে তার সময় গড়ায়।
ওদিকে রাস্তায় জলের শরীর বয়ে যায় জলের
মতন। এমন সময় বর্ষার পিছনে খুট করে বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে গেল।
শরীরের আধেক স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমড়ের নিচে জিনসের প্যান্ট, ঘুম ঘুম চোখে
এলোমেলো চুলের যুবক সুদর্শন বারান্দায় বের হয়ে স্বপ্নে নয়,বাস্তবেই, যেন সে
জলকন্যা দেখল।
একে অপরকে দেখে ওরা দুজনেই বিস্মিত। বর্ষা কিছুটা লজ্জা
পেয়ে অপ্রভিত। সেই তুলনায় সুদর্শন সপ্রতিভ। টগবগে। ভেজা চুল, ভিজে যাওয়া
শাড়ি যা কিনা বেশ আরামেই জড়িয়ে আছে বর্ষার জলের শরীর দেখে যুবক ভরাট গলায়
আর্তনাদ করে ওঠে,
-‘এ কী! এই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে আপনি খোলা হাওয়ায়
দাঁড়িয়ে আছেন ? ঠান্ডা লেগে যাবে যে! ছি ছি!’ বলেই যেমন বেরিয়ে আসা তেমনি
একহারা পোক্ত তামাটে মসৃণ শরীর আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
বর্ষা নির্বাক। বিস্মিত। কথা নেই, বার্তা নেই, চেনা নেই, জানা নেই দরজা খুলেই কলকল করে কথা বলে,
এ কী, ঠান্ডা লেগে যাবে যে! আশ্চর্য !
বাইরে
থেকে খোলা দরজার বুকের ভিতর দিয়ে যতটুকু বোঝা যায় কিংবা দেখা যায়, ঘরের
কোন এক দেয়ালে একটা নীল আলো জ্বলছে। সেখানে সেঁধিয়ে পড়া যুবকটির কোনো সাড়া
নেই। তবে স্টিলের আলমারি খোলার শব্দ পাওয়া গেল। তার কিছু পর যুবক বেরিয়ে
এলো ডান হাতে ভাঁজ করা গোলাপি রঙের একটা বড় টাওয়েল নিয়ে। সেটা স্মিততুখে
বাড়িয়ে দিল বর্ষার দিকে। তার অন্তর্ভেদি চোখ বর্ষার মুখের ওপর।
-‘নিন,
চুল হাত মুখ সব মুছে ফেলুন। আর কিছু মনে না করলে এই ঠান্ডা ভেজা বাতাসে
এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরের ভেতরে এসে বসুন। সংকোচ করবেন না। নিন, টাওয়েলটা
ধরুন।
চওড়া হেসে তাকিয়ে আছে যুবক। বাড়ানো হাত। আর সত্যি সত্যিই বর্ষা দ্বিধান্তিত। চমকিত।
নেবে টাওয়েলটা?
মনে মনে প্রশ্নটা নিজেকেই করে সে। না কি ‘থ্যাস্কস্’ বলে ফিরিয়ে দেবে ?
এটাও ভাবলো, অপরাগতা জানালেই ওই বাড়ানো হাত কি ফিরে যাবে ?
মনে হয় না! একটু নড়তেই বর্ষার বাম হাতের কাঁচের চুড়ি যেন জবাব দিল,
-ঝিনিৎ ঝিনা..
দুই.
যুবকের
চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষা পড়ে বর্ষা। মনে হয়, ফিরিয়ে দিলে দুঃখ পাবে।
গভীর বেদনায় ওই চোখ বরষার জলের মতোই আকুল হবে। যা দেখে বর্ষা মনে মনে লজ্জা
পাবে।
লহমায় সিদ্ধান্ত নিলো, এমন বাড়ানো হাত ফেরানো টিক নয়।
সে ডান হাত বাড়িয়ে টাওয়েলটা হাতে নিতেই সুর্দশন টোল পড়া গালে মধুর করে হাসল।
মনে মনে বললো বর্ষা,-বাহ্! ছেলেদের গালেও টোল পড়ে! দেখিনি তো কখনো এমন!
টাওয়েলের
মিহি সুতোর জমিন থেকে একটা মিষ্টি ফুলের সৌরভ, ভেসে ভেসে ভালোলাগা হয়ে
বর্ষার বুকের গভীরে ঠাঁই নিল। তারপর তার মনের ভাঁজে ভাঁজে বাদলের মাদল হয়ে
বেজে ওঠে, গুরু গুরু। মনে পড়ে,
সাগর ছুঁয়ে আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় দেখতে দেখতে বড় হয়েছে বর্ষা।
আলতো
হাতে এক বিন্দু নাকফুলের নাকের ওপর চেপে ধরা টাওয়েলের গন্ধ তার নরম শরীরে
পাহাড়ি ভেজা মাটির সবুজ পাতার সুরভি ছড়ায়। চুলে মুখে গ্রীবায় একটু সময় নিয়ে
এই ভাললাগা চেপে ধরে রাখল যুবতী।
মনে মনে ভার্সিটি জীবনে পড়া একটি উর্দু কবিতা একটু বদলে দিয়ে নিজেকে শোনায়,
-‘এ বরষ তু ইতনা বরষ, ইতনা বরষ, হাম যা না সাকেঁ...।
টাওয়েল
থেকে মুখ তুলে দেখে, ওর শাড়িভেজাশরীর ও মুখের ওপর থেকে চোখ সরায়নি যুবক।
বর্ষা তার ভেজা লাবণ্য মোটামুটি মুছে নিয়ে টাওয়েলটা হাত বাড়িয়ে দিতে গেলে
সুর্দশন বলল,
-‘আপনার শাড়ি তো প্রায় ভিজে গেছে। ওটা গায়ে জড়িয়ে রাখুন। তা না হলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে’।
কথাটা শুনে বর্ষার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল শব্দটা- ‘তো’?
সপ্রতিভ সুদর্শন এমন জিজ্ঞাসায় ভড়কে যায় না। সে বলে,
-‘তো আর কী। না না, আমার কিছু না। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো আপনার হবে’।
বর্ষা
কোমল দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো যুবকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
টাওয়েলটা নিরবে গায়ে জড়ায়। বৃষ্টিজলের ঠান্ডায় আসলেই তার শীত শীত লাগছিল।
এবার বর্ষাই কুণ্ঠিত স্বরে বলে,
-‘আমি মোটেও ভাবিনি আশে পাশে কেউ আছে’।
-‘তাতে ভালোই হলো’ ।
-‘কেন’?
-‘কেউ
আছে ভাবলে আপনি মন খুলে গাইতেন না। খুব ভালো গলা আপনার। ঘরের ভেতর থেকে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার খুব ভালো গান শুনা হলো। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম-
‘বাহ! গানের গলার মতোই দেখতেও আপনি-হা হা হা-’
সুদর্শন কথা শেষ করে না। এই বয়সের সবাই জানে, সবকথা শেষ করতে হয় না। বুঝে নিতে হয়।
বর্ষা
কথাটা শুনে একটু রাঙা হল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে সে তো গাইতই।
চট্টগ্রাম বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিল। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর মা ও ছোট
বোন এই তিনজনের সংসার বাচাঁনোর তাগিদে ঢাকায় ছুটে আসা। মিরপুর বারো নম্বর
থেকে দশ টাকা রিকশা ভাড়ার দূরত্বে ডিওএইচএসে আরো তিনজন কর্মজীবী মেয়ের
সঙ্গে এটাচড্ ব্যথসহ চাররুমের একটা বাসায় থাকে সে। এই রাস্তায় প্রতিদিনই
অফিসে যাওয়া –আসা করতে হয় তাকে। এই এক চিলতে বাসাটা চোখে পড়েনি কেন এতদিন
? মানুষটাকেও কোনদিন দেখলো না!
-‘কি ভাবছেন আপনি’?
বর্ষা জবাব দিল
না। কিন্তু যে কোনো যুবকের বুকের ভেতরে মোচড় দেয়ার মতো করে সুদর্শনের দিকে
তাকিয়ে হাসল সে। তারপর ওরা অনন্তকাল ধরে জলের ছাঁটে ভিজে যাওয়া বারান্দায়
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না। দুজনেই বুঝি জানে, কখনো কখনো নিরবতা
হাজারো শব্দের চেয়ে কাঙ্খিত হয়ে ওঠে।
ওরা কান পেতে শোনে, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে।
আর্শ্চয!
তারা নিজেদের জানার মতো যথেষ্ট সময় পেল। তবুও তারা কেউ কারো নাম-ধাম জানতে
চাইল না। যেন যেভাবে ওদের দেখা হলো সেভাবেই আবার ওদের দেখা হয়ে যাবে কোনো
না কোনোদিন। আবার কোনো বৃষ্টির দিনে কিংবা রোদেলা দুপুরে।
দেখতে দেখতে একসময় বৃষ্টি ধরে এলো। থামবেই তো। শুধু থেমে থাকে না সময়।
বর্ষা
ঘড়ি দেখল। এখন আর অফিসে গিয়ে কোনো কিছুতেই মন বসবে না। সময়ও নেই। ঠিক করল,
এই অবেলায় ঘরে ফিরে গিয়ে শুধু গান। রবিঠাকুরে কবিতা। ভুনা খিচুরির সাথে
সরষে বাটা ইলিশ!
সুদর্শনের হাতে টাওয়েলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,-‘যাই তাহলে’।
-‘যাই না। বলুন-আসি’। উত্তরে ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসে।
হাসলে একজনের মুক্তো ঝরে। আরেক জনের সুরভি ছড়ায়। বর্ষা ভাবে।
ফিরে
যেতে যেতে বর্ষা যতবার পিছন ফিরে তাকাল ততবারই হাত তুললো সুদর্শন। আর
বর্ষার মনের ঝরনাতে অবগাহন করে করে দুটো বাক্য জলের মতো ঘুরে ফিরে তার কানে
বাজে- ‘যাই না, বলুন-আসি’।
বর্ষা ফিরে আসে। কিন্তু তার মন আর তার সঙ্গে ফিরে আসে না।
রয়ে যায় বৃষ্টিভেজা একটি সকালের বারান্দায়। সেই থেকে ঘুম জাগরণে দুই হাতে, আঙুলে ও ঠোঁটে
অদিতি কপোলে তার লেগে থাকে অহর্নিশ রিমঝিম বরষার একটি সকালের সুরভি, যা কিনা হৃদয় থেকে মুছে ফেলা গেল না আর। মন শুধু বলে গেলো,
-‘দেখা হবে। দেখা হবে কোন না কোনদিন’।
তিন.
বর্ষাকালেও
প্রতিদিন বৃষ্টি থাকে না। আর এখন তো বর্ষা যাই যাই করছে। সারাদিন আকাশে
ঝলমলে রোদ গেছে। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমে হেলে পড়া রোদের মুখে বর্ষা সেদিন
মতিঝিলে অফিস থেকে বের হয়েছে। তার অফিসের সামনে দাড়িঁয়ে সে রিকশা খুঁজছিল।
ও যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার থেকে অনতিদূরে একটা খালি রিকশা দেখে হাত তুলে ডাকলো রিকশাওয়ালাকে!
রিক্সাটা এলো না। কিন্তু যে এগিয়ে এলো তা জন্যে প্রস্তুত ছিলো না বর্ষা।
দেখল, সেদিনের বর্ষার সকালে দেখা হওয়া যুবক সামনে এগিয়ে এলো। প্রচ- বিস্ময় তার চোখেমুখে,
-‘আরে
আপনি ? আপনাকে যে আমি তারপর থেকে মনে মনে কত্তো খুঁজেছি। নাম, ঠিকানা
কিছুই রাখা হলো না। জানেন, আমি তো আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, আর বুঝি দেখা
হবে না কোনদিন। আজ কী সৌভাগ্য আমার’!
বর্ষা নিজেও বিস্মিত, মনে মনে
রোমাঞ্চিত সুদর্শনকে দেখে। কী বলবে সে! তার মুখের রঙ বদল হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ।
অপ্রস্তুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-‘অবাক ব্যাপার, আপনি এখানে ?
প্রগলভ যুবকের তড়িৎ জবাব,
-‘তাইতো, আপনি এখানে, তাই বুঝি আমিও এখানে!
দুজনেই হাসে। প্রাণখোলা। তারপর দ্বিধাহীন যুবক ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় বর্ষার দিকে, বললো-
‘আজ আর ভুল করবো না। ধরুন হাতটা।
বর্ষার একটুও দ্বিধা হলো না বাঁহাতে সুদর্শনের প্রসারিত ডান হাত হাতের মুঠোয় তুলে নিতে।
সেই
সময় র্বষার এক টুকরো ঘনকালো মেঘ পশ্চিম আকাশ থেকে একটু থমকে ওদের দুজনকে
দেখলো। সেইসাথে আরও কিছু উড়ো মেঘ এসে জড়ো হলো একসাথে। কী যেনো কথা হলো
মেঘেদের দুজনের মাথার ওপর। তারপর নেমে এলো ঝরঝর।
হঠাৎ বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাতে দুজনেই র্বষার ছোট্ট ছাতার নিচে ঘন হয়ে এলো একটু বেশি ।
কেউ ভেবেছে কি না জানি না, বৃষ্টি কখনোই খারাপ কিছু নয়। অন্তত প্রেমিক প্রেমিকার জন্য।