ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বাবার স্মৃতি
Published : Sunday, 20 June, 2021 at 12:00 AM
বাবার স্মৃতিশাহজাহান চৌধুরী ||
আজ বাবা দিবস।
১৬ মার্চ ২০২১ ছিলো আমার বাবার ২৩তম মৃত্যু বার্ষিকী। কেন জানি সেদিন বাবাকে খুব মনে পড়েছিল। আমাকে লেখা আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের চিঠির ব্যাগটা বের করলাম, প্রায় সাড়ে তিন’শ চিঠি। সেখানে পেয়ে গেলাম আমাকে লেখা বাবার একটা চিঠি। চিঠিটার এক পিঠে আমার মা লিখেছেন এবং এক পিঠে বাবা। আল্লাহর রহমতে আমার মা এখন জীবিত কিন্তু বাবা চলে গেছেন আজ থেকে ২৩ বছর আগে। চোখ দিয়ে আপনা-আপনি পানি গড়িয়ে পড়লো। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে মুখ থেকে ‘বাবাগো’ বলে একটা চিৎকার বরিয়ে এলো। আমার স্ত্রী কাছেই ছিল, সে বললো, কি হয়েছে? চিঠিটা এগিয়ে দিলাম। হাতে নিয়ে সে সান্ত¡না দিলো। আমারও বাবা নেই, আমরাও একদিন থাকবো না, শুধু বিধাতার কাছে প্রার্থনা- “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগীরা”।
আমার বাবা মীর কাশেম চৌধুরী ১৯২৯ সালে দাদা মীর আহমেদ চৌধুরীর ঔরশে দাদী অংকুরুন্নেছা চৌধুরীর গর্ভে চৌদ্দগ্রাম থানার শিলরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে পড়ালেখা করে এক সময় কুমিল্লা এসে কলেজে ভর্তি হন এবং তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে চাকুরি নেন। পড়ালেখা আর এগোয়নি। তাঁর ছোট ভাই মীর হোসেন চৌধুরী (১৯৭০-এর নির্বাচনে দক্ষিণ চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত এম সি এ) তখন ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। থাকতেন চর্থা নবাব বাড়ির কাছে একটা মেসে।
১৯৫৩ সালের ১৩ মে বাবা বিয়ে করেন চৌদ্দগ্রামের বিজয় করা চৌধুরী বাড়ির আগা আফজালুর রহমানের বড় মেয়ে, আমার মা রহিমা খাতুন চৌধুরীকে। বাবা ডাইরি লিখতেন। সেখানে তাঁর সন্তানদের এই পৃথিবীতে আগমন, দৈনন্দিন বাজার খরচ ইত্যাদি লিখে রাখতেন। ডাইরিটি ছিল হংকং-এর কাউলিন ট্রেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি লিঃ এর ১৯৫২ সালের। বাবা তার প্রথম পাতায় লিখেছেন তার জন্ম তারিখ ৩ অগাস্ট ১৯২৯ এবং একই পাতায় লিখা ‘লাইফ বিগেইন থার্ড মে ২০ বৈশাখ, ১৯৫৩ খ্রিঃ’। অর্থাৎ তার জন্ম ও বিয়ের তারিখ।
মাকে নিয়ে এখন আমাদের সংসার। আমার বাবা একজন হিসেবি এবং অর্গেনাইজড লোক ছিলেন। নিজ পরিবার, বাবা, মা, ভাই-বোন সবাইকে আগলে রেখেছেন। দাদার মৃত্যুর পর ভাইবোনদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদী, বাড়ি করে দেওয়া সব কিছুতেই ছিল সূচারু রুচি সম্মত দৃষ্টি। তিনি সে সময় একজন আধুনিক লোক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ইমপোর্ট করে ১১ ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও ও হাম্বার সাইকেল আনিয়েছিলেন। যে সাইকেলে আমি পুরো কুমিল্লা শহর চষে বেড়িয়েছি।
বাবার স্মৃতিতিনি স্কুল জীবনে ছিলেন ফুটবল টিম-এর ক্যাপ্টেন। ১১ জন খেলোয়াড়কে তিনি খেলার জন্য সাজাতেন তেমনি করে তাঁর পরিবারকে সাজিয়েছিলেন। তিনি তার সব ছেলেদের তার জীবীত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছেন এবং সব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ছেলেমেয়েদেরকে তিনি কি পরিমাণ ভালোবাসতেন  নিচে উল্লেখিত কথাতেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
বাবা যতটাই বেতন পেতেন তিনি যেখানেই চাকুরি করেছেন তার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। বাবা ১৯৫৬-৫৮ সালে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলস ন্যাশনাল ব্যাংকে কর্মরত। আমার মায়ের কোলে তখন আমার ছোট ভাই শাহনেওয়াজ চৌধুরী শানু। আমি বাসায় দুষ্টামি করতাম বলে বাবা একদিন আমাকে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন আর আমিও ফাঁক পেয়ে মিল ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। তখন আমার বয়স ৪ বছর। কিছুক্ষণ পর বাবা যখন টের পেলেন আমি তো তার পাশে নেই তিনি অস্থির হয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন কারণ পেপার মিলের  বাঁশ থেকে কাগজের ম- তৈরি করতে বড় বড় ট্যাংক তখন ঘূর্ণায়মান অবস্থায়। তিনি নাকি পাগলের মতো চিৎকার করে আমাকে ডাকছেন আর খুঁজছেন। মিল কর্তৃপক্ষ মেইন সুইস অফ করে দিল এবং আমাকে খুঁজে পেল এক শ্রমিকের কোলে। এ দৃশ্য দেখে বাবার জ্ঞান হারালেন। আমিত দেখিনি মায়ের কাছে শুনেছি তিনি এরপর তদবির করে সেখান থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছেন নোয়াখালী সেখান থেকে আবার বদলী হয়ে দিনাজপুর। এজন্য তাঁকে মাশুল দিতে হয়েছে। তাঁকে দিনাজপুর বদলি করা হয়।
আমাদেরকে ক’দিনের জন্য বাড়ি রেখে তিনি চলে গেলেন দিনাজপুর। দাদা বাড়িতে বেশ ক’দিন ... বাবার শরীরের উত্তাপ, গন্ধ না পেয়ে আমিও নাকি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। বাবার অবস্থাও তথৈবচ। ততদিনে আমার মায়ের কোল জুড়ে আমার বড় বোন নূরুন নাহার বেবী এসেছে। বেবীর জন্মের তিন/চার মাস পরেই বাবা আমাদের নিতে বাড়ি আসলেন। তখন থেকেই আমার স্মৃতি বাবাকে নিয়ে ঘটা সময়গুলো আমার কিছু মনে আছে। যেমন আমাদের বাড়ির সামনে পেছনে দুটি বড় পুকুর ছিল। আমি ঘাটে দাপাদাপি করতাম। বাবা এসে যে ক’দিন বাড়ি ছিলেন তার হাতের তালুতে আমাকে নিয়ে সাঁতার শেখাতেন। তিনি চিৎ সাঁতার দিয়ে আমাকে বুকে নিয়ে সাঁতার কাটতেন। এগুলো আমার অবছা মনে পড়ে যখন আমি আমার মেয়েদের দারোগাবাড়ি মসজিদের পুকুরে এভাবে সাঁতার শেখাতাম।
গুনবতী রেল স্টেশন থেকে দিনাজপুর রওনা হলাম। ভৈরব ব্রিজ দেখলাম। যার এপাড়ে ওপাড়ে দুটি স্টেশন, এখানে থেকে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাট লাইনের দিকে চলে গেলাম। আমার মনে আছে বাড়ি থেকে দাদী দুটি টিফিন ক্যারিয়ার করে গুড়ির রুটি আর মুরগীর মাংস পাক করে দিয়েছিলেন। দিনাজপুর পৌঁছাবো আমরা পরদিন বিকেলে। ট্রেনে আমি আমার ঘোড়া অর্থাৎ বেডিং এর উপরই সারাক্ষণ কাটিয়েছি। মা সবাইকে খাইয়ে দিলেন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে বাবা আমাকে পাখীর ছানার মতো খাইয়ে দিয়েছিলেন। গভীর রাতে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে রেলের ফেরি। ফেরিতেও আমাদের নির্দিষ্ট যায়গা ছিল ইন্টার কাশে।
ভোরবেলা গিয়ে পৌঁছলাম ফুলছড়ি ঘাটে। ঘাটে কুলিরা আমাদের মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। বাবার এক কাঁধে আমি আরেক কাঁধে শানু, মায়ের কোলে বেবী। আমরা সব পেরিয়ে ট্রেনে এসে আবার ইন্টার কাসে উঠলাম। কুলিরা আমাদের রিজার্ভেশনের কাগজ দেখালো। এখানকার ট্রেন অনেক উঁচু এবং পেটমোটা। পরে জেনেছি ওটা ব্রডগেজ লাইন। ট্রেনে উঠে আবার খাওয়া-দাওয়া। বাবা অদূরে একটি টিউবওয়েল হতে পানি নিয়ে আসলো। কিন্তু পানি খেয়ে মনে হলো এটা আমাদের পানির মতো না। আমরা সবাই পাউডার দিয়ে দাঁত মেজে কামরার ওয়াশরুম কাম টয়লেট থেকে শৌচকর্ম শেষ করে বেরিয়ে আসলাম। বাবা কিন্তু টয়লেটের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন। বলাতো যায় না আমরা আবার টয়লেটের ফাঁক দিয়ে পড়ে না যাই।
রেলের টয়লেট নিয়ে একটা সত্য ঘটনা যা মজারও বটে। উপমহাদেশে রেল চালু হয় ১৮শ শতকের শেষ ভাগে ঘটনাটি ১৯০৯ সালের। তখন রেলের বগি ছিল কাঠের। অখিল চন্দ্র নামে এক ভদ্রলোক প্রচুর কাঁঠাল খেয়ে ট্রেনে উঠেছেন। কিছুক্ষণ পর তার তলপেটে প্রচন্ড চাপ। তিনি একটি স্টেশন এলে নেমে স্টেশনের টয়লেট ব্যবহার করছেন। এমন সময় হুইসেল দিয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে দিল। তিনি পড়িমরি করে ট্রেনের পিছনে ছুটলেন কিন্তু ট্রেন ধরতে পারলেন না। তার রাগ হলো। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ করে চিঠি লিখলেন। রেলওয়ের টনক নড়লো। ব্রিটিশ সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন শেষ পর্যন্ত ট্রেনের মধ্যে টয়লেটের ব্যবস্থা হয়। অখিল বাবুর দরখাস্তটি এখন দিল্লীতে রেল জাদুঘরে আছে।
নাস্তা শেষে আর মনে নেই। ঘুম থেকে জাগালেন বাবা। আমরা দিনাজপুর স্টেশনে চলে এসেছি। কুলিরা উঠলো। বাবার দু’জন জুনিয়র কলিগ আসলেন। স্টেশন মাস্টার ও গার্ড সাহেব এসে বিদায় জানালেন এবং বললেন আমরা টরেটক্কায় আগা সাহেবকে আপনাদের কথা জানিয়ে দেব। ৬ বছরের শিশু আমি কিন্তু কেন জানি ভুলিনি আমার প্রথম ভ্রমণের কথা। আসলে বাবা আমাদের যে ¯েœহ মায়া দিয়ে বড় করেছেন তা তার অভিব্যক্তি বা আচরণে একটুও বোঝা যেত না।
এখন আমিও বুঝি সন্তান বাবার যক্ষের ধন। পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ থাকতে পারে কিন্তু একজন খারাপ বাবা বিরল। (সংক্ষিপ্ত)
ইমেলে ছবি আছে