ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
‘বাঁশের পণ্যে ঘুরছে না ভাগ্যের চাকা’
Published : Wednesday, 21 April, 2021 at 12:00 AM
শাহীন আলম, দেবিদ্বার।  
গোপাল চন্দ্র নম’র বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষে গ্রাম ইস্টগ্রামে। গোপাল চন্দ্রের মত এ গ্রামে আরও অন্তত ৩০টি পরিবার রয়েছে যারা বাঁশের  তৈরি আসবাবপত্র বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। শত অভাব-অনটনের মাঝেও এখনো এই পেশা ধরে রেখেছেন গোপাল চন্দ্র নম। ষাটোর্ধ গোপাল চন্দ্র  বলেন, বেত ও বাঁশের সংকটের কারণ ও অভাবের তাড়নায় দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ অনেকে অন্য পেশার দিকে ছুটে যাচ্ছেন। ছোট বেলায় বাবা-মায়ের হাত ধরে এ পেশায় কাজ শুরু করি। বাবা মায়ের শেষ স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও এ পেশা আঁকড়ে আছি। তিনি এ বাঁশ শিল্পের অতীতের কথা বলতে গিয়ে বলেন, একটা সময় ছিল, দিনরাত কাজ করেও মানুষের চাহিদা মেটানো যেত না। এ লোক শিল্পের চাহিদা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পাঠিয়েছি। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঁশের পরিবর্তে প্লাস্টিক পণ্যে ব্যবহার হচ্ছে বেশি। ফলে এ ইস্টগ্রামের মানুষের ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরি পণ্যের এখন আর কদর নেই।
বাবা হুনছি সরকার নাকি ঘর দেয় ? আমার তো বাবা কেহো নাই, এক টুকরো জমিও নেই, আমারে একটা ঘর লইয়্যা দিতে পারবা বাবা ? কথা গুলো বলছিলেন পুষ্প রানী নম (৫৫)। থাকেন একই গ্রামে। এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। ৩০ বছর আগে স্বামী সচিন্দ্র নম বাড়ি ছেড়ে চলে যান, এরপর থেকে তার আর খোঁজ নেই। ভিটেমাটি বলতে এক টুকরো জমিও রেখে যাননি তিনি। ছেলেকে নিয়ে অন্যের একটি ছাউনি ঘরে ভাড়া থাকেন। গাঁয়ে ছিড়াঁফাঁড়া কাপড় দেখিয়ে এ প্রতিবেদককে পুষ্প বলেন, ডুলা বেঁচে ভাত খেতেই পারি না, গাঁয়ের কাপড় পাব কোথায়? ঝুড়ি-ডুলা বানিয়ে জীবন আর চলে না। দিনে চার-পাঁচটা ঝুড়ি,ওড়া বানাতে পারি। এতে আর কয় টাকা আসে।
ইস্টগ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ কুটির শিল্পীরা ঘরের উঠোনে বসে বাঁশের বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করছেন। কেউ বাঁশের শলাকা তুলছেন, কেউ বুনছেন নান্দনিক তৈজসপত্র। এ পণ্য পাশ^বর্তী কুটিবাজার, কসবা, কোম্পানীগঞ্জ বাজারসহ আশপাশের লোকজন তাদের সংসারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র সস্তায় কেনার জন্য এখানে আসেন। প্রতিটি ঘরে ঘুরে আরও দেখা যায়, বাঁশ-বেতের পাটি, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়াসহ বিভিন্ন ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র বানাতে ব্যস্ত কুটির শিল্পীরা। যা গ্রাম-বাংলায় এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। বিলুপ্তির পথে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প। এ শিল্পকে গ্রামীণ লোকশিল্পও বলা হয়।
 ইস্টগ্রামের কুটির শিল্পীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক একটি পণ্যের উৎপাদনে ১৫ থেকে ২০০ টাকার মতো খরচ পড়ে। আর বিক্রয়মূল্য ২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। কখনও কখনও জেলার বাইরে থেকে তাদের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। কাঁচামালের অপ্রতুলতা ও অগ্নিমূল্য দিন দিন কুটির শিল্পকে সংকুচিত করে তুলেছে। দেশের এ কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাপক হারে বাঁশ ও বেত চাষ প্রয়োজন বলে তারা জানান।
কুটির শিল্পী মানিক নম, প্রদীপ, বাদল, দিলীপ, হরিবল ও বাবুল জানান, ‘আমরা ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাঁশের এসব পণ্য তৈরির কৌশল শিখেছি। তারাও শিখেছেন বংশ পরম্পরায়। কুটির শিল্পে তাদের অনেক সুনাম ছিলো। কিন্তু ওই সুনামে আমাদের এ সময়ে আর পেট ভরে না। এখনও দু’বেলা আহারের ব্যবস্থা করতে উদয়াস্ত দিন রাত খাটতে হয়। যে কারণে ছেলে-মেয়েদের উপযুক্ত লেখাপড়া করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান কুটির শিল্পের প্রসারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত পর্যায়েও তেমন কেউ সহায়তা করে না। লোকশিল্প, বৈশাখী মেলায় যে কুটির শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রদর্শনী হয় সেখানেও বাঁশ-বেত শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। আমাদের মাঝে অনেকেই ভূমিহীন রয়েছেন। সরকার কাউকেই একটি ঘরও দেয়নি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মর্কর্তা (ইউএনও) রাকিব হাসান বলেন, কুটির শিল্প নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের বিভিন্ন প্রণোদনার আওতায় আনা হবে। এ শিল্পকে যেন বাঁচিয়ে রাখা যায় সে দিকেও উপজেলা প্রশাসন নজর রাখবে। এছাড়াও যারা সরকারি ঘর পায়নি  তারা লিখিতভাবে আবেদন করলে তাদের ঘরের ব্যবস্থা করা হবে।