ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথা
Published : Tuesday, 20 April, 2021 at 12:00 AM
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||

দ্বিতীয় পর্ব
কুমিল্লায় প্রতিবছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনদিন ব্যাপী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়। প্রথম ও তৃতীয় দিন কুমিল্লা শহরে, দ্বিতীয় দিন মুরাদনগরের দৌলতপুর। এটা এখন বাৎসরিক রুটিন মাফিক অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে। তারপরও কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন-অবস্থান ইত্যাদি গুরুত্ব বিবেচনায় নজরুল ইন্সটিটিউট শাখা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসে উদ্বোধন করে গেছেন। ২০১৫ সালে কুমিল্লায় জাতীয়ভাবে নজরুলজন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান উদ্যাপন করা হয়েছিল। এ নিয়ে কুমিল্লাবাসী গৌরববোধ করে। কিন্তু এ ধারাবাহিকতা রক্ষায় ত্রিশালবাসীর মতো কুমিল্লার জনগণ তেমনভাবে আবেগপ্রবণ নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, সরকারিভাবে জাতীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা না করলেও কুমিল্লাবাসী নিজেরাই সে আদলে প্রতি বছর অনুষ্ঠান উদ্যাপন করতে পারে। আমরা এব্যাপারে অনেকটাই ¤্রয়িমান। অনেকে আবার পারিবারিক গ-ীতে নজরুল ইসলামকে আবদ্ধ করার প্রয়াস পেতে আগ্রহী, যার কোনো ভিত্তি নেই। যথামর্যাদা বা স্বীকৃতি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়, বিশেষভাবে নিজেদের সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে মহৎ বিষয়কে থামিয়ে দেয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। তারপরও কুমিল্লার সংস্কৃতিসেবীরা আশায় বুক বেঁধে চলে। তাই কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমনের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানটি উদ্যাপনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে। যখনই সুযোগ আসবে, কুমিল্লাবাসী এই অনুষ্ঠানটি যথাযোগ্য মর্যাদায় নান্দনিকভাবে উদ্যাপন করবেই। এ প্রসঙ্গে কিছুকথা।
    কুমিল্লার বিদায়ী জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ আবুল ফজল মীর প্রবল ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন যে, যদি তিনি ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কুমিল্লায় জেলাপ্রশাসক হিসেবে কর্মরত থাকতে পারেন, তবে নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানটি যথামর্যাদায় ব্যাপকভাবে করবেন। সে সুযোগটি তিনি যেমন পাননি, তেমনি পেলেও করোনা ভাইরাসের জন্য তা সম্ভবও হতো না, যেমনটি আমাদের নতুন জেলাপ্রশাসক জনাব মোঃ কামরুল হাসান পূর্বতন জেলাপ্রশাসকের উদ্যোগ-প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে ডেকে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর সুবিধাজনক সময়ে শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানটি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। উল্লেখ্য, পূর্বতন জেলাপ্রশাসক জনাব মোঃ আবুল ফজল মীর ২০২০ সালের অক্টোবরে নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় আগমন উপলক্ষ হিসেবে শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের জন্য একটি বই লিখতে আমাকে বললেন। আমি আগ্রহ সহকারে পা-ুলিপি প্রস্তুত করি এবং জেলাপ্রশাসন থেকে ‘নজরুল ও কুমিল্লা’ শীর্ষক বইটি তিনি প্রকাশ করেন। এসব কথাগুলো বলার একটিই উদ্দেশ্য, যিনিই কুমিল্লার জেলাপ্রশাসক থাকুন না কেন, আমাদের আবেগ-প্রত্যাশার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে বা আমলে নিয়ে সুবিধাজনক সময়ে শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করবেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, আমাদের বর্তমান জেলাপ্রশাসক এই বিষয়ে করোনাকালীন সভা করেছেন এবং আন্তরিকভাবে আমাদের মনোভাব অনুধাবন করে আশ্বস্ত করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুষ্ঠান-উদ্যাপন কীরূপ হতে পারে, এ ব্যাপারে কতিপয় প্রস্তাবনা প্রকাশ করতে চাই।
    নানা সূত্রে অনেকের অভিমত হলো নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পাঁচদিন ব্যাপী হোক। কারণ, নজরুল ইসলাম পাঁচবার কুমিল্লায় এসেছিলেন। তন্মধ্যে একদিন মুরাদনগরের দৌলতপুর এবং বাকী চারদিন কুমিল্লা শহরে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হোক।
    অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে শহরকে নজরুলময় করে সাজাতে হবে। বিশেষত যেসকল জায়গায় নজরুল ইসলামের পদচারণা ছিল, সেখানে দৃশ্যমান স্মারকস্থাপন এবং ঐস্থানে কবির উপস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে ফেস্টুন অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা যেতে পারে। অনুষ্ঠান উদ্যাপনের স্থান টাউনহল প্রাঙ্গণে হলে সকলেই উপভোগ করতে পারবেন।
    অনুষ্ঠানের উদ্বোধন যদি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে করা যায় তা হবে ঐতিহাসিক। অনুষ্ঠানে নজরুল ও কুমিল্লা বিষয়ে সেমিনার, নজরুল-সঙ্গীতের আসর, নজরুলের নাটক প্রদর্শন, নজরুল-কুমিল্লা বিষয়ে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি অনুষ্ঠানমালা সাজানো যেতে পারে।
    নজরুল ইন্সটিটিউট শাখা কেন্দ্রের দায়িত্ব কী হবে, তা আলোচনা করে ঠিক করা যাবে। নজরুল-পরিষদ কীভাবে সংশ্লিষ্ট হবে, তাও আলোচনা করে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, অনুষ্ঠানটি সার্বজনীন, প্রাতিষ্ঠানিক নয়, অংশগ্রহণে সব বিষয়ে মানসম্পন্ন বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। এ উপলক্ষে ব্যক্তি বা সমষ্ঠিগত প্রকাশনা থাকা জরুরি। স্থানীয় পত্রিকাগুলো প্রতিদিন বিশেষ সংখ্যা বের করতে পারেন।
    কুমিল্লায় নজরুল পরিষদ যে উদ্দেশ্যে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তেমনভাবে আশা পূরণ করতে পারেনি। একমাত্র কবিবন্ধু মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদারের ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’- বইটি প্রকাশনা ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কোনো প্রকাশনা হয়নি, মরহুম মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস সাহেবের ‘কুমিল্লায় নজরুল’-এর পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল, এছাড়া অনেকের নজরুল বিষয়ক বই নজরুল পরিষদ প্রকাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু লেখকদের যথেষ্ট সময় দেয়া হয়নি, বইগুলো প্রকাশের আগে রিভিউ করার ব্যবস্থা না থাকায় বিষয়বস্তু ও মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নজরুল-বিষয়ক বই প্রকাশে নজরুল পরিষদ আন্তরিক হতে পারেনি। এছাড়া প্রতি বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক জেলাপ্রশাসন যে সরকারিভাবে নজরুল-জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়, তার মধ্যেই সীমিত থাকতে হয়, তার বাইরে নজরুল পরিষদ নিজস্ব কোনো অনুষ্ঠানমালা সংযোজন করতে পারে না। সরকারি অনুষ্ঠানকেই নিজেদের বাৎসরিক কর্মকা- হিসেবে মনে করে আসছে। এছাড়া নজরুল ইন্সটিটিউট শাখা কেন্দ্র স্থাপনের পর নজরুল-পরিষদের ঠিকানা এখন রাস্তায়, অফিস এখন সম্পাদকের কথিতব্যাগে। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনা হলো-নজরুল ইন্সটিটিউটে কোনো অফিস কক্ষ বরাদ্দের দরকার নেই, অন্তত দু’মাসে একবার কুমিল্লার নজরুল-ভক্তদের নির্ধারিত সময়ের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হোক। নজরুল পরিষদ উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাবেন, কুমিল্লায় নজরুল ইসলামকে নিয়ে কীভাবে গবেষণা করা যায়, তাঁরা পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, সেমিনার করবেন, প্রবন্ধ পাঠ করবেন। আমন্ত্রিতদের একবেলা চা-বিস্কোট খাওয়াবেন এবং মাথাপিছু যাতায়াত ১০০/= টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলো প্রথমে স্থানীয় বা জাতীয় পত্রিকায় এবং কোনো একসময়ে নজরুল পরিষদ পুস্তকাকারে প্রকাশের জন্য উদ্যোগ  গ্রহণ করতে পারেন।
    এই পরিক্রমায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কুমিল্লায় আগমনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২০২৬ সালের জন্য প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে।
আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বলতে হয় যে, কুমিল্লাজেলার মুরাদনগরের দৌলতপুর নিবাসী আলী আকবর খানই নজরুল ইসলামকে কুমিল্লায় নিয়ে এসেছিলেন। কী উদ্দেশ্যে এবং কেন নজরুল ইসলামকে নিয়ে এসেছিলেন, তা এখন মুখ্য বিষয় নয়। আলী আকবর খান সম্পর্কে মুজফফর আহমদের মাধ্যমেই সবিশেষ জানতে পারি। এক্ষেত্রে মুজফফর আহমদ আলী আকবর খানকে যথাযথ উপস্থাপন করেননি। তিনি ব্যক্তি আলী আকবর খানের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন এবং অপছন্দও করতেন। নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় আসুন, তা চাননি, বাধাও দিয়েছেন, কোন উদ্দেশ্যে কবিকে আলী আকবর খান নজরুল ইসলামকে কুমিল্লায় সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছেন বা বিপদেও ফেলতে পারেন এরূপ ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঘটনাপ্রবাহে হয়ত বা আলী আকবর খানের কর্মকা- স্বচ্ছ ছিল বলে মনে হয়নি। আমরা এদিকে বেশি আলোচনা করতে চাই না এজন্য যে, তা নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু কুমিল্লাবাসী হিসেবে আলী আকবর খানকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। ১৯১৪ সালে দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির ছেলে আলী আকবর খান বি,এ পাশ করেছেন, বাড়িতে দালানকোঠা, পুকুরে শানবাঁধানো ঘাট। প্রভাব প্রাতপত্তিও কম নয়। এই আলী আকবর খান যে উদ্দেশ্যেই হোক কাজী নজরুল ইসলামকে তখন (১৯২১) কুমিল্লায় না নিয়ে আসলে আজ আমাদের গৌরব-অহংকারের সামান্যতম উচ্ছ্বাস থাকতো কি? আমরা কি ব্যক্তি নজরুলকে এভাবে স্পর্শ করতে পারতাম? নজরুলের জীবনের স্বর্ণালী ঘটনাপ্রবাহ কি কুমিল্লার প্রভাবে তেমনভাবে বিকশিত হতো? এজন্য অবশ্যই আলী আকবর খান আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রাপ্তির দাবিদার। তিনি যদি সেসময় নজরুলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে না আনতেন, তাহলে কোনোদিন নজরুল কি কুমিল্লায় আসতেন? এটাই নিয়তি বা ভবিতব্য। সুতরাং আমরা মুজফফর আহমদের মতো আলী আকবর খানকে তেমনভাবে মূল্যায়ন করতে চাই না। নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় আসার যোগসূত্র হলো আলী আকবর খান, তাঁর মধ্যে সেই কবির কুমিল্লার জীবনের পর্ব, যা তাঁর সামাগ্রিক জীবন গঠনের ভিত্তি। কারণ, বিকশিত নজরুল কুমিল্লার নিরবিচ্ছিন্ন দান। কুমিল্লাকে বাদ দিলে নজরুল জীবনী অসম্পূর্ণ বা খ-িত। এই ইতিহাসের সূত্রধর অবশ্যই আলী আকবর খান। ত্রিশালের কাজীর সিমলার দারোগা কাজী রফিউল্লাহ-র সন্তানদের মতো আলী আকবর খানকে কুমিল্লাবাসী উপেক্ষা করবে না বলে আমার বিশ্বাস।
    কাজেই নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমন উপলক্ষ্যে যে অনুষ্ঠান হবে, এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাৎ যাঁর যতটুকু প্রাপ্য, তাঁকে সে সম্মান দিতে হবেই। এই প্রত্যাশায় আমার কিছুকথা।

[তৃতীয় পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]