
খালেদ মহিউদ্দিন ||
১৯৯৯
সালের ডিসেম্বর। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল এর সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও
বাধ্যবাধকতা নিয়ে একটি স্টোরি করব বলে একমাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আইনমন্ত্রীর মন্তব্য দরকার। বিষয়টা সরকারেরর জন্য একটু বিব্রতকর বলে মন্ত্রীকে পাই না তো পাই ই না।
অবশেষে
তার ব্যক্তিগত সহকারি মারফত জানলাম, মন্ত্রী আমাকে সময় দিয়েছেন শুক্রবার
সকাল পাঁচটায়। এইদিন তিনি তার কুমিল্লার বাড়িতে যাবেন। আমি ইচ্ছে করলে তার
সঙ্গে যেতে পারি, বিকেলে তিনি ফিরবেন। আসা যাওয়ার পথে তাকে ইন্টারভিউ করা
যাবে।
আমার দরকার একটামাত্র কোট, তার জন্য ছুটির দিনের ছয় থেকে আট
ঘণ্টা মাটি করব? ভাবলাম যা আছে কপালে! মন্ত্রী আমার সঙ্গে খেলছেন আমিও তার
সঙ্গে খেলি।
চারটা ৫৫ মিনিটে মন্ত্রীর বাসায় হাজির হলাম। মন্ত্রীর
এপিএস মাহবুব ভাই ছাড়া কাউকে চিনি না। তিনি অপো করতে বললেন। মন্ত্রী সোয়া
পাঁচটায় নামলেন। আমাকে দেখে অবাকই হলেন মনে হয়, সত্যি সত্যি ভোর পাঁচটায়
আসব বোধহয় ভাবেন নাই। তার গাড়িতে পাশাপাশি বসে রওনা হলাম কুমিল্লা।
পতাকার
গাড়ি কাঁচপুর ধরতেই, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল জানতে চাইলাম। কড়া
প্রস্তুতি ছিল আমার, উনি ডান বাম করতে চাইলেও মন্তব্য করতে একরকম বাধ্য
করলাম তাকে। গাড়ি ছুটছে, মন্ত্রী একটু চুপ মেরে গেলেন। আমার রিপোর্ট হয়ে
গেছে। আমি ফুরফুরে মেজাজে ঢাকার ধূসর পেছনে রেখে সবুজে ডুবে গেলাম জানালায়
চোখ রেখে।
সাংবাদিক সাহেব আপনার বয়স কত? জ্বি ২৫। আইনমন্ত্রী আরও গম্ভীর
হয়ে গেলেন। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নিয়ে তার মন্তব্য তাকে কতখানি
ভোগাবে তাই ভাবছিলেন বোধ হয়।
অনেকণ পর নিজেরে সামলে নিলেন, জানতে চাইলেন কী খাব দুপুরে? পুকুর থেকে ধরা তাজা মাছ দিয়ে মাসকলাই এর ডাল আর ভাত খাব।
এতণে
তার মুখ হাসি হাসি হয়ে উঠল। বললেন উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু যাইতেছে মন্ত্রী
ওরা কী আর ডালভাত খাওয়াবে? দেখি তবুও। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে ডিসির
কাছে জানতে চাইলেন, দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কি? উত্তেজিত ডিসি মহোদয় পোলাও
কোর্মা আর রোস্টের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, মন্ত্রী বললেন, একজন বাচ্চা
জার্নালিস্ট আজকে আমার মেহমান। সে মাসকলাই এর ডাল আর ভাত খেতে চায়। আমি
তারে কথা দিয়ে ফেলছি। আপনারা জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পোলাও কোর্মা খান।
আমার আর তরুণ জার্নালিস্টের জন্য ডাল আর ভাত।
খিদে জিইয়ে রাখার জন্য
সকাল থেকে আর কিছু খাইনি। জুমার আগেই দুপুরের খাবার দেওয়া হল। কুমিল্লার
মানুষ সাী থাকল এক অদ্ভুত দৃশ্যের। সবাই খায় তিন চার পদের মাংস বড় মাছ।
মন্ত্রী আর ছোট এক সাংবাদিক খায় ডালভাত। ফেরার সময় তার সঙ্গে খাওয়া নিয়ে
বেশ হাসাহাসি হল।
মন্ত্রী বললেন, আমার কল্যাণে তার ফেভারিট ডিশ খাওয়া
হল। জানতে চাইলেন, আমার গ্রামের বাড়ি কই। ইনসিডেন্টালি আমরা তখন আমার
দাদাবাড়ি পার হচ্ছি। বললাম। তিনি সবিস্ময়ে বললেন এতণ বল নাই কেন? আমি
হাসলাম।
ওই ট্রিপ থেকে ফিরে আমার লিড স্টোরি নামল। সংসদের ভেতরে বাইরে
তা নিয়ে কথা হল। সমালোচনার মুখে চুপ করে থাকলেন আইনমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠজনেরা
বললেন তার বিস্ময় নাকি আকাশ স্পর্শ করল যখন সপ্তাহ না ঘুরতে তিনি দেখলেন
তারে নিয়া আমি প্রথম আলোর কমিক সাপ্লিমেন্ট আলপিনে একটা কাভার স্টোরি
লিখেছি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একদিন শিরোনামের ওই লেখায় দেখিয়েছি তিনি কেমন
ফানি ক্যারেক্টার। তার মন্ত্রণালয়ের অনেকে হারেরেরে করে উঠলেও তিনি ছিলেন
স্বাভাবিক। শুধু বললেন, ছেলেটা মনে হয় ভাল।
আরও অসংখ্যবার তার পেছনে লেগেছি আমি, টকশোতে বিব্রত করেছি কত বার! কত লোকে কত কথা বলেছে, তিনি কিন্তু বলেছেন, ছেলেটা মনে হয় ভাল।
খসরু ভাই, ২২ বছর ধরে আমার আপনজন, আপনার জন্য আমার খারাপ লাগতেছে!