
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের তিনটি তারিখ খুবই উল্লেখযোগ্য। তারিখগুলো হলো- ৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন- স্বাধীনতার ঘোষণায় বলেছিলেন-
‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
১৬ই ডিসেম্বর দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর, ত্রিশলক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি গেয়ে ওঠে-
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
আজ ২০২১ সালের ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। একই সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলতে চাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর দু’টি বড় ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১. বাংলার মুসলমানদের বুঝাতে সক্ষম হলেন যে-তারা যতটা না মুসলমান তার চেয়ে রাজনৈতিক জাতিসত্তা বিবেচনায় তারা বাঙালি।
২. বাঙালি জাতিসত্তার স্বাতন্ত্রিক অস্তিত্ব রক্ষা ও স্বীকৃতিলাভের জন্য কৌশলগত কারণে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধিকার অর্জন ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য সোচ্চার হন। একদিকে নিজের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে তেমনভাবে প্রশিক্ষিত করে তুললেন, অপর দিকে বাঙালির স্বার্থ সংরক্ষণে ৬-দফা জাতির কাছে পেশ করলেন। এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্যত স্বায়ত্তশাসনের কথাই বলা হতো।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভাষায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তখন স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসন এই শব্দ দু’টো একটি রূপকল্প আকৃতি লাভ করতে থাকে, এবং ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখালেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখালে তো হবে না, তার বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতির দরকার। তাই উত্তাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।’
স্বাধিকার হল -স্ব+অধিকার অর্থাৎ নিজের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন হলো নিজেকে শাসন করা। এবং পরবর্তী অভিযাত্রা হলো স্বাধীনতা- স্ব+অধীনতা অর্থাৎ নিজের বা নিজেদের অধীনে থাকা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রথমে স্বাধিকার, পরে স্বায়ত্তশাসন এবং অবশেষে স্বাধীনতা এই পরিক্রমায় আমাদেরকে প্রস্তুত করেছিলেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফ্যারল্যা- পরিষ্কারভাবে বুঝে যায়-বাঙালিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। কারণ, বাঙালি জাতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অটল ও যে কোনো নির্দেশনা প্রতিপালনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এই অচলায়তনকে ভাঙার জন্য অবশিষ্ট কোনো কৌশল প্রয়োগের পথ রুদ্ধ। সুতরাং বাংলাদেশে গণহত্যাই বাঙালিদের শায়েস্তা করার একমাত্র পথ। কারণ, শেখ মুজিবুরের কাছে স্বাধীনতার বিকল্প আর কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলার উত্তাল জনতা ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির মতো এখন উত্তাল। কোনো যুক্তিই এখন আর তাদের রুখতে পারবে না। তাই জ্যাকসনের মতো অভিজ্ঞ গণহত্যার নীলনকশা প্রস্তুতকারীকে দিয়ে তৈরি করল অপারেশন সার্চলাইট। বাঙালি নিধনযজ্ঞ। সহায়তাকারী-সিআইএ বিশ্লেষক ও হ্যারল্ড স্যা-ার্স জোসেফ শিসকো যিনি নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি এবং উইলিয়াম ফার্গো। জ্যাকসনের ছিল পূর্ব-অভিজ্ঞতা ভিয়েতনাম-ব্রাজিলে হত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা সরবরাহের মাধ্যম। তারা একাত্তরে ঢাকাতেই অবস্থান করছিল। সামরিক জান্তার সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করেছিল।
২২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বললেন-‘জয় আমাদের হবেই। আমরা ন্যায়ের পথে লড়াই করছি।’ ওইদিন রাতে ঢাকায় প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে প্রেসনোটে ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন ডাকা হয়েছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হলো।
এ প্রসঙ্গে পেছনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই-
১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞার বাসায় রাতে বঙ্গবন্ধু আসলেন। একজন ছেলের মাধ্যমে গোপনে ভারতীয় দূতাবাসের কূটনীতিক শশাঙ্ক এস বানার্জিকে ডেকে পাঠানো হলো। তাঁদের মধ্যে দু’ঘন্টা মিটিং হয়। শশাঙ্ক এস বানার্জি লিখেছেন-‘এই মিটিং তলবের উদ্দেশ্য আমার হাতে একটি অতি গোপনীয় চিঠি দেয়া হয় যা কূটনৈতিক ব্যাগে পুরে আমাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর (নেহেরুর) হাতে তুলে দিতে হবে।’
এ চিঠি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছিল এবং জবাবও দেয়া হয়েছিল। চিঠির জবাবে লেখা ছিল-
‘মুজিবের জন্য একটি মাত্র চ্যানেল ব্যবহার করে কাজ করাটা ভালো হবে আর তা হলো ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশন, আগরতলা নয়।’
উল্লেখ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চিঠির উত্তর পেতে দেরি হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
শেখ মুজিব নেহেরুকে যে চিঠি লিখেন তার প্রেক্ষিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ঠিক ঐ সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য অনুকূলে নয়। সে সময়ে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করাও ভারতের পক্ষে নয়। কাজেই মুজিব যদি কার্যকরিভাবে ভারতের সাহায্য প্রত্যাশা করেন তবে তাঁকে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এজন্য দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত সমর্থন দেবার সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেয়া হয়। নেহেরু বুঝতে পেরেছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান একজন জাদুকরী গণনেতা। তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শও আছে। এবং সনাতন ডানপন্থী পাকিস্তানি ধর্মীয় চরমপন্থা ও হিংসাত্মক মৌলবাদ শেখ মুজিব বয়ে নিয়ে বেড়ান না। সেজন্য তাঁকে সবসময় নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে রুখে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শেখ মুজিবকে পরামর্শ দেয়া হয় যে, তিনি গণতন্ত্রের কথা বলছেন তখন তার কয়েক বছর গণমানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মুক্তির পথে অসংখ্য চড়াই-উতরাই থাকবে। সে সব বাধা অতিক্রম করে রাজনৈতিক পদক্ষেপের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারলেই নিজেকে মুক্তির যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন।
আরো পরামর্শ দেয়া হয় যে, সমাবেশে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়ে তাঁর কথা শুনতে আসে তখনই বিশ্ব তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সত্যিকারের জননেতা বলে মেনে নিবে। তাঁর বাক্য বিন্যাসের ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিজ দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতির জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করতে হবে। বিপুল সংখ্যক গণসমর্থন তৈরি হবার পর ভারত পূর্ণাঙ্গ কৌশলগত সমর্থন দেবার জন্য তৈরি থাকবে। এক্ষেত্রে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরির দায়িত্ব শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে, অন্য কারো নয়। শেখ মুজিব ভারত প্রণীত পরামর্শগুলো মানতে রাজি হয়েছিলেন এবং লক্ষ্য অর্জনে ‘১৯৬৩-১৯৭১ এ সাত বছরের একটু বেশি সময় পরেই মুক্তির আন্দোলন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছিল।
ঢাকায় যখন ওই অবস্থা চলছে, তখন ২২ মার্চ সন্ধ্যায় (১৯৭১) কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংসে একটি দৃশ্য দেখা গেল। দেখা গেল-দ্রুত একটি পুলিশের গাড়ির পেছনে বাংলা ভাষায় নম্বর প্লেটে ‘ঢাকা’ লেখা একটি গাড়ি রাইটার্সের পোর্টিকোতে ঢুকল। গাড়ি থেকে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের লোকেরা তাঁকে স্যালুট দিয়ে ভিআইপি লিফটে নিয়ে গেল। তিনি কে? তিনি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার কৈলাসচন্দ্র সেনগুপ্ত। ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সরাসরি চিফ সেক্রেটারি নির্মল সেনগুপ্তের ঘরে ঢুকে গেলেন। মিনিট পনেরো পর কৈলাসবাবু বেরিয়ে এলেন। সেখানে সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত উপস্থিত ছিলেন এবং একজন সংবাদকর্মী হিসেবে অনুসন্ধানী হয়ে তৎপর হলেন। তিনি কৈলাসবাবুকে চিনতেন। কৈলাসবাবু একসময় United Press of India নামে একটি নিউজ এজেন্সিতে রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কৈলাসবাবু চিফ সেক্রেটারির কক্ষ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত নিজের পরিচয় দিলেন।
‘তিনি একটু সময় ভ্রু কুচকে আমাকে দেখে বললেন, আমিও তোমাকে চিনেছি.. তবে নাম ভুলে গিয়েছি। আমি (সুখরঞ্জনবাবু) সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন করলাম, ‘ঢাকার আলোচনা কি শেখ মুজিবের পক্ষে যাবে কিংবা রক্তক্ষয়ী পরিণতি?’
তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘দ্বিতীয়টি.... আর কোনো প্রশ্ন নয় এবং তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি বুঝলে...।’
এই কথা শেষ হতে না হতেই চিফ সেক্রেটারি নির্মল সেনগুপ্ত বেরিয়ে এসে ডেপুটি হাইকমিশনারকে নিয়ে দমদম বিমান ঘাটিতে ছুটলেন। সেদিন দিল্লিগামী বিমানটি প্রায় ৪০ মিনিট দেরি হয়েছিল আকাশে উড়তে। পশ্চিমবাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারকে দিল্লিগামী বিমানে তুলে দিয়ে এলেন।
দিল্লির পালাম বিমানঘাঁটিতে বিমান পৌঁছার পর পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিসাররা ডেপুটি হাইকমিশনার কৈলাস সেনগুপ্তকে সোজা নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতে। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের দুই সেক্রেটারি এবং গোয়েন্দা দপ্তরের উচ্চপদস্থ অফিসাররাও গম্ভীর মুখে সেখানে উপস্থিত। ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার ওই অফিসারদের সামনেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। কৈলাসবাবু জানান যে পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে পূর্বপাকিস্তান জুড়ে সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে-তাও জানান।
২৩ মার্চ ১৯৭১ সকালে দিল্লির বিমান দমদমে নামল। বিমান থেকে নামলেন কৈলাস সেনগুপ্ত। তাঁকে ঐদিনই ঢাকায় ফিরতে হবে। পুলিশ প্রহরায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত দমদম বিমানঘাঁটিতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন-
‘হাইকমিশনের গাড়ি এগিয়ে আসতেই তিনি গাড়িতে উঠতে উঠতে আমাকে জানালেন যে, সন্ধ্যার আগেই তিনি সীমান্ত পেরিয়ে যশোর হয়ে ঢাকায় পৌঁছতে চান।’
এদিকে ২৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্স ময়দানে পরিষ্কার ঘোষণা করলেন যে, তিনি কখনো ‘ছয় দফা’ দাবি থেকে সরে আসবেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিও ছাড়বেন না। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন-
‘তোমাদের সৈন্যেরা যদি আমার বাংলাদেশের মানুষের ওপর গুলি চালায়-যদি আমাদের মা-বোনদের গায়ে হাত দেয়, তাহলে এই লড়াই হবে মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি তিনি এই প্রথম উচ্চারণ করলেন।
২৪ মার্চ মধ্যরাতের পর ২৫ মার্চ (১৯৭১) তারিখটি যখন ক্যালেন্ডারে এসে গেল, তখনকার ও পরবর্তী ইতিহাস এই উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষের জানা।
২৬ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বলেন ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এখানে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন করা যে স্বাধীনতা একজনই ঘোষণা দেন এবং অনেকেই বার বার পাঠ করেন বা করতে পারেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই ২৬ ও ২৭ মার্চ দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দুটি বৈঠকে ‘প্রয়োজনে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ‘স্বাধীনতা’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের’ প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বলা হয়-
‘we not only sacrifice ourselves to protect over own freedom but also to achieve freedom to others|’
আমরা জানি, আবার জানিও না। জানলে লাভ কি, ক্ষতি কি-এ হিসাবও স্বাধীনতার প্রাপ্তির পঞ্চাশ বছরেও অনেকে বুঝে উঠতে পারেননি। ভাবি-আমরাই মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের গৌরবদীপ্ত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু সাথে সাথে যারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন, ৩০ লক্ষ প্রাণের রক্তদানের ঋণের সঙ্গে সাড়ে এগারো হাজার ভারতীয় সৈন্যদের আত্মত্যাগের কথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে। পরদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই আত্মদান নিশ্চয়ই অনন্য গৌরবের।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে নাক না গলানোর যে আবদার করেছেন, তার জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন-
‘ÔYes Mr. Nixon, We know very well that East Pakistan issuse is an internal matter of Pakistan. But You don’t know that India bears records of Civilization for centuries. when innocent people are being killed indiscriminately at our next door, India can’t remain as a silent spectator’
আমরা সময়ের স্বাভাবিক ¯্রােতে ইতিহাসকেও ভুলে গেছি। সেজন্য ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। এখনও অনেকে ধারণা পোষণ করেন-বাংলাদেশ শুধুমাত্র মুসলমানদের মাতৃভূমি, হিন্দুরা ভারতে চলে গেলে ভালো হয় এবং তাদেরকে তাড়ানোর জন্য সরকারি দলের লোক ও বিরোধীদলের বান্ধবরা একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। তা অবশ্য সম্ভব হবে না, কিন্তু যন্ত্রণাটাও শেষ হবার কোনো ইতিবাচক আভাস দেখতে পাই না। কষ্ট হয়।
১৯৭১ সালে ডিসেম্বর ৬ তারিখ ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে চীন বলেছে-ভারত সম্প্রসারণবাদী। আমেরিকা বলেছে-ভারতকে দেয় সাহায্যের মোটা অংশ কেটে দিচ্ছি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী তাৎক্ষণিক বললেন-
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, সবিনয়ে বলছি-ঠিকই বলেছেন, আমরা সম্প্রসারণবাদী, তবে আমাদের লোভ সা¤্রাজ্যের নয়, মানুষের মুক্তির সা¤্রাজ্যের।’
প্রেসিডেণ্ট নিক্সনকে বললেন-
‘মাননীয় প্রেসিডেণ্ট নিক্সন, আপনাকেও বলছি, যদি ভেবে থাকেন, আপনার সাহায্য দিয়ে আপনি আমাদের স্বাধীনতাকে ক্রয় করবেন, তবে ভুল করেছেন। লিঙ্কন, জেফারসনের দেশকে যদি আজ বোঝাতে হয়, টাকা দিয়ে জঙ্গিশাহিকে কেনা গেলেও স্বাধীনতাকে কেনা যায় না, তবে তার চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে। আমরা আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই, ভয় দেখিয়ে, লজেন্স দিয়ে কিছুদিন খোকাকে বশ করা গেলেও, সে যখন বয়োপ্রাপ্ত হয়, তখন সে সঙ্গিধারী, স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে ওঠে, ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই-ই তার ধর্ম হয়। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের তেজোদ্দীপ্ত সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা নিজেকে, নিজের শক্তিকে জেনেছি। তাই আজ গলা ফাটিয়ে এ কথা বলবার যোগ্যতা অর্জন করেছি, শক্ররা সব শোনো। এ দেশ আমার গর্ব, এ মাটি আমার কাছে সোনা।’
(৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, আকাশবাণী সংবাদ পরিক্রমা। পাঠক-দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।)
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আকাশবাণী সংবাদ পরিক্রমায় উচ্চারিত হলো-
‘আমার সংগ্রাম ছিল তোমার জন্য, তোমার সংগ্রাম, তা-ও আমার জন্য। কেন না দুই সংগ্রামের একই প্রাণবিন্দু-স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। ৩৬৩ বছরের পুরোনো নগরী ঢাকা আজ সদ্যোজাত রাষ্ট্রের মুক্ত রাজধানী-একাল ও সেকালকে মিলিয়ে যে-চিরকালের মানবিকতা, তারই প্রতিষ্ঠাভূমি। তোমার সংগ্রাম শেষ, তাই আমারও সংগ্রাম শেষ হলো। সুতরাং আর যুদ্ধ নয়-এবার এ পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করার লড়াই।
সংবাদ পরিক্রমার শেষাংশের বক্তব্য আজও কানে বাজে-
‘এ লড়াইয়েও আমি তুমি একই কাতারে দাঁড়িয়ে লড়ব, লড়ব সমৃদ্ধির জন্য, শান্তির জন্য। লড়ব আমার ভারতের জন্য, লড়ব তোমার সোনার বাংলার জন্য।’
তবে দ্বিধা কেন? দ্বিধা হলো-যদি ধর্মীয় পরিচয়ে জাতিসত্তা মননে ধারণ করলে। দ্বিধাহীন হতে হলে অবশ্যই বাঙালি জাতিসত্তা মননে যাপন করতে হবে। তাতে লাভ? লাভ হলো-বাঙালি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশের মধ্যে আমরা মুসলমানবাঙালি, হিন্দু বাঙালি ইত্যাদি ঠুনকো পরিচয়ে গৌরববোধ করি। কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের গ-ি পেরোলে বিদেশিদের কাছে আমরা শুধুই বাঙালি। এ শিক্ষা বঙ্গবন্ধু আমাদের ধমনিতে জাড়িত করে গেছেন। এটাই রাজনীতির সহজপাঠ, প্রাজ্ঞ উচ্চারণ।
এই হোক এবারের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ও জাতীয় দিবসের অঙ্গীকার। জয় বাংলা।
তথ্য সূত্র:
১. একাত্তরের ‘জাগ্রত বাংলা-এস এ কালাম
২. সময় ও স্বপ্নের যৌথ শিল্প একাত্তরের ‘সংবাদ পরিক্রমা’-প্রণবেশ সেন
৩. ভাঙা পথে রাঙা ধুলোয় বাংলাদেশের জন্ম-সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত।