
প্রভাষ আমিন ।।
অবশেষে টনক নড়েছে সরকারের। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যে সুনামি হয়ে সবকিছু ভাসিয়ে নিতে পারে, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল সপ্তাহ দুয়েক ধরেই। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতর ১২ দফা সুপারিশ করেছিল আরও আগেই। কিন্তু সুপারিশ মানা তো দূরের কথা, শোনারও সময় ছিল না কারও। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই রাশ টানা দরকার ছিল। ২৯ মার্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু চারদিকে সবকিছু কেমন স্বাভাবিক। গত বছর ঠিক এই সময়ে করোনার আতঙ্কে বন্দি ছিলেন সবাই। সাধারণ ছুটিতে সবাই ছিলেন ঘরে। রাস্তাঘাটে ছিল সুনসান নীরবতা। কিন্তু এক বছর পর সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন রাস্তার দিকে তাকালে মনে হতে পারে দেশে করোনা বলে কিছু নেই। সবাই যেন করোনা জয় করে ফেলেছেন। তবে দেরিতে হলেও সরকার সংক্রমণের রেকর্ডের দিনেই ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় নতুন কিছু নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু মানুষ সেই নির্দেশনা কতটা মানবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে এখনও।
করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি কাটিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সাধারণ ছুটির সময়ও মানুষ সব নিয়ম মানেনি। আর এখন তো সবার ভাব দেখে মনে হয়, করোনা তেমন কিছু নয়, সাধারণ ইনফুয়েঞ্জা মাত্র। এটা ঠিক, করোনা থেকে রা পাওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি জীবিকার চিন্তাও জরুরি। তবে মনে রাখতে হবে, শেষ পর্যন্ত জীবনই সবচেয়ে মূল্যবান। তাই জীবন এবং জীবিকার ভারসাম্যটা খুবই জরুরি। তবে মনে রাখতে হবে, জীবিকার জন্য ব্যস্ত হতে গিয়ে যেন জীবনটা ঝুঁকিতে পড়ে না যায়।
সংক্রমণ যেদিন রেকর্ড গড়লো, সেদিনই সরকারের জারি করা ১৮ দফা নির্দেশনার ভাষা ছিল অনেকটাই নমনীয়। বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, সরকার যত কঠোর নির্দেশনাই দিক, মাঠপর্যায়ে যেতে যেতে তা অনেকটাই শিথিল হয়ে যায়। এখন সরকারই যদি নমনীয় থাকে, তাহলে এসব নির্দেশনার সুফল পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে যাবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে, এটা সবাই জানে। কিন্তু সেনানিবাসের ভেতরে সবাই অরে অরে মেনে চললেও বাইরে বেরুলে সবাই রাস্তার রাজা বনে যায়। তাই নিয়ম মানাতে হলে কঠোর হতে হবে। সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনায় ‘নিরুৎসাহিত করতে হবে’, ‘নিশ্চিত করতে হবে’, ‘গ্রহণ করতে হবে’ ধরনের ঐচ্ছিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। করোনার এখন যা অবস্থা এবং সামনে যে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তাতে এমন সফট নির্দেশনায় কাজ হবে বলে মনে হয় না। কঠোর হতে হবে। বেসিক নিয়মগুলো কঠোরভাবে পালন করলে, লকডাউন না দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। করোনা থেকে বাঁচার বেসিক নিয়মগুলো কিন্তু সবার জানা। করোনাভাইরাস যাতে আপনার শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সব সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বারবার হাত ধুতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। ব্যক্তি হিসেবে আপনার দায়িত্ব এটুকুই। এটা মেনে চলতে পারলে আপনি অনেকটাই নিরাপদ। সরকার নির্দেশনা জারি করুক আর না করুক, এটুকু সাবধানতা কিন্তু আপনার নিজের জন্য। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন,আপনি কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন?
করোনার সংক্রমণ যখন রেকর্ড গড়েছে, তখন বাংলাদেশে সবকিছু চলছে একদম স্বাভাবিক নিয়মে। নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার যে তাগিদ ছিল, তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নির্বাচন, প্রতিবাদ, আন্দোলন, হরতাল, মারামারি, বিয়ে-শাদি, বইমেলা সবই চলছে। সরকারি নির্দেশনার শুরুতেই আছে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জনসমাগম সীমিত করতে হবে। বিয়ে-জন্মদিন উপলে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। এখন এই ‘সীমিত করার’ মানে কী? কতজন সমবেত হতে পারবে? নিরুৎসাহিত করা মানে কী? করলে কী হবে? পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, সিনেমা হল, থিয়েটারে জনসমাগম সীমিত করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সীমিত করার ব্যাখ্যা নেই। সব ধরনের মেলা নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হলেও বইমেলা চলছে। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি এবং ৫০ ভাগের বেশি যাত্রী পরিবহন না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যে কঠিন, তা আমরা আগেও দেখেছি। কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশনের ধারণা এখন নামকাওয়াস্তে প্রতিপালন করা হচ্ছে। বিদেশ ফেরত লোকজন কাগজে-কলমে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময়ও ঘটা করে বিয়ে করছেন। কোয়ারেন্টিনে থাকা লোকজন হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ৫০ ভাগ জনবল দিয়ে অফিস পরিচালনার কথা বলা হলেও বেসরকারি অফিসে তা কে মনিটর করবে? অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা, আড্ডা বন্ধ করা এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ছুটির সময়ও আমরা দেখেছি, কিছু লোক অপ্রয়োজনে রাস্তায় বেরিয়েছে। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আপাতত ছুটি ২২ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই পুরো সময়টা খোলা আছে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো। আর এই কওমি মাদ্রাসার শিার্থীদের সামনে রেখে গত কয়েক দিন হেফাজতে ইসলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে যে অরাজকতা কায়েম করেছে, তা নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে?
সব নির্দেশনা ধরে ধরে ব্যাখ্যা করলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। মোদ্দা কথা হলো,সরকারের যে নির্দেশনা তা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। ‘সীমিত করা’ ‘নিরুৎসাহিত করা’র মতো নরম সুরে কাজ হবে না। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যই আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। লকডাউন তো বাংলাদেশে কখনও হয়নি, আবার সাধারণ ছুটিও হয়তো লাগবে না; যদি আমরা সরকারের নির্দেশনা অরে অরে মেনে চলি। যারা মানবে না, ঝুঁকিটা শুধু তাদের নয়। করোনায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তাটা যেমন জরুরি, সামষ্টিক নিরাপত্তাটা তারচেয়ে বেশি জরুরি। আপনি সব নিয়ম-কানুন মেনে চললেন, কিন্তু আপনার ড্রাইভার আপনার জন্য করোনাভাইরাস নিয়ে আসতে পারে। তাই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে শুরুটা করতে হবে, ব্যক্তি থেকেই আসবে সমষ্টি। কেউ যেন মাস্ক ছাড়া ঘর থেকে বেরুতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ‘নো মাস্ক,নো সার্ভিস’ থেকে এখন সময় এসেছে ‘নো মাস্ক,নো মুভমেন্ট’ নিশ্চিত করার। যেখানে জনসমাগম, সেখানেই পুলিশি হস্তপে করতে হবে। অফিসে অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিশ্চিত করতে হবে।
পাবলিক প্লেসে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নইলে কিন্তু মুক্তি নেই। তাই সরকারের নির্দেশনা আরও পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে হবে। নির্দেশনা প্রতিপালনে কঠোর পদপে নিতে হবে। প্রয়োজনে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
লুডু খেলা আপনারা সবাই জানেন। লুডুতে মই বেয়ে উপরে ওঠার সুযোগ যেমন আছে। আবার সাপের মুখে পড়লে পতনও অনিবার্য। গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরুর দিকে নানান অব্যবস্থাপনা থাকলেও বাংলাদেশ দ্রুতই তা সামলে নেয়। শেষদিকে বরং করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিতই হয়েছে। কিন্তু কিছুটা খামখেয়ালিপনা, কিছুটা ঢিলেমিতে সেই প্রশংসা এখন উবে গেছে। লুডু খেলার মতো নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে আমরা সাপের মুখে পড়েছি। আমাদের আবার সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। সতর্ক না থাকলে করোনার সাপ আবারও আমাদের সব অর্জন গিলে খেতে পারে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ