জ্ঞানময়ীর আগমন তিথিতে পুষ্পার্ঘ্য
Published : Wednesday, 17 February, 2021 at 12:00 AM
কালিদাস ভক্ত ।।
শীতের বিদায় আর বসন্তের আগমনের এই সন্ধিণে জ্ঞানময়ীর বন্দনায় মগ্ন হবে গোটা পৃথিবীর সনাতন সম্প্রদায়। জ্ঞানময়ীর আগমন তিথিতে প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত। গাঁদা, ডালিয়া, পলাশ, কুন্দসহ নানা ফুলের ঘ্রাণে প্রকৃতি আমোদিত। নিশ্চয়ই শুকা পঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে শ্বেতশুভ্র কল্যাণময়ী বিদ্যাদেবীর আবাহন লাগি এই পুষ্পরাজি প্রস্ফুটিত। ঘণ্টা কাঁসর আর শঙ্খনিনাদে মুখরিত হয়ে উঠবে পূজাম-পগুলো। উষালগ্ন থেকেই আনন্দালোকে-মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত ধূপধুনার গন্ধে মাতোয়ারা ধরণিতে বেজে উঠবে শান্তির মোহনীয় সুর। ব্রাহ্মমুহূর্তে, আবাহন সম্পন্ন হয় দেবীর, শঙ্খে শঙ্খে মহিমাময় সুরে। রাজহংস সমভিব্যাহারে দেবী আসছেন। আমরা রোমাঞ্চিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা-ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি লয়ে তাঁর শ্রীচরণ দর্শনের প্রত্যাশায় অপেমাণ। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে আজ অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতি উদ্ভাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর সেই আগমনী বার্তা নিনাদিত হচ্ছে অনিলে, সলিলে, নভোনীলে। এবার বৈশ্বিক মহামারি করোনার জন্য বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় পূজা আগের বছরগুলোর মতো বিদ্যালয়ে হচ্ছে না, তবে পারিবারিকভাবে গৃহে গৃহে বিদ্যার্থীরা, পূজারিরা সাধ্যমতো আরাধ্য দেবীর বন্দনা করবে। সরস্বতী বৈদিক দেবী। পৌরাণিক যুগ থেকে দেবীর বিগ্রহ আমরা পাই। আদি যুগ থেকেই সরস্বতীর বন্দনা করা হয়। অগ্নি প্রজ্বলিত করে, বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁর কাছে ভক্তপ্রাণের মঙ্গল আরতি। ঈশ্বর যে শক্তিরূপে জ্ঞানকে প্রকাশ করেন, তাঁর নামই দেবী সরস্বতী। বেদে সরস্বতী দেবীর যে উল্লেখ আছে, সেখানে তিনি নদী স্বরূপা। পুরাণে সরস্বতী দেবীর যে বিস্তৃত বর্ণনা আছে তাতে তিনি বিদ্যা, সংগীত, নাট্যকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য—সব ধরনের সৃষ্টিশীল বা সুকুমার শিল্প এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দেবী। তিনি আমাদের সব ধরনের জ্ঞান দান করেন। সরস্বতী দেবীর গায়ের রং শুক বা শুভ্র। শুক তাঁর বসন। সরস্বতী দেবী শ্বেতপদ্মের ওপর উপবিষ্ট থাকেন। তাঁর হাতে পুস্তক ও বীণা। বীণা হাতে থাকে বলে সরস্বতী দেবীর আরেক নাম বীণাপাণি। তাঁর বাহন শ্বেত রাজহংস। সব কিছু মিলে সরস্বতী দেবী সর্বশুকা। শুকপরে পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী দেবীর পূজা করা হয় বলে এই পঞ্চমী তিথিকে শ্রীপঞ্চমী তিথি বলা হয়। দুর্গাপূজার সময়ও সরস্বতী পূজা করা হয়। সরস্বতী বিশেষভাবে বিদ্যার্থীদের উপাস্য দেবী। তিনি শিল্পকলার দেবীরূপে কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পীসহ কলাকারদের দ্বারা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হন। তিনি সর্বশুকা, শুচিতা ও পবিত্রতার প্রতীক, তাই যে জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকেও মনে-প্রাণে শুদ্ধ ও পবিত্র হতে হয়। নইলে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করা যায় না। সরস্বতীর বাহন রাজহাঁসকে জল আর দুধ মিশিয়ে দিলে, দুধ গ্রহণ করে জল ত্যাগ করে। জ্ঞানী তেমনি জ্ঞানের জগৎ থেকে অসার বস্তু বাদ দিয়ে সার গ্রহণ করেন। সরস্বতী দেবীকে বলা হয়েছে ‘জাড্যাপহা’। জাড্য মানে জড়তা। এখানে জাড্য মানে মূর্খতা। অপহা মানে অপনাশকারিণী। সরস্বতী দেবী আমাদের মূর্খতা দূর করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সরস্বতীকে নিয়ে অনেক কাহিনি ও উপাখ্যান রয়েছে। নৈষধচরিত মহাকাব্যে দেখা যায় তিনি স্বয়ং ভীমরাজের রাজসভায় একজন প্রতিভাদীপ্ত উপস্থাপিকা। এমনি আরো অনেক উপাখ্যানে দেখা যায়, অনেক মূর্খ ব্যক্তিও সরস্বতীর কৃপা লাভ করে বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক-মহাকবি হয়েছেন। তাই আমরা বিদ্যাদেবীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি—তিনি আমাদের অন্তরের ভেতরকার অজ্ঞান শক্তিকে বিনাশ করে শুভশক্তির উদ্বোধন করুন। দেবীর অবির্ভাব তিথিতে এবার বৈশ্বিক মহামারি করোনার জন্য বিদ্যালয়গুলোতে পূজার আয়োজন না হলেও বিদ্যার্থীরা ভক্তিভাবের ডালি সাজিয়ে অন্তরতম প্রদেশ থেকে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করুক। সেই সঙ্গে আমরা যেন সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীতি হয়ে তাঁর সন্তানরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব-আড়ম্বর বড় কথা নয়, আমরা যেন অন্তরে এই বিদ্যাশক্তির উদ্বোধনের মাধ্যমে নিরন্তর ব্যাপৃত রাখতে পারি। মায়ের কাছে প্রার্থনা—হে জ্ঞানময়ী দেবী, তুমি আমাদের অজ্ঞানতা নাশ করে জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করো, অশুভ থেকে শুভ পথে ধাবিত করো, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সর্বজনীনতায় উদ্বুদ্ধ করো, অসত্য থেকে সত্য ও শান্তির পথ প্রকাশিত করো, ঘন আঁধার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো। এভাবে আমাদের সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যোজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ হোক জ্ঞানময়ীর এই মহান আবির্ভাব তিথিতে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়