
ধর্ম
প্রচারে বাংলায় সরাসরি কোনো নবী-রাসুলের আগমণ ঘটে নি। যারা ধর্ম প্রচারে
ভূমিকা রেখেছে তারা ৩৬০ থেকে ১২ আউলিয়াদের কেউ কেউ। ফলে এ অঞ্চলে ধর্ম
প্রচারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে পয়গম্বর, ধর্মযাজক, পীর, আউলিয়া বা
মুসলিম শাসকগণ। এদের একজন গাজী পীর। এসব কাহিনী সরাসরি সেভাবে সাহিত্যে
লিপিবদ্ধ না হলেও তা নিয়ে প্রাচীন বাংলার জনপদে পুঁথি, জারিগান, পালাগান,
বাউল ফকিরদের বন্দনাই ইতিহাসের স্মারক হিসেবে তথ্য বহন করে বেড়ায়। আমাদের
কুমিল্লার জনপদে পঞ্চাশ কিংবা ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষজের মনে এখনো গাজী-কালু
ও চম্পাবতীর কিচ্ছ্া, পুঁথির গল্প বা জনশ্রুতি রয়ে গেছে। যদিও লোককথা আর
রেফারেন্স সব সময় এক তথ্য দেয় না। মানুষ তাঁর শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য
মাঝেমাঝে সাহিত্যের ভাব মিশিয়ে তথ্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে থাকেন।
বাংলাদেশের
দক্ষিণের জেলা ঝিনাইদহের বারোবাজারে গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজার। মাজারের
গা ঘেঁষে আছে ৬টি ছোট বড় বটবৃক্ষ। অনেকেই মানত পূরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন
রঙ্গের পলিথিন সুতোর মতো করে সবচেয়ে প্রাচীন বড় বট গাছে বেঁধে রাখে।
প্রেমিকযুগল তাদের মনোকামনা ছোট ছোট কাগজে লিখে গাছের সাথে বেঁধে দেয়।
চৈত্র, বৈশাখ আর জৈষ্ঠ মাসে এই দরগায় মেলা। যে মেলা পরিণত হয় বহু ধর্ম আর
জাতির মিলন কেন্দ্রে। গাজী-কালু ও চম্পাবতীর বন্দনা কেবলা এখানেই সীমাবদ্ধ
নয়।
সুন্দরবন অঞ্চলে এখানো মৌয়াল বা স্থানীয়দের কাছে গাজী পীর লোকজ
দেবতা হিসেবে পূজিত হন। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে
স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢোকার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর
নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্নলোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে
দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে
গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি,
আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও
গৃহপালিত পশুপাখি কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকেন। গাজীপীরের
বন্দনা করা হয় মূলত সন্তান লাভ, রোগব্যাধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, গো-জাতি
ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরূপ মনস্কামনা পূরণার্থে। এতে মূল গানে প্রথমে
গাজীর প্রশংসা করা হয়,
“পূবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর
এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর
তারপরে বন্দনা করি গাজী দয়াবান
উদ্দেশে জানায় ছালাম হেন্দু মোছলমান।”
বন্দনা
তথা প্রশংসার পরে গাজীর জীবন বৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ,
রোগ-মহামারি, বালা-মুসিবত, খারাপ আত্মার সাথে যুদ্ধ, অকুল সমুদ্রে ঝচ-ঝঞ্ঝা
থেকে রক্ষার কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
ইতিহাসের তথ্যমতে, সুন্দরবন
এলাকার জনপ্রিয় পুঁথি সাহিত্য গাজী কালু চম্পাবতীর প্রধান চরিত্র। আর চম্পা
তার স্ত্রী। যার পিতা ১৪ শতকের প্রথমার্ধের প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়।
যার রাজ্য ছিলো দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাবনা,
ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদীয়া, বর্ধমানের বিস্তৃত এলাকায় দাপটের সঙ্গেই
জমিদারি করেছেন এই ব্রাহ্মণ। তার রাজধানী ছিলো ঝিকরগাছা সদর থেকে দেড় মাইল
দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাউজানিতে। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত
ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়েরই সেনাপতি। মুকুট রায়কে পরাজিত
করে তার রাজ্য ও রাজধানী ছারখার করে তার কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করেন এই
গাজী পীরই। তার প্রকৃত নাম গাজী মিয়া বা বড়খান গাজী। পিতা জাফর খান গাজী বা
শাহ সিকান্দার ছিলেন ত্রিবেনী ও সপ্তগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা। বাল্যকালেই
ফকির-দরবেশের সাহচর্যে আধ্ম্যাতিক সাধনায় উন্নতি লাভ করেন গাজী। পিতার কাছে
শাসন ক্ষমতা নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। ইসলাম প্রচার শুরু করেন দক্ষিণ
বঙ্গের যশোর-খুলনা অঞ্চলে। ধর্ম প্রচারে বাধা প্রাপ্ত হয়ে রাজা মুকুট রায়ের
সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তার। পুঁথি সাহিত্যের তথ্য অনুযায়ী, মুকুট রায়ের
স্ত্রী লীলাবতীর ৭ পুত্র। ১ কন্যা চম্পাবতী বা শুভদ্রা। তার রূপের খ্যাতি
ছিলো জগৎজোড়া। এ নিয়ে পিতার গর্ব ছিলো সীমাহীন। কিন্তু গাজী তার প্রেমে
পড়েন। পুঁথিতে বলা হচ্ছে-
“বিধুমুখী চম্পাবতী কার কাছে আছে বসি
জ্বলিতেছে রূপ যিনি লক্ষকোটি শশী।
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেরিয়া
মূর্চ্ছিত হইয়া গাজী পড়িলো ঢলিয়া”।
কিন্তু
চম্পাবতীর রূপে গাজীর এভাবে চেতনা হারানোর ঘটনাকে অলীক বলেই মনে করেন
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি বইয়ের লেখক মিজানুর
রহমান। তার যুক্তি, পুঁথিতেই আছে, গাজী ছিলেন সংসার বিবাগী মানুষ। তাই তার
রূপ দেখে গাজীর মুর্চ্ছিত হওয়ার কথা নয়। এমনকি চম্পার জন্য তার যুদ্ধে
লিপ্ত হওয়াটাও অস্বাভাবিক। কার্যত মুকুট রায়ের কাল হয় জাতিবিদ্বেষ।
ভাই
কালুকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে পাঠিয়েছিলেন গাজী। কিন্তু
মুকুট রায় তাকে বন্দি করেন। এরই জেরে ঝিকরগাছার লাউজানিতে মুকুট রায়ের
সঙ্গে গাজী পীরের যুদ্ধ হয় ১৩৬৫ সালে। গাজীর দল যুদ্ধে জেতে। মুকুট রায়
সপরিবারে আত্মহত্যা করেন। তার কনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও চম্পাবতী বন্দি হন
গাজী বাহিনীর হাতে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে কামদেব হন পীর ঠাকুর। আর ভক্তদের
অনুরোধে চম্পাকে বিয়ে করেন গাজী। পরবর্তীতে গাজীর নামেই গড়ে ওঠে গাজীর হাট,
গাজীপুর, গাজীর জাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর ঘাট, গাজীর দেউল, গাজীর খাল,
গাজীর ঘুটো ইত্যাদি এলাকা।
গাজী পীর ও চম্পাবতীর কাহিনি শতবর্ষের ধুলো
পেরিয়ে আজও মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছে-মাটির গন্ধে, নদীর নীলে, বনের
নিশ্বাসে। এ কাহিনি কেবল প্রেমের নয়, কেবল ধর্মের নয়- এটি মানুষের ভয়, আশা,
ভরসা ও পরিচয়ের গভীর ঢেউ। সুন্দরবনের দিকে যখনই কেউ পা বাচায়, তখন এই গল্প
নিঃশব্দে হাওয়ার ভেতর ফিসফিস করে-জীবন শুধু শক্তির নয়, হৃদয়েরও লচাই।
লেখক: প্রধান, জনসংযোগ বিভাগ, আশা ইউনিভার্সিটি
লেকচারার, বিসিএস কনফিডেন্স।
