
ব্যাংকিং
খাতে যে কোন দেশের জন্য জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে। শরীরে রক্ত সঞ্চালনের
জন্য শিরা বা ভেইন যেমন প্রয়োজন, অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালনের জন্য ব্যাংকিং
খাত তেমন প্রয়োজন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্প দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর
একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমেই আর্থিক সকল ধরণের
কার্যক্রম সংগঠিত হয়। বাংলাদেশের ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সে
অর্থনীতি গড়ার পিছনে ব্যাংকিং খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ব্যাংকগুলো সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের যোগান দেয়ার পাশাপাশি
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক রেমিট্যান্স
আহরণ, বড় শিল্পের পাশাপাশি গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। ব্যাংকিং খাত দেশের
উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ক) 'সবুজ ব্যাংকিং খ) 'সবুজ অর্থায়ন', গ)
'আর্থিক অন্তর্ভুক্তি' এবং ঘ) 'প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক দায়বদ্ধতা' ধারনার
প্রয়োগের মাধ্যমে জাতিসংঘের 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' অর্জনে ভূমিকা
রাখছে। ব্যাংকিং সুযোগ-সবিধাসমুহ যত সহজলভ্য ও বাধাহীনভাবে এবং দ্রুততরভাবে
নিশ্চিত করা যাবে ততোই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
স্বাধীনতার
পর, বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্প যাত্রা শুরু করে ৬টি জাতীয়করণকৃত বাণিজ্যিক
ব্যাংকের (সোনালী ব্যাংক পিএলসি, জনতা ব্যাংক পিএলসি, অগ্রণী ব্যাংক
পিএলসি, রূপালী ব্যাংক পিএলসি, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড ও বাংলাদেশ
ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি) মাধ্যমে। পরবর্তীতে শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রের
পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ('বাংলাদেশ
কৃষি ব্যাংক', রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক)
প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং তৎকালীন কর্মরত বিদেশী ব্যাংকগুলিকেও পরিচালনার
অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে বেসরকারি ব্যাংকের প্রবেশের মাধ্যমে
ব্যাংকিং শিল্প উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার লাভ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩-২৪ অনুযায়ী বর্তমানে ৬১ টি তফসিলি ব্যাংক বাংলাদেশ
ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ, ১৯৭২ এবং ব্যাংক কোম্পানি
আইন, ১৯৯১ অনুসারে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের
জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে মোট কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ২৬৭
জন। ব্যাংক খাতের মোট কর্মীর মধ্যে ৮৩.২২% পুরুষ ও ১৬.৭৮% নারী । 'গ্লোবাল
ইকোনমি' এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলির মোট সম্পদ ছিল
জিডিপির ৫৯.২%।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন
বাণিজ্যিক ব্যাংক এর পাশাপাশি ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি
বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে
তফসিলি ব্যাংকের পাশাপাশি ৫টি তফসিল-বহির্ভূত ব্যাংক রয়েছে। এগুলো হলো
আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড, গ্রামীণ
ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। স্বাধীনতার পর দেশে
ব্যাংকের মোট শাখা ছিল ১১৯১টি। এখন সারা দেশে ব্যাংকের শাখা ১১২১২ টি।
ব্যাংকের শাখার সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে এটিএম, সিআরএম; এজেন্ট
ব্যাংকিং আউটলেট,; ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এর সংখ্যা ও ব্যবহার।
আর্থিক
প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩-২৪ অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০২৩ শেষে
ব্যাংকিং খাতের মোট সম্পদের শতকরা ৪২.৮ ভাগ, মোট আমানতের শতকরা ২৪.৪ ভাগ
এবং মোট কর্মরত জনবলের শতকরা ২২.৯ ভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এ সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার ১২.৫%
এবং ঋণ ও অগ্রিম হিসেবে প্রদত্ত অর্থায়নের ২০.৫% রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট
সম্পদ ও আমানতের বিবেচনায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এগিয়ে রয়েছে। ২০২৩
সালে ব্যাংকিং খাতের মধ্যে মোট সম্পদের শতকরা ভাগ ৫১.৩, মোট আমানতের শতকরা
৬৮.২ ভাগ এবং মোট কর্মরত জনবলে শতকরা ৬৯.৪ ভাগ বেসরকারি বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলোর আওতাধীন। একইভাবে, বিভিন্ন খাতে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার
শতকরা ৭২.৩ ভাগ এবং মোট বিতরণকৃত ঋণ ও অগ্রিমের শতকরা ৭৩.০ ভাগ বেসরকারি
বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।
বিশেষায়িত ৩টি ব্যাংক
জনগণের আমানত গ্রহণ এবং কৃষি, মৎস্য ও বনায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প
খাতসহ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ এবং অন্যান্য সেবা খাতগুলোতে ঋণ সুবিধা
প্রদান করছে। ডিসেম্বর ২০২৩ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট পরিসম্পদের ১.৭ %,
মোট আমানতের ২.৭% এবং মোট কর্মরত জনবলের ৫.৮% বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর
নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার শতকরা ০.৯ ভাগ এবং ঋণ ও
অগ্রিম হিসেবে প্রদত্ত অর্থায়নের শতকরা ২.৫ ভাগ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর
মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এ সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার শতকরা ১৪.৩ ভাগ
এবং ঋণ ও অগ্রিম হিসেবে প্রদত্ত অর্থায়নের শতকরা ৪.০ ভাগ বিদেশি বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। তফসিল-বহির্ভূত ব্যাংকগুলো সাধারণত
কৃষি, মৎস্য, বনায়ন, ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, গৃহ নির্মাণ
এবং দারিদ্র্য বিমোচন খাতে অর্থায়ন করে থাকে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে
দিন দিন অনেক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। একটি ভালো ব্যাংকের প্রধান
বৈশিষ্ট্যগুলো হলো গ্রাহকের অর্থ ও আমানত সুরক্ষিত রাখা, স্থিতিশীল ও
যুক্তিসঙ্গত লভ্যাংশ প্রদান, প্রযুক্তি-নির্ভর উন্নত সেবা প্রদান, স্বচ্ছ ও
শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনা, এবং গ্রাহক ও কর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায়
রাখা। এছাড়াও, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম থাকা এবং টেকসই ও
দায়িত্বশীল ব্যাংকিং চর্চা করাও একটি ভালো ব্যাংকের লক্ষণ। ব্যাংকিং খাতে
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এ খাতে গতিময়তা বৃদ্ধি করেছে। ব্যাংকের
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দিন দিন বিনিয়োগ বাড়ছে, সেইসাথে বেড়েছে কর্মদক্ষতা এবং
উৎপাদনশীলতা। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাংকিং লেনদেন খরচ কমিয়ে দিয়েছে,
সেই সাথে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে মুনাফা বেড়েছে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং সেবা ব্যাংকের চার
দেয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে গেছে। এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে, যেকোনো সময়,
ব্যাংকিং করা যায়! দেশে বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংক এটিএম ও কার্ড সেবা
দিচ্ছে। ইন্টারনেট/অ্যাপস ব্যবহার করে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কেনাকাটা,
লেনদেন, বিল পেমেন্ট, ফান্ড ট্রান্সফারসহ অন্য সব ব্যাংকিং সেবা এসে গেছে
হাতের মুঠোয়। ভবিষ্যতে ডিজিটাল ব্যাংক চালু হলে ব্যাংকিং সেবায় নতুন গতি
যুক্ত হবে। ২০১১ সালে চালু হওয়া মোবাইল ব্যাংকিং গ্রামীণ ও শহুরে উভয়
অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা সহজলভ্য করেছে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা
আগে কখনো ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসেনি, তারাও এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের
মাধ্যমে বিল পেমেন্ট, অর্থ প্রেরণ, সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ
করছেন।
দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা অপরিসীম। যেকোনো দেশের
অর্থনীতির লাইফ লাইন হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। সার্বিক ব্যাংকিং খাতের
সুস্বাস্থ্য একটি দেশের অর্থনীতির মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। অর্থনীতির
সিংহভাগই নির্ভর করে ব্যাংকিং খাতের উন্নতির ওপর। যদি কোনো অনিয়মের কারণে
বা সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে কোনো প্রভাব পড়ে, তবে তা দেশের সামগ্রিক
অর্থনীতিকে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায়। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও
প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব ব্যাংকিং খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। অনেক
ব্যাংকের নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সাধারণ কর্মীদের
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার কার্যকর ব্যবহারে দুর্বলতা রয়েছে, যা
গ্রাহকসেবা এবং অপারেশনের মানকে প্রভাবিত করে।
আগামী দিনগুলোতে
ব্যাংকিং কার্যক্রম আরো বেশি প্রযুক্তি নির্ভর ও উদ্ভাবনী ধ্যান ধারনায়
পরিচালিত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত
দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও
ইন্ডাস্ট্রি সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে কর্মীদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ
প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। সফল ব্যাংকার হতে হলে
শুধু ব্যাংকিং, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন নয়, একই সঙ্গে
আইনগত বিষয়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অপরিহার্য। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক
উন্নয়নের জন্য ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং কার্যকর নীতিমালা
বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।
