
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে উৎপাদন কমছে এবং রপ্তানির সময়সীমা রক্ষা করা যাচ্ছে না। এতে বিদেশি ক্রেতারা বিরক্ত হচ্ছে। তদুপরি বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে অনেক ক্রেতাই বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
তাদের ক্রয়াদেশ প্রতিবেশী দেশ বা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিযোগিতায় একবার পিছিয়ে পড়লে সেখান থেকে বাংলাদেশকে টেনে তোলা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁরা বলছেন, অতি দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষ অবকাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে।
সামগ্রিকভাবেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। প্রতিনিয়ত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেক কারখানা কোনো রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না।
সেসব কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। ধর্মঘট হচ্ছে। এতেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কারখানা আরো সংকটে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ন্যূনতম শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ থেকে কমিয়ে ২০ করেছে।
এতেও শিল্প পরিবেশ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। গত রবিবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) আয়োজিত ‘বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সড়ক অবরোধ, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং গ্যাসসংকটের কারণে কারখানাগুলো সময়মতো উৎপাদন শেষ করতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়সীমা রক্ষা করা যাচ্ছে না। অনেক রপ্তানিকারক বাধ্য হচ্ছেন ব্যয়বহুল বিমানপথে পণ্য পাঠাতে। এতে রপ্তানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, ‘আমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। দেশের সার্বিক অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। যদি দ্রুত সমাধান না আসে, এই সংকট আরো গভীর হবে।’ বিজিবিএর মহাসচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘গ্যাসসংকট ও প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘টেক্সটাইল ও পোশাক খাত জাতীয় রপ্তানিতে ৮৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে। তবু আমরা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছি না। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। নতুন অর্ডারের প্রবাহে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।’ বিজিএমইএর পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, বিমানবন্দরের জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক বাধা-সব মিলিয়ে গার্মেন্টস খাত এখন এক গভীর সংকটে।
দেশে প্রতিনিয়ত কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে আসায় তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে বাড়ছে না। বেকারের সংখ্যাই কেবল স্ফীত হচ্ছে। এর ওপর যদি দেশে কর্মসংস্থানের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে এভাবে ধস নামতে থাকে, তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ডলার সংকট, ঋণের উচ্চ সুদহার, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ আরো অনেক কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা মনে করি, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর আগে শিল্প ও বিনিয়োগ পরিবেশ রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
