
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে
সদ্যঃপ্রকাশিত ‘ইন্টেগ্রিটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ (আইপিসি)
প্রতিবেদন উদ্বেগজনক এক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, আগামী
ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ বড় ধরনের
খাদ্যসংকটে (ধাপ-৩ বা সংকট) পড়তে যাচ্ছে, যা মূলত দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোতে
কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ কক্সবাজার, উপকূলীয় ও
হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এই সংকটে ১৬ লাখ শিশুর চরম
অপুষ্টিতে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে।
এমন এক সময়ে এই তথ্য প্রকাশিত হলো, যখন
মূল্যস্ফীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক মন্দার চাপ দেশের নিম্নবিত্ত ও
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) এবং জাতিসংঘের তিনটি সংস্থার
(এফএও, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে করা এই প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক মন্দা,
জলবায়ু বিপর্যয়, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং
খাদ্যবৈচিত্র্যের অভাবকে এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা
হয়েছে। বিশেষ করে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, কক্সবাজারসহ ১৩টি জেলাকে
খাদ্যসংকটের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে
কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবিরে জরুরি অবস্থা (ধাপ-৪) দেখা দেওয়ার
আশঙ্কাও রয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের তুলনায় মে থেকে
ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয়
জেলা বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট কিংবা পার্বত্য জেলা
বান্দরবান ও রাঙামাটির মানুষের জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে উঠছে।
খাদ্য
মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান আইপিসি প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত
পোষণ না করলেও সমস্যা সমাধানে চলমান কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বিদ্যমান উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কি না, সে
প্রশ্ন ওঠে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ; যেমন-বন্যা ও
ঘূর্ণিঝড়ের বারবার আঘাত এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য
নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে।
এই গুরুতর সংকট মোকাবেলায় শুধু
খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা এবং
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব
আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের যেমনটি বলেছেন, কৃষি ও মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল
গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা সুরক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
এই
সংকট কেবল খাদ্যের ঘাটতির নয়, এটি একটি নীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতার
প্রতিফলনও। খাদ্যবৈচিত্র্য কমে যাওয়া, স্থানীয় উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার
ভঙ্গুরতা এবং পুষ্টিকে উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রে না রাখার ফলেই সংকট বৃদ্ধি
পাচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তাকে কেবল মানবিক নয়, কৌশলগত অগ্রাধিকারের স্থানে
নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন অংশীদার ও স্থানীয়
প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন বাংলাদেশের কোনো মানুষ ক্ষুধা বা
অপুষ্টিতে না ভোগে।
