কুমিল্লার
গোমতী নদীর বালুচর এখন চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। দূর থেকে তাকালে মনে হয়,
যেন সবুজ চাদরে মোড়া বিশাল এক মাঠ। চরের এ জমিতে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি
ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে লাউ শাক। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় এই শাক চাষে
আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চরের শতাধিক কৃষক।
বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের
ভান্তী গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান কয়েক বছর আগেও গোমতীর চরে লাউ, মুলা ও
লাল শাক চাষ করতেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়
তার। লোকসান পুষিয়ে ওঠা ছিল কঠিন। পরে স্থানীয় পাইকারদের পরামর্শে তিনি
লাউয়ের পরিবর্তে লাউ শাকের চাষ শুরু করেন। কারণ, লাউ শাকের বাজার চাহিদা
বেশি, দামও ভালো। এখন তিনি প্রায় ৬০শতাংশ জমিতে লাউ শাক চাষ করে বেশ
লাভবান। তার সাফল্য দেখে আশপাশের শতাধিককৃষক এখন লাউ শাক চাষ শুরু করেছেন।
আগে যারা অন্য ফসল চাষ করত তারাও এখন লাউ শাক চাষ শুরু করেছেন।
রবিবার
বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভান্তী, বালিখাড়া, কামারখাড়া, কাহেতরাসহ
বেশ কিছু গ্রামের চরে ভরে উঠেছে সারিসারি সবুজ ফসলের মাঠ। লাউশাক ছাড়াও
শীতের আগাম সবজি যেমন, মূলা, লাল শাক, ফুলকপি, বাঁধা কপি, গোল আলু ক্ষেতে
ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। তাদের কেউ কেউ দল বেঁধে ক্ষেতের আগাছা
পরিষ্কার করছেন, কেউ জমিতে পোকামাকড় দমনের ওষুধ ছিঁটাচ্ছেন, কেউ আবার লাউ
শাকের ডগা কেটে আঁটি বাঁধছেন। কৃষক মিজানুর রহমানের লাউশাকের ক্ষেতে গিয়ে
দেখা গেছে, তিনি নিজের ভাগিনা ও ছেলেকে নিয়ে লাউ শাকের ডগা কেটে আঁটি তৈরি
করছেন। আর একজন শ্রমিক সে আঁটি পানিতে ধুয়ে গোমতীর বেড়িবাঁধের ওপর সারিবদ্ধ
করে রাখছেন।
কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, “লাউয়ের তুলনায় লাউ শাকে ঝুঁকি ও
খরচ কম, লাভও বেশি। এক গাছ থেকে ৪-৫ বার পর্যন্ত ডগা কাটা যায়। বৃষ্টিতে
ক্ষতি হয় না, আর পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। আগে লাউ চাষ করতাম, এতে ঝামেলা
বেশি, মাচা তৈরী করতে হয়, পাহারা দিতে হয়, খরচ ও পরিশ্রম বেশি। শাকে যেমন
লাভ লাউয়েও একই রকম লাভ। এ শাক মাটিতেই বেড়ে উঠে মাচা লাগে না। একই গাছ
থেকে ১০-১২ দিন পর পর ডগা কাটা যায়। ৬-৭ টি ডগা একত্র করে একটি করে আঁটি
বাধা হয়। প্রতি আঁটি ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। প্রতি কানি জমিতে
৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ করে ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়। তাই এখন
লাউ বাদ দিয়ে শাক চাষ করি। লাউ শাক শেষ হলে আলু চাষ করব।
কামারখাড়া
গ্রামের কৃষক আবদুস সাত্তার বলেন, বাজারে লাউয়ের চেয়ে শাকের চাহিদা বেশি।
পাইকাররা লাউ না না কিনে শাক কিনতে আগ্রহী বেশি, তাই এখন লাউয়ের শাক চাষ
করি । প্রতি আঁটি লাউশাকে খরচ বাদে ১৫-২০ টাকা লাভ হয়। একটি লাউ বেচলেও তা
লাভ হয় না। একই গাছ থেকে কয়েক দফায় লাউয়ের ডগা কাটা যায়। আগে লাল শাক ও
মুলা চাষ করতাম, অতিবৃষ্টি ও পোকার কারণে ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়, লোকসান হয়
বেশি। তাই সহজ পদ্ধতিতে লাউশাক চাষ করি। তিনি আরও বলেন, এ শাক প্রথমে
নিমসাইর পাইকারি বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ঢাকাসহ দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। এছাড়াও স্থানীয় পাইকাররা প্রতিদিন ভোরে চরাঞ্চলে এসে
ট্রাকে শাক সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে যায়।
শ্রমিক শারাফত আলীর বাড়ি রংপুর
জেলায়। তিনি প্রতি বছর শীতের আগে কাজের সন্ধানে এই চরে আসেন। শীতের সবজি
চাষে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন কৃষকের জমিতে। শারাফত আলী বলেন, অন্যান্য
ক্ষেতে কাজ করার চেয়ে লাউ শাকের ক্ষেতে আগা কাটা ও আটি বাঁধা সহজ, পরিশ্রম
কম। এই চরে লাউয়ের চেয়ে শাকের ফলন ভালো হয়, বাজারে চাহিদাও বেশি। আমরা
প্রতি আঁটিতে ৫-৭ টাকা করে মজুরি পাই। প্রথমে লাউ শাকের ৪-৫টি করে আগা কেটে
আটি বাধি তারপর পানিতে ধুয়ে খাড়িতে থরে থরে সাজিয়ে রাখি পরে পাইকেরা এসে
ট্রাকে ভরে লাউ শাক বাজারে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে কুমিল্লা কৃষি স¤প্রসারণ
অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো.মিজানুর রহমান বলেন, আমি গতকাল গোমতীর চর দেখে
এসেছি, কৃষকরা লাউ থেকে তারা শাক চাষে বেশ আগ্রহী। এতে তারা অল্প সময়ে অধিক
লাভবান হতে পারে। অফসিজনেও তারা এই লাউশাক চাষ করতে পারে। লাউ যেমন
বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে তেমনি শাকও বাজারের সবজির চাহিদা তৈরী করছে। লাউ
শাকের একটি বৈশিষ্ট হলো, ডগা যতই কাটা হবে ততই ডগা দিবে।না কাটা পর্যন্ত
লাউগাছ বাড়ে না। এক গাছ থেকে তারা ৪/৫ বার পর্যন্ত ডগা কাটতে পারে।
