
বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এক নাজুক সময় পার করছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতিনির্ধারকদের অনাগ্রহ-সব মিলিয়ে এক জটিল সংকটে পড়েছেন তাঁরা। আস্থাহীনতা, উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চম‚ল্য এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো অর্থনীতিতে এক গভীর মন্দার ছায়া ফেলেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক দুর্বলতার এক স্পষ্ট ইঙ্গিত। ঋণ প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন এবং ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপি রেকর্ড গড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ম‚ল্যস্ফীতি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে রেকর্ড উচ্চতায়। একের পর এক কারখানা বন্ধের কারণে লাখো শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন, বেড়েছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য।
উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকারের নীতিনির্ধারক ও আমলাদের মধ্যে বাস্তব ব্যবসার জ্ঞান ও প্র্যাকটিক্যাল বাধা বোঝার ক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। তাঁদের তত্ত¡গত সমাধানের আকাক্সক্ষার ভেতর ব্যবসায়ীদের দুঃখ ও বাস্তব সমস্যাগুলোকে বোঝাপড়ার ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে না। উপরন্তু হয়রানি, মামলা-হামলা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার মতো ঘটনা ব্যবসায়ীদের আস্থাকে আরো তলানিতে নামিয়েছে।
অনেকেই বলছেন, তাঁদের শিল্প-কারখানা আইসিইউতে থাকা রোগীর মতো কোনো রকমে টিকে আছে। নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীসমাজের যোগাযোগের ঘাটতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অবস্থায় সেবা রপ্তানিতে কর আরোপ, ই-কমার্সে দ্বৈত করনীতি এবং খাতভেদে বৈষম্যম‚লক ভ্যাটকাঠামো ব্যাবসায়িক আস্থার ঘাটতি আরো বাড়াচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির পরিবর্তে কর-জটিলতা, প্রশাসনিক হয়রানি এবং নীতির অস্বচ্ছতা ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহ করছে। এনবিআরের ‘মিট দ্য বিজনেস’ সভায় উদ্যোক্তাদের ক্ষোভে তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
অনলাইনে অভিযোগের সুযোগ রাখাটা ইতিবাচক উদ্যোগ হলেও বাস্তবে এসব অভিযোগের দ্রæত নিষ্পত্তি না হলে তার কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁরা মনে করেন, নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো আশা নেই। ব্যবসা বাড়লেই রাজস্বও বাড়বে।
সরকারকে অবশ্যই ব্যবসায়ীসমাজের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপ শুরু করতে হবে। বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান রক্ষায় অর্থনৈতিক রোডম্যাপ প্রণয়ন জরুরি। ব্যবসা-বিনিয়োগ কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতারও ভিত্তি। সেই ভিত্তি নড়বড়ে হলে পুরো জাতিই ঝুঁকির মুখে পড়ে। আশা করি, সরকার সংকট স্বীকার করে আস্থা ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
