
চে গেভারাকে হত্যা করা
হয়েছিল, কিন্তু তার দর্শন, তার প্রতিবাদের ভাষা-মুছে ফেলা যায়নি। তিনি কোনো
একটি রাষ্ট্রের নায়ক নন; সার্বজনীন প্রতিবাদের প্রতীক। লাতিন আমেরিকা থেকে
শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া-যেখানেই তরুণরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে
দাঁড়ায়, সেখানে চে নতুন করে জন্ম নেন।
অথচ কত আগে তার শারীরিক মৃত্যু
হয়েছে। সেই ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বলিভিয়ার ইউরো উপত্যকায় চেসহ ১৬ জন
বিপ্লবীকে ঘিরে ফেলে সহস্রসৈন্যের একটি দল। ৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আহত চেকে
ধরে নিয়ে যায় লা হিগুয়েরা নামে বলিভিয়ার একটি গ্রামে। তারপর রাত দেড়টা
নাগাদ তাকে হত্যা করা হয়। তাই বলা হয়ে থাকে চে নিহত হয়েছেন ৯ অক্টোবর।
মৃত্যুর
আগে চে বন্ধুদের বলেছিলেন, “ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমার প্রিয় এম-২
রাইফেল অকেজো হয়ে গেছে। তবে আমার পরাজয় এই নয় যে, বিজয় অর্জন সম্ভব নয়।
এভারেস্ট বিজয়ের অভিযানেও অনেকে পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু মানুষ জয় করেছে।
ফিদেলকে বল, আমার মৃত্যুতে বিপ্লব পরাজিত হয়নি। বিপ্লবের মৃত্যু নেই। শোষিত
মানুষের জয় অনিবার্য। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ একদিন ধ্বংস হবেই। বিদায়-চে।”
চে
গেভারাকে একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট বলা হয়, তবে তাকে কেবল কমিউনিস্ট
আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে দেখলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন সেই মানুষ, যিনি
বিশ্বাস করতেন- অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই মানে কেবল ক্ষমতা দখল নয়, মানুষের
প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করাও। তাই চে বিশ্বের সব নিপীড়িত, শোষিত মানুষ ও
তরুণদের আশার প্রতীক হয়ে ওঠেন।
এই চে আমার জীবনে প্রথম আসে ১৯৯৮ সালে,
তখন সরকারি স্বরূপকাঠি কলেজে পড়ি, ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। আমাদের
কলেজের পাশেই ছিল প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র- স্বরূপ থিয়েটার। সন্ধ্যায়
সেখানে জমে উঠত নাটক ও গানের মহড়া। মাঝে মাঝেই আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা
সেখানে যেতাম।
সেই সময়েই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় ঘটে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা
হুমায়‚ন কবিরের সঙ্গে। হুমায়‚ন ভাইয়ের কাছ থেকেই আমরা শিখেছিলাম-রাজনীতি,
সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ইতিহাস সমাজব্যবস্থা, দর্শন, সাহিত্য- এমনকি
মানব সভ্যতার বিকাশধারার ইতিহাসও। তার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম বিপ্লবী
আর্নেস্তো চে গেভারার জীবনকাহিনি।
ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হওয়ার পরও আমি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকি। দিন কেটে যায়
পড়াশোনা, রাজনীতি আর বইয়ের সঙ্গেই। একদিন দেখি, ছাত্র ইউনিয়নের এক বন্ধুর
পরনে একটি টিশার্ট- সেখানে স্পষ্ট আঁকা চে গেভারার মুখাবয়ব। মুহ‚র্তেই
হুমায়‚ন ভাইয়ের বর্ণনা মনে পড়ে যায়। টিশার্টটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি,
যেন সেই ছবির ভেতর দিয়েই বিপ্লবী চে আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছেন। পরে সেই
বন্ধুর কাছ থেকে টিশার্টের দোকানের ঠিকানা জেনে নিই। তবে টি শার্ট থেকে
বুকের গভীরে পৌঁছে গিয়েছেন চে। আমার আগের প্রজন্মে ছিলেন, পরের প্রজন্মেও
থাকবেন-চে সেই আগুন যা নিরন্তর জ্বলছে, জ্বলবে।
এরপর শুরু হয় চেকে জানার
নতুন অধ্যায়। নীলক্ষেত থেকে কিনে ফেলি ‘মোটরসাইকেল ডায়েরি’, তারপর একে একে
পড়ি চেকে নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি বই। পাশাপাশি কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে আলাপ
করে তার বিপ্লব, চিন্তাধারা ও জীবনের দর্শন সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে থাকি।
কিছুদিনের মধ্যেই আমার সংগ্রহে জমে যায় চের টিশার্ট, বই, পোস্টার ও
ক্যাপ-যেন এক ব্যক্তিগত চে আর্কাইভ।
২০১৫ সালে আমি ‘চে সমগ্র’ বইটি
সম্পাদনা করি। ওই বছরের বইমেলায় বইটি নিয়ে যাই বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনার
স্টলে, সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখি চের তিনটি ছবি। মেলা শুরু হতেই কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য তরুণ এসে দাঁড়ায় সেই ছবিগুলোর সামনে। প্রায় সবাই
পোস্টার নেওয়ার আবদার করে, কেউ কেউ বলে-“ভাইয়া, আপনি আবার বাঁধিয়ে নিয়েন,
এটা আমাকে দিন।” শেষ পর্যন্ত তাদের বলেছিলাম, “তোমরা ৩-৪ দিন সময় দাও, আমি
প্রিন্ট করে নিয়ে আসব।”
কথা রাখি- তিনটি পোস্টার প্রতিটি ২,০০০ কপি করে
প্রিন্ট করি। বইমেলা শেষ হওয়ার আগেই সব পোস্টার শেষ হয়ে যায়। বইমেলায় ‘চে
সমগ্র’ বইটি দারুণ বিক্রি হয়েছিল।
বইমেলার সময় একটু খেয়াল করে
দেখবেন-প্রায় প্রতিটি প্রকাশনার স্টলেই চে গেভারাকে নিয়ে লেখা অন্তত একটি
বই রয়েছে। ‘মোটরসাইকেল ডায়রি’, ‘আবার পথে’, ‘স্মৃতিকথায় কিউবা বিপ্লব’,
‘ডাক দিয়ে যাই’, ‘বলিভিয়ার ডায়রি’, ‘আমাদের আর তাহাদের আমেরিকা’,
‘ন্যায়স‚ত্র’, ‘গেরিলা যুদ্ধ’, ‘মার্কস ও এঙ্গেলস: জীবন পাঠের স‚ত্রপাত’,
‘সমাজতন্ত্র এবং কিউবার মানুষ’- এমন অসংখ্য বই চে গেভারাকে কেন্দ্র করে
লেখা ও অন‚দিত হয়েছে। সঙ্গে চের কবিতা, প্রবন্ধ ও চিঠি, কিংবা চে সমগ্র তো
থাকেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই বইগুলোর কোনো প্রকাশকই কখনো লোকসানের
মুখোমুখি হননি।
চে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, বইমেলার বাইরেও বেঁচে আছেন
শহরের রাস্তাঘাটে, শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের টিশার্টের দোকানগুলোতে।
যে দোকানদাররা চের টিশার্ট, ক্যাপ বা ব্যাজ বিক্রি শুরু করেছিলেন, তারা
কেউই ক্ষতির মুখ দেখেননি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা লাভবান হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়,
কলেজ কিংবা শহরের তরুণদের ব্যাগে চের মুখাবয়ব এখন যেন এক সাধারণ দৃশ্য।
কেউ রাখছেন সেটি প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে, কেউ বা অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি
হিসেবে। কেউ নিয়েছেন ফ্যাশন হিসেবেও। চে গেভারার গ্রাফিতি প্রায় সকল
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চোখে পড়বে। দেয়াল, রেলিং, চারপাশের খোলা স্থানে লাল
তারকা আর চের মুখাবয়ব। বামপন্থী ও প্রগতিবাদী ছাত্র-তরুণদের মধ্যে চে হয়ে
উঠেছেন বিপ্লবের ও বিপ্লবীর এক চিরস্থায়ী প্রতীক। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে
প্রতিরোধ, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার রক্ষায় চে হয়ে উঠেছেন অমর
অনুপ্রেরণার উৎস।
২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর
ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি তিনটি গুরুত্বপ‚র্ণ লংমার্চ
করে-ঢাকা-বিবিয়ানা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মংলা। প্রতিটি লংমার্চে একটি
বিশেষ দৃশ্য চোখে পড়ত- চে গেভারার টিশার্ট ও ক্যাপ। বাতাসে উড়তে থাকা লাল
ব্যানার, আর ‘দেশ বাঁচাও, সম্পদ বাঁচাও’ ¯েøাগানে মুখর জনসমুদ্র-সব মিলিয়ে
চের বিপ্লবী চেতনা যেন বাস্তব রূপ পেয়েছিল বাংলাদেশে।
গত পঁচিশ বছর ধরে
জাতীয় রাজনীতির নানা বাঁকবদল, আন্দোলন-সংগ্রাম ও ক্রান্তিকাল আমি খুব কাছ
থেকে দেখেছি-দেশের সংকটময় সময়ে রাজনীতির মাঠে যারা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে,
তারা অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে চে গেভারাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন।
জাতীয় দুর্যোগ, মহামারী বা মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও যখন তরুণরা মানুষের
পাশে দাঁড়ায়-ত্রাণ বিতরণে, স্বেচ্ছাসেবায়, রক্তদানে-তখনও অনেকের গায়ে বা
মাথায় দেখা যায় সেই চেনা প্রতীক, চের মুখাবয়ব।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার
অভ্যুত্থানেও চের উপস্থিতি স্পষ্ট ছিল। রাজপথে তরুণদের মুখে উচ্চারিত
প্রতিবাদের ¯েøাগান, হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড, গায়ে চের প্রতীকী টিশার্ট-সব
মিলিয়ে চে গেভারা যেন হয়ে উঠেছিলেন সেই আন্দোলনেরও সরব সহযাত্রী।
চে
জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার গোমারিও শহরে। বাবা ছিলেন
গুয়েভারা লিঞ্চ, মা মেরিলা মেনা। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি হয়ে ওঠেন রক্ত
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু এই ডাক্তারি শিক্ষার সঙ্গে তার চেতনায় ঢুকে যায়
মার্কসবাদের মন্ত্র। তিনি ছুটে যান নিরন্ন ও অনাহারী মানুষের কাছে, দিনের
পর দিন, মাসের পর মাস। বছর কেটে যায়, বিপ্লবের নেশায় পাগল হয়ে ওঠেন। ১৯৫১
সালে বন্ধু চিচিনার দেওয়া ১৫ ডলার এবং বন্ধু আলবার্তোকে সঙ্গে নিয়ে
জরাজীর্ণ মোটরসাইকেলে চড়ে আর্জেন্টিনার ক্ষুদ্র গÐি পেরিয়ে লাতিন আমেরিকার
বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান। উদ্দেশ্য একটাই-বিপ্লব।
পেরু, ভেনিজুয়েলা,
পানামা, ইকুয়েডর, মেক্সিকো, কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া,
কিউবা-সেখানে তিনি বিপ্লবী তৈরি ও সংগঠিত করার জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৫৩ সালে তিনি গুয়েতেমালায় যান, সরকার প্রধান জ্যাকোবা আরচেঞ্জের আদর্শে
অনুপ্রাণিত হয়ে। এ সময়ই তিনি গ্রহণ করেন ছদ্মনাম চে। এই নামেই তিনি আজ
বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
১৯৫৪-৫৫ সালে মেক্সিকোতে বিপ্লবের জন্য নিজের ও
বিপ্লবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকেন। ১৯৫৫
সালে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। দুই বিপ্লবী সমাজ বাস্তবতা
বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তনেন-বিপ্লবের বিকল্পনেই। প্রথম নিশানা ঠিক হয় কিউবা।
৮২
জন বিপ্লবী বহনকারী ‘গ্রানামা’নৌযানটি কিউবার মাটিতে নামতেই, বাতিস্তা
সরকারের হাজার হাজার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। ৩
দিনের মধ্যে বিপ্লবীদের ৬০ জন শহীদ হন, ৪ জন বন্দী হন। চে আহত হন। যুদ্ধরত
বাহিনী কিউবার সিয়েরো সায়েস্ত্রি পাহাড়ে আত্মগোপন করে। নতুন করে স্থাপিত হয়
বিপ্লবী ঘাঁটি। গেরিলা সৈন্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। চের
পারদর্শিতার কারণে তাকে সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক বানানো হয়।
এই সময়
কিউবার অসংখ্য তরুণ মার্কসবাদী দীক্ষা নিয়ে ফিদেল-চে বাহিনীতে যোগ দেয়,
সশস্ত্র সংগ্রাম চালায়। গেরিলা বাহিনী স্বৈরাচারী সরকারের ভিত তছনছ করে
দেয়। কিউবার মানুষ ফিদেল-চে বাহিনীকে সমর্থন জানায়। ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি
চে-ফিদেল বাহিনী হাভানা দখল করে। কিউবায় সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট হন ফিদেল। চেকে প্রথমে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং
পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদ দেওয়া হয়। কিন্তু চের চেতনায় ভেসে
ওঠে শোষিত মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন- রাষ্ট্রীয়
সুযোগ-সুবিধার জন্য বেঁচে থাকার জন্য জন্ম হয়নি তার। আবারও বিপ্লবের নেশায়,
মানুষের মুক্তির নেশায় তিনি কিউবা থেকে বিদায় নেন।
১৯৫৯ সালের ১২ জুন
থেকে ৬ সেপ্টেম্বর। এক সফরে বের হন চে। তখন তিনি মিসর, সিরিয়া, ভারত,
বার্মা (মিয়ানমার), শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, বাংলাদেশ (তৎকালীন
প‚র্ব পাকিস্তান), পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান), যুগো¯øাভিয়া,
থাইল্যান্ড, গ্রিস, সিঙ্গাপুর, সুদান ও মরক্কো গিয়েছিলেন।
চে চলে যান
লুলুম্বার দেশ কঙ্গোতে। ১৯৬৫ সালে প্রতিক‚ল পরিবেশ দেখে সেখান থেকে চলে যান
বলিভিয়ায়। শুরু করেন বিপ্লবী কর্মকাÐ। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বলিভিয়ার
স্বৈরাচার সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেন।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা। বর্তমানে ‘বিপ্লবীদের কথা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক।
