
সুকুমার রায়ের সেরা গল্পের একটি হলো
‘টাকার আপদ’। এই গল্পটি অনেকে হয়তো জানেন, কিন্তু তারপরও বলি গল্পটি হুবহু
এই রকম- বুড়ো মুচি রাতদিন কাজ করছে আর গুন্ গুন্ গান করছে। তার মেজাজ বড়
খুশি, স্বাস্থ্যও খুব ভালো। খেটে খায়; স্বচ্ছন্দে দিন চলে যায়। তার বাড়ির
ধারে এক ধনী বেনে থাকে। বিস্তর টাকা তার; মস্ত বাড়ি, অনেক চাকরবাকর। মনে
কিন্তু তার সুখ নাই, স্বাস্থ্যও তার ভাল নয়। মুচির বাড়ির সামনে দিয়ে সে রোজ
যাতায়াত করে আর ভাবে, ‘এ লোকটা এত গরিব হয়েও রাতদিনই আনন্দে গান করছে, আর
আমার এত টাকাকড়ি আমার একটুও আনন্দ হয় না মনে গাওয়া তো দ‚রের কথা ইচ্ছে হলে
তো টাকা দিয়ে রাজ্যের বড় বড় ওস্তাদ আনিয়ে বাড়িতে গাওয়াতে পারি নিজেও গাইতে
পারি কিন্তু সেই ইচ্ছে কই’?
শেষটায় সে একদিন মনে মনে ঠিক করলো এবার যখন
মুচির বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে তখন তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বার্তা বলবে। পরের
দিন সকালে গিয়ে মুচিকে জিজ্ঞাসা করল “ কি হে মুচি ভায়া, বড় যে ফুর্তিতে গান
কর, বছরে কত রোজগার কর তুমি? মুচি বলল “ সত্যি বলছি মশাই, সেটা আমি কখনো
হিসাব করিনি। আমার কাজেরও কোনোদিন অভাব হয় নি। খাওয়াপরাও বেশ চলে যাচ্ছে,
কাজেই টাকার কোন হিসাব রাখবার দরকার হয়নি কোনোদিন”। মুচির সাদাসিধে
কথাবার্তায় সে খুশি হলো, তারপর, একটা টাকার থলে নিয়ে সে মুচিকে বলল- “এই
নাও হে তোমাকে একশ টাকা দিলাম। এটা রেখে দাও, বিপদ-আপদ অসুখ-বিসুখের সময়
কাজে লাগবে”।
মুচির তো ভারি আনন্দ; সেই টাকার থলেটা মাটির তলায় লুকিয়ে
রেখে দিল। তার জীবনে সে কখনো এক সঙ্গে এতগুলি টাকা চোখে দেখেনি। কিন্তু
আস্তে আস্তে তার ভাবনা আরম্ভ হলো। দিনের বেলা বেশ ছিল; রাত্তির হতেই তার
মনে হতে লাগলো ‘ঐ বুঝি চোর এসেছে! বিড়াল ম্যাও করতেই সে মনে করলো, আমার
টাকা নিতে এসেছে!’ শেষটায় তার আর সহ্য হলো না। টাকার থলিটা নিয়ে সে ছুটে
বেনের বাড়ি গিয়ে বলল,“এই রইল তোমার টাকা! এর চেয়ে আমার গান আর ঘুম ঢের
ভালো!” কিন্তু এই গান আর ঘুম দিয়ে কি মুচি তার জীবনমান উন্নীত করতে পারবে?
জীবনমানতো শুধু গান আর ঘুম নায়; জীবনমান হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চেতনা
ইত্যাদির পরিবর্তন এবং একটা দীর্ঘ জীবন।
দুই.
এই গল্পের সাথে পুরো
অর্থনীতিতে অর্থ বা টাকার প্রবাহজনিত প্রভাবের কিছুটা মিল আছে। কোন একটা
অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বেশি হওয়া ভাল লক্ষণ নয়- কেন-না মুদ্রার সরবরাহ
বৃদ্ধি পেলে বিশেষত ম‚ল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয় যা জনগণের সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়ে
গান আর ঘুম হারাম হয়ে যাবার উপক্রম হয়। অন্যদিকে, অর্থনীতির স্বাস্থ্যটা
যখন একটু খারাপ থাকে (অর্থনৈতিক মন্দা) সেই প্রেক্ষিতে অর্থ সরবরাহ
অপেক্ষাকৃত কম থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে।
প্রবৃদ্ধি
ব্যাহত হওয়ার কারণে গল্পের মুচির মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক গান আর ঘুম নষ্ট না
হলেও সামষ্টিক অর্থে অনেকের জীবন-জীবিকা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে কিংবা
সার্বিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং, দেশের
মুদ্রানীতি এমন হওয়া উচিত যাতে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ ম‚ল্যস্ফীতি নামক
আপদ ও মন্দা নামক বিপদ থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে। বিচক্ষণ
মুদ্রানীতি হচ্ছে সেটাই যা আপদ-বিপদ পাশ কাটিয়ে স্থিতিশীল ম‚ল্যস্তরের
মাধ্যমে প‚র্ণ কর্মসংস্থান সাপেক্ষে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে
পারে।
মনে রাখা দরকার যে, অর্থের চাহিদা আইসক্রিম আর সিনেমার চাহিদা
একরকম নয়। আইসক্রিম খেয়ে কলিজা ঠান্ডা হয়; মন ভোলানো সিনেমা দেখলে ভাল
লাগে। কিন্তু অর্থের সরাসরি কোনো উপযোগিতা নেই বিধায় তৃপ্তি পাবার জন্য কেউ
অর্থ খায় না, কিংবা খুব সুন্দর বলে ১০০০ টাকার নোট ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরে
ঝুলিয়ে রাখে না। অর্থের কাজ হচ্ছে কোন অর্থনীতিতে চলমান বাণিজ্য ও বিনিময়ে
পরোক্ষভাবে লুব্রিকেন্ট বা তেল হিসাবে কাজ করা। এ জন্যই মানুষের কাছে
অর্থের চাহিদা থাকে। একে বলে ডিরাইভড্ ডিমান্ড বা আহরিত চাহিদা।
নিত্যদিনের
পণ্য ও সেবা ক্রয় করার জন্য যেমন চাল-ডাল বেচা-কেনা করা কিংবা বাস ভাড়া
দেয়া-নেয়া ইত্যাদি কাজের জন্য মানুষের কাছে অর্থের চাহিদা থাকে। এই ধরনের
বিনিময়ের জন্য যত বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়বে মানুষ তত বেশি অর্থ নিজের কাছে
রাখতে চাইবে (হোল্ডিং মানি)। এটাকে বলে অর্থের বিনিময়জনিত চাহিদা বা
ট্রেনজেকশন ডিমান্ড। তাছাড়া, অন্য দুটো কারণেও মানুষ অর্থ ধরে রাখা পছন্দ
করে- যেমন দুঃসময় বা দুর্ঘটনার খরচ মেটানো। প্রধানত এ দুই চাহিদা আয়ের উপর
নির্ভরশীল- যত আয় বাড়বে তত মানুষ এই উদ্দেশ্যে টাকা হাতের কাছে রাখবে। ফটকা
সুযোগ গ্রহণ করার জন্য মানুষ অর্থ ধরে রাখে যা কিনা সুদের হারের উপর
নির্ভরশীল।
তিন.
মুদ্রার পরিমাণ তত্ত¡- বলে একটা উপপাদ্য অর্থনীতিতে
পড়ান হয়। অর্থ মানে বিনিময়ে ব্যবহৃত সম্পদের ভাÐার। আর অর্থের পরিমাণ হচ্ছে
ঐ সমস্ত সম্পদের মোট পরিমাণ। যে সম্পদটি প্রথমে আমাদের সামনে হাজির হয় তা
হচ্ছে প্রতিদিনের খরচ মেটাবার জন্য মানুষের কাছে থাকা কাগুজে নোট ও ধাতব
মুদ্রা (কারেন্সি) । বিনিময়ে ব্যবহৃত অর্থের দ্বিতীয় উৎসটি হচ্ছে ডিমান্ড
ডিপোজিট বা তলবি আমানত। যখন-তখন তোলার জন্য মানুষ ব্যাংকে চেকিং একাউন্টসে
টাকা জমা রাখে যার বিনিময়ে কোন সুদ পায় না। মুদি দোকানদার চেক গ্রহণ করে না
তাই কষ্ট করে চেক ভাঙিয়ে মুদ্রা দিয়ে মুদির দাবি মেটাতে হয়।
মোট কথা,
এই দুটো ক্ষেত্রেই বিনিময়ে সহায়তা সহায়তা করার জন্য সম্পদের প্রয়োজন হয় এবং
সেই স‚ত্রে তলবি আমানতকে কারেন্সির সাথে যোগ করে মোট অর্থের পরিমাণ
নির্ধারণ করা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, ডিমান্ড ডিপোজিট বিনিময়ে সাহায্য করে
বলে যদি অর্থ হতে পারে, তা হলে সেভিংস বা টাইম ডিপোজিট একই সেবা দিয়েও কেন
অর্থ হতে পারবে না? অবশ্যি পারে তবে এক্ষেত্রে পার্থক্যটা হলো, ডিমান্ড
ডিপোজিট যত তাড়াতাড়ি তরল করা যায়, (বিনিময়যোগ্য) অন্যান্য সম্পদ সেই
মাাত্রায় তরল হতে অপেক্ষাকৃত একটু বেশি সময় নেয়। এই যুক্তি সামনে রেখে আমরা
টাইম ও সেভিংস আমানতকেও অর্থের পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি তাই
অর্থনীতিতে অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ঃ (ক) জনগণের হাতে থাকা মুদ্রা (খ) তলবি
আমানত, ট্রেভেলার্স চেক ও অন্যান্য আমানত যা সহজে তরল করা যায় এবং (গ)
সেভিংস ডিপোজিট, টাইম ডিপোজিট ইত্যাদি। বস্তুত (ক) ও (খ) মিলে সবচাইতে
জনপ্রিয় মোট সংকীর্ণ মুদ্রার পরিমাণ নির্দেশ করে এবং (ক), (খ) ও (গ) এর
সমষ্টি হচ্ছে ব্যাপক বা বিস্তৃত মুদ্রার পরিমাণ।
তবে, এক্ষেত্রে ক্রেডিট
কার্ড অর্থের পরিমাপে অন্তর্ভুক্ত হবে না যেহেতু ক্রেডিট কার্ডের কাজ
বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে নয়, এটা দিয়ে পরে দেনা মেটানো হয়। যখন ক্রেডিট
কার্ডের মাধ্যমে কোনো কিছু ক্রয় করা হয়, ব্যাংক বিক্রেতাকে অর্থ দেয় এবং
পরবর্তীকালে গ্রহীতার হিসাবে তা সমন্বয় করা হয়। এজন্য গ্রহীতাকে হয়তো
ব্যাংকের বরাবর একটা চেক লিখে দিতে হয় যখন চেকিং অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্সটি
অর্থনীতির অর্থ ভাÐারে অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, ডেবিট কার্ডের
ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। ডেবিট কার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রয়কৃত জিনিসের দাম
দেবার জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেয়। এটা অনেকটা চেক কেটে দেওয়ার মতো।
ডেবিট কার্ডের পেছনে যে ব্যালান্স দেখানো থাকে তা অর্থের পরিমাণ পরিমাপে
অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ক্রেডিট কার্ডের ফলে মানুষের অর্থের চাহিদার পরিবর্তন
ঘটতে পারে- যেমন ক্রেডিট কার্ড থাকলে কেউ অর্থ নিজের কাছে রাখতে চায় না। এই
অর্থে এগুলো অর্থ সরবরাহের অংশ না হলে ও অর্থের চাহিদাকে প্রভাবিত করে।
চার.
বাংলাদেশের
বর্তমান অর্থনীতিতে নগদ অর্থে বিনিময় করার প্রবণতা প্রান্তিক হ্রাস
পাচ্ছে। বিশেষত উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত আজকাল ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার
করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে থাকে। এমনকি অনলাইন শপিং ডেলিভারি
দাতা একটা ছোট মেশিন সঙ্গে নিয়ে হাজির যাতে ক্রেতা তার কার্ড ব্যবহার করতে
পারেন। অনুমান করা যায় অতিদ্রæত ক্যাশলেস বিনিময় নগদ লেনদেনের জায়গা দখল
করে নেবে।
ক্যাশলেস বাণিজ্যের সুবিধা অনেক কিন্তু অসুবিধা একটাই-খরচের
কোনো আগামাথা থাকে না। মনে হয় কার্ড পে করছে, আমি তো না; সুতরাং, এক
হাজারের স্থলে দশহাজার খরচ করে গিন্নি বাড়ি ফেরে। আরামের বিনিময়ে যে ঘুম
হারাম হতে পারে তার উদাহরণ কম নেই। তারপরও বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট ও ডেবিট
কার্ডের জয়জয়কার এবং আমরাও হাঁটছি সেই পথে। সরকারি মহলের সুর হচ্ছে কেশলেস
বিনিময়ের বিস্তৃতি। এর আপদবিপদ আপাতত মাথায় নেই-হুজুগে বাঙালি!
লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
