রবিবারের নামচা
বগা ও ফাঁদের দর্শন

কায়সার হেলাল ।।
১.
হালের মানুষ ভাবে এরা বুঝি জগতে মানুষেরই ভূমিকা পালন করে। বিষয়টি আপাদমস্তক ভুয়া। এরা আসলে পালন করে বগা'র ভূমিকা ৷ তাই চিরকাল ফাঁদে পড়ে। ফাঁদ থেকে তাদের মুক্তি নাই। প্রাচীন গীতিকার (নাম জানা যায় না) এই ঘটনা গভীরভাবে বুঝেছিলেন বলেই লিখে রেখে গেছেন, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...।’
সম্প্রতি একটি বই পড়া শুরু করেছি। বইয়ের নাম হল ‘ঋৎববফড়স: অ উরংবধংব রিঃযড়ঁঃ ঈঁৎব।’ লিখেছেন লাকাঁনীয় মার্ক্সিস্ট ও এই সময়ের জনপ্রিয় (বিতর্কিতও বটেন) ¯েøাভেনিয়ান দার্শনিক ¯øাভো জিজেক। যাই হোক, স্বাধীনতা যে একপ্রকার ভয়ংকর রোগ একথা ফকির লালন জানতেন। শুধু যে মহাত্মা লালনই জানতেন বিষয়টা এমন না, এই ঘটনা জানতেন ভারতবর্ষের সমস্ত সাধু, গুরু, বৈষ্ণব, সহজিয়া, আউল, বাউল, ফকির, জৈন, সাংখ্যিক, চার্বাকি, নাথ, শৈব, শাক্ত, বেদান্তিক, বুদ্ধিস্ট, সুফি, সকলেই। এটা হল সেই রোগ যে রোগে মানুষ স্বেচ্ছায় ও অবচেতনে আক্রান্ত হয়, যা প্রকৃত অর্থে আপন মর্জিতে ফাঁদে পড়বার শামিল।
উল্লিখিত পুস্তকে জিজেক আমাদেরকে বিষয়টি পুনরায় মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বিপজ্জনক পরাধীনতা হলো সেই পরাধীনতা, যাকে আমরা ভুল করে স্বাধীনতা মনে করি। এই প্রসঙ্গে তিনি পপুলিস্টদের উদাহরণ টেনেছেন। এরা সামাজিক রীতিনীতিকে ভেঙ্গে ফেলে মুক্তির কথা বলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এক নতুন ধরনের পরাধীনতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন । তাঁর মতে, সত্যিকারের স্বাধীনতা কোনো আরামদায়ক বা সু-সামঞ্জস্যপ‚র্ণ অবস্থা নয়, বরং এটি একধরনের বিঘœকারী, এমনকি আত্ম-ধ্বংসাত্মক শক্তি, যা জৈব সুস্থতাকেও ভেঙ্গে দিতে পারে। সে আলাপে পরে যাচ্ছি।
কথা হচ্ছে, স্বাধীনতাকে জিজেক ‘রোগ’ হিসেবে দেখছেন কেন? স্বাধীনতা তো মানুষের স্বপ্ন। আরাধ্য। মানুষ তো সবসময় ভেবে এসেছে যে স্বাধীনতা মানে বাঁধনমুক্ত হওয়া, নিজের মতো করে বাঁচা, ইত্যাদি। জিজেক বলছেন, এই আকাক্সক্ষাই আসলে গড়পড়তা মানুষের তরফে একটি ভ্রান্তি। আজকের পৃথিবীতে পুঁজিবাদ এই ভ্রান্তিকে নতুন রূপ দিয়েছে। বাজার প্রতিদিন আমাদের সামনে হাজারো বিকল্প সাজিয়ে দিচ্ছে। যেমন, কোন ব্র্যান্ডের জামা পরব, কোন ফোন ব্যবহার করব, কোন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নিজেকে প্রকাশ করব, ইত্যাদি। মনে হয়, স্বাধীনতা মানে অসংখ্য‘চয়েস’ বা ‘পছন্দ।’ কিন্তু এই ‘পছন্দ’ আসলে তৈরি করা। ফেসবুক বা ইউটিউবের অ্যালগরিদম, অনলাইন শপিং সাইটের সাজানো বিজ্ঞাপন, কিংবা ইনফ্লুয়েন্সার কালচার- সবই আমাদের মনের গভীরে ঢুকে পছন্দের ভাষা ঠিক করে দেয়। আমরা ভাবি আমরা বেছে নিচ্ছি, অথচ আসলে আমাদের হয়ে বেছে নিচ্ছে বাজার। এ এক নিখুঁত ফাঁদ, যেখানে প্রত্যেকেই পুঁজির প্রোগ্রাম করা ভোগবাদের সুস্বাদু শিকার, এবং সেই ‘শিকার’ আবার মনে করে সে মুক্ত। তো এই তথাকথিত স্বাধীনতাকে কী প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ বলা যায়? না। এই দশার নাম দেয়া যায় ‘স্যুডো-স্বাধীনতা (চংবঁফড়-ভৎববফড়স অর্থে)।’
২.
এই আলাপের বিস্তারে নোয়াম চমস্কিকে হাজির-নাজির জ্ঞান না করলে পাপ হবে। কারণ, জিজেক যেখানে মতাদর্শ ও মনস্তত্তে¡র উপর ভিত্তি করে জানাচ্ছেন যে কেন আমরা পরাধীনতাকে স্বেচ্ছায় মেনে নিই এবং উপভোগ করি, সেখানে চমস্কি বলছেন কীভাবে প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের সম্মতি উৎপাদন করা হয়। চমস্কির মতে, আমাদের সম্মতি হলো একটি উৎপাদিত পণ্য, যা গণমাধ্যমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতনভাবে তৈরি করে। এই গণমাধ্যম কাদের মালিকানায় চলে, বিজ্ঞাপনের টাকায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতা কী, ‘বিশ্বস্ত স‚ত্র’ বলতে কাদের সঙ্গে সংবাদদাতা নিয়মিত ওঠাবসা করেন- এসব ফিল্টার মিলে এমন এক সম্পাদকীয় জড়তা তৈরি করা হয় যা রাষ্ট্র-কর্পোরেট স্বার্থকে স্বাভাবিক আর বিকল্প কণ্ঠকে ব্যতিক্রম বলে দাঁড় করায়। জনমত এমন সু²ভাবে ফ্রেমিং করা হয় যে নীতিগত প্রশ্ন ব্যাকগ্রাউন্ডে সরে যায়, আর সামনে থাকে ইস্যুর কসমেটিক দ্ব›দ্ব। কে একটু বেশি মানবিক, কে একটু কম কড়া, কারা ষড়যন্ত্র করছে, ইত্যাদি সচেতন বিষয় গড়পড়তা মানুষের অবচেতনে প্রতিস্থাপন করবার এই মডেলের নাম ‘প্রোপাগান্ডা মডেল।’ এই খেলাগুলো কিন্তু হচ্ছে একই বোর্ডে। এই পর্যায়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হিরক রাজার দেশে’র কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে জর্জ অরওয়েলের ‘এনিম্যাল ফার্ম’ ও ‘১৯৮৪’র কথাও। ১৯৮৪ সিনেমাও হয়েছে। আমার দেখা সেরা সিনেমার তালিকায় এটা উপরের দিকেই থাকবে। জিজেক এবং চমস্কিকে যুগপৎ বুঝতে হলে ১৯৮৪’র বিকল্প নাই বললেই চলে। চমস্কি হলেন সেই স্থপতি যিনি সম্মতি উৎপাদনের ফ্যাক্টরির নকশাটি আমাদের দেখান, অন্যদিকে জিজেক হলেন সেই মনোবিজ্ঞানী যিনি ব্যাখ্যা করেন কেন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে ভালোবাসে। আর অরওয়েল দুটো নির্মম কিন্তু মোলায়েম ঘটনাই সাহিত্যের স্তরে নিয়ে এসে সচেতন পাঠকের মনে রোপন করেন রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত নজরদারির আদর্শলিপি। ভাষা-ছাঁটাই ও সত্য-বিকৃতির মাধ্যমে মানুষ কীভাবে স্বেচ্ছায় অজান্তে নতি স্বীকার করে এবং শেষ পর্যন্ত ‘বিগ ব্রাদার’কে ভালোবেসে ফেলে সে খবর বিস্তারিত জানিয়েছেন অরওয়েল ১৯৮৪’তে। এটার জগৎসেরা ডায়ালগটি এখনো কানে বাজে- ‘ইরম ইৎড়ঃযবৎ রং ডধঃপযরহম ণড়ঁ.’
চমস্কির মনস্তত্ত¡ নিয়ন্ত্রণের এই বাহ্যিক ও কাঠামোগত দিকের বাইরে আরেক বিখ্যাত দার্শনিক জ্যাক দেরিদাকেও এইমুহূর্তে প্রয়োজন হবে আমাদের। জিজেক ও চমস্কি যখন দেখান কীভাবে আমাদের পছন্দ বা সম্মতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তখন দেরিদার তাত্তি¡ক কাঠামো এই মৌলিক প্রশ্ন তুলবে যে ‘পছন্দ’, ‘স্বাধীনতা’, বা ‘সম্মতি’ নামক শব্দগুলোর নেপথ্য অর্থ কী? তিনি দেখান, যে ভাষার মাধ্যমে আমরা চিন্তা করি, সেই ভাষাই এক ধরণের নিয়ন্ত্রণম‚লক কাঠামো তৈরি করে। কীভাবে? তিনি বলেন, এসব শব্দের অর্থ স্থির নয়। তারা সবসময় প্রসঙ্গ পিছলে যায়। দ্বৈত বৈপরীত্যে (স্বাধীনতা/পরাধীনতা, সত্য/মিথ্যা, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি) এসব শব্দেরা এক পক্ষকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যটিকে অবদমিত করে। অথচ প্রতিটি শব্দই নিজের বিপরীতের চিহ্ন বহন করে। ফলে ‘স্বাধীন পছন্দ’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাধ্যবাধকতার ছায়াও ঢুকে পড়ে; ‘সম্মতি’র ভেতরেও অসম্মতির ট্রেস রয়ে যায়, কারণ ভাষা নিজেই ক্ষমতার অভ্যাস শেখায়। দেরিদা আরও যোগ করেন, প্রকৃত সিদ্ধান্ত কখনো নিখুঁত হিসেব নয়, এটি আসলে ‘এপোরিয়া’র ভেতর দায় নিয়ে ঝাঁপ দেয়া। যখন ‘সঠিক’ বনাম ‘ভুল’-এর মতো সহজ বাইনারি থাকে না, তখন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে। দেরিদা এই অবস্থাকেই বলেন অঢ়ড়ৎরধ বা অপরিহার্য সংকট। এই সংকটের মুহ‚র্তে আমরা কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে পারি না। আমাদের প্রতিটি পরিস্থিতিকে তার নিজস্ব জটিলতায় বিচার করতে হয় এবং নিজের সিদ্ধান্তের জন্য সম্প‚র্ণ দায়িত্ব নিতে হয়। এই দৃষ্টিকোন থেকেই বোঝা যায় জিজেক প্রস্তাবিত জবরদস্তিম‚লক ‘পছন্দ’ প্রকৃত অর্থে সিদ্ধান্তের ছদ্মবেশ, এবং একই কথা খাটে চমস্কির ‘সম্মতি’র ক্ষেত্রেও। দেরিদা অবশ্য এই মনস্তাত্তি¡ক সমস্যার সমাধানের পথ খোলা রেখেছেন। তিনি প্রস্তাব করলেন যে এসব বিদ্যমান বাইনারি বিনির্মান করতে হবে। অর্থ্যাৎ, অর্থের এই ভাঙ্গনকে উন্মোচন করতে হবে এবং অবশিষ্ট যা থাকবে তা’ই হল দেরিদার বহুল আলোচিত উবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ ইরহধৎু বা বাইনারির বিনির্মাণ। প্রশ্ন উঠতে পারে যে ‘বাইনারি’ ভাঙার পর কী থাকবে? বাইনারির বিনির্মাণের পর শ‚ন্যতা বা বিশৃঙ্খলা (ঈযধড়ং) থাকবার কথা নয় কী? না। যা থাকে তা হলো আরও জটিল, গতিশীল এবং সম্ভাবনাময় এক জগৎ। দেরিদার বিনির্মাণ (উবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ) মানে ধ্বংস (উবংঃৎঁপঃরড়হ) নয়। এটি কোনো কাঠামোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং সেটিকে খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখা যে কীভাবে এটি তৈরি হয়েছে, এর ভেতরের লুকানো বিরোধগুলো কী এবং কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অন্যটিকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে।
বাইনারি ভেঙ্গে যাওয়ার পর যা যা অবশিষ্ট থাকে তন্মধ্যে প্রথমে আসবে দিফেরঁস (উরভভল্কৎধহপব) বা পার্থক্য ও বিলম্বের খেলা। এটা হল সেই ব্যাপার যেখানে দেরিদা বলেছিলেন যে কোনো কিছুরই একক ও স্থিতিশীল অর্থ থাকতে পারে না। প্রতিটি অর্থ তৈরি হয় অন্য কিছুর সাপেক্ষে, তার পার্থক্যের মাধ্যমে এবং সেই অর্থ প্রাপ্তি সব সময় বিলম্বিত হয়। উদাহরণে বিষয়টা স্পষ্ট হতে পারে হয়তো। যেমন, দিন/রাতের বাইনারি ভেঙে গেলে ‘দিন’ এবং ‘রাত’ ধারণা দুটি মুছে যায় না। বরং আমরা বুঝতে পারি যে ‘দিন’-এর অর্থ বুঝতে গেলে ‘রাত’-এর ধারণা দরকার, এবং উল্টোটাও। একটির মধ্যে অন্যটির চিহ্ন (ঞৎধপব) থেকে যায়। অর্থাৎ, দুটি ভিন্ন জগৎ না থেকে একটি অবিচ্ছেদ্য, গতিশীল সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকে যেখানে অর্থ স্থির নয়, বরং অনবরত তৈরি হচ্ছে। তারপর, দেরিদা জটিলতা এবং বহুত্বের (ঈড়সঢ়ষবীরঃু ধহফ চষঁৎধষরঃু) আলাপ তুলেছেন। বিদ্যমান বাইনারি ভেঙে গেলে আমরা দেখতে পাবো যে বাইনারির (ভালো/মন্দ, সাদা/কালো, পুরুষ/নারী, সভ্য/অসভ্য, ইত্যাদি) দুটি চরম বিন্দুর মাঝে রয়েছে অসংখ্য স্তর, শেড এবং সম্ভাবনা। যেমন, পশ্চিমের কোনো কোনো দেশে ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’ বাইনারি বিনির্মিত হয়েছে, কিন্তু বিনির্মাণের ফলে লিঙ্গ ধারণাটি মুছে যায়নি। বরং এর মাঝে ও বাইরে থাকা অসংখ্য পরিচয় (যেমন: ঘড়হ-নরহধৎু, এবহফবৎভষঁরফ, ছঁববৎ) স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীটা দ্বি-মাত্রিক না থেকে বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। বাইনারির দেয়াল ভেঙে গেলে এমন সব নতুন চিন্তা, শিল্পকলা এবং রাজনীতির সম্ভাবনা তৈরি হয় যা আগে ভাবা যেত না। যে ধারণাগুলোকে ‘প্রান্তিক’ বা ‘অস্বাভাবিক’ বলে দমন করে রাখা হয়েছিল, সেগুলো আলোচনায় আসার সুযোগ পায়। এটি চিন্তার জগৎকে মুক্ত করে।
বগা ও ফাঁদের বাতেনি খেল বুঝতে হলে মিশেল ফুকো'কেও লাগবে আমাদের। কারণ, তিনি ক্ষমতা (চড়বিৎ) কীভাবে কাজ করে, সেই ধারণাকেই আম‚ল বদলে দিয়েছেন। জিজেক, লাকাঁ, দেরিদা বা চমস্কি- তাঁরা ম‚লত ক্ষমতা কীভাবে আমাদের অবচেতন, ভাষা বা সম্মতির উপর কাজ করে তা দেখিয়েছেন। ফুকো এই আলোচনাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে দেখান, ক্ষমতা কেবল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় না, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে, যেমন, হাসপাতাল, স্কুল, কারাগার, এমনকি আমাদের যৌনতার ধারণার মধ্যেও ছড়িয়ে আছে এবং অজান্তেই এসব বিষয় আমাদের তথাকথিত স্মার্ট ও আধুনিক অস্তিত্ব নির্মাণ করে। ফুকোর মতে, ক্ষমতা শুধু ‘না’ বলতে জানে না, এটি ‘হ্যাঁ’ বলতেও পারদর্শী। এর মানে হলো, ক্ষমতা শুধু দমন করে না, বরং এটি নতুন জ্ঞান, নতুন পরিচয় এবং নতুন বাস্তবতা তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে, উনিশ শতকে মনস্তত্ত¡বিদ্যা কীভাবে ‘স্বাভাবিক’ ও ‘অস্বাভাবিক’ মানুষের ধারণা তৈরি করেছিল, তা ভাবা যেতে পারে। মনস্তত্ত¡বিদ্যা কোনো সত্যকে গোপন করেনি, বরং নিজেই একটি নতুন ‘সত্য’ তৈরি করেছে। তিনি দেখান যে, জ্ঞান এবং ক্ষমতা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জ্ঞান ক্ষমতাকে জন্মদেয় এবং ক্ষমতা নতুন জ্ঞানকে বৈধতা দেয়। তিনি একে ‘জ্ঞান-ক্ষমতা’ (কহড়ষিবফমব-চড়বিৎ) বলেছেন। আমরা যাকে ‘ডিসকোর্স’ বা ‘বক্তৃতা’ বলি, তা আসলে এই জ্ঞান-ক্ষমতারই প্রতিফলন। যেমন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ডিসকোর্স নির্ধারণ করে দেয় স্বাস্থ্য এবং অসুস্থতা নিয়ে আমরা কীভাবে কথা বলব। এই ডিসকোর্সের বাইরে কোনো কথা বললে তা সহজেই ‘অবৈজ্ঞানিক’ বা ‘ভুল’ বলে বাতিল হয়ে যায়।
ফুকো ক্ষমতাকে বোঝার জন্য জেরেমি বেন্থামের ‘প্যানঅপ্টিকন’ মডেলটি ব্যবহার করেন। এটি এমন এক কারাগার, যেখানে কয়েদিরা জানে না তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে কি না, কিন্তু এই সম্ভাব্য নজরদারির ভয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফুকো বলেন, আমাদের আধুনিক সমাজটাও একটি বিশাল প্যানঅপ্টিকন। স্কুল, হাসপাতাল, অফিস- সর্বত্র আমরা অদৃশ্য নজরদারির ভয়ে নিজেরাই নিজেদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখি। আমরা নিজেরাই নিজেদের পাহারাদার হয়ে যাই, যা আমাদের পরাধীনতাকে আরও কার্যকর করে তোলে। তিনি আরও একটি গুরুত্বপ‚র্ণ ধারণা দিয়েছেন, যার নাম ‘বায়োপাওয়ার’। তিনি বলেন, আধুনিক ক্ষমতা শুধু ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, এটি পুরো জনগোষ্ঠীকেও পরিচালনা করে। রাষ্ট্র জন্ম-মৃত্যুর হার, স্বাস্থ্য এবং গড় আয়ুর মতো পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পুরো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি আমাদের জীবন এবং স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাঁর দর্শন আমাদের বাধ্য করে প্রশ্ন করতে যে, আমরা যা ভাবি, যা বলি এবং যা করি, তা কি সত্যিই ‘আমাদের’? নাকি কোনো অদৃশ্য ক্ষমতার উৎপাদন?
৩.
অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে আজকের আলাপটি পাঠ করলে এতোক্ষণে ‘বগা’ ও ‘ফাঁদ’ শব্দদ্বয় বোধের গভীরে উপলব্ধ হবার কথা৷ এই বগা আসল বগা নয়, এই বগা ম‚লত ‘শিকার’। পুঁজিবাদী বাজারী সংস্কৃতির ‘শিকার।’ বিস্মৃত গীতিকারগণ এই ঘটনাকে মানবজীবনের নিদারুণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন পাকা জ্যোতিষির মত। এঁরা দেখিয়েছেন মানুষ নামের বগারা আসলে বিবিধ অদৃশ্য ফাঁদের ভেতরে বন্দি। মানুষের অস্তিত্বের এই গভীর সত্য, অর্থ্যাৎ, যে ফাঁদকে আমরা স্বাধীনতা ভেবে উদযাপন করি, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি।
উল্লিখিত পশ্চিমা দার্শনিকদের ভাবনাকে প্রাচ্যের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলেই ফকির লালন আবির্ভ‚ত হতে বাধ্য। লালন এই সমস্ত দার্শনিক ধারণার এক জীবন্ত ও প্রাচ্যীয় প্রতিউত্তর। ফুকো, জিজেক এবং লাকাঁ যেখানে ‘অপর’ (ইরম ঙঃযবৎ) বা সমাজের নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কথা বলেন, লালন তাকেই ‘জাত’, ‘শাস্ত্র’ বা ‘প্রচলিত বিধান’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ গানের এই চরণ সেই ‘অপর’ বা নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার এক সাহসী উচ্চারণ। লালনের ‘অচিন পাখি’ হলো সেই সত্তা যা ফুকো বা লাকাঁর নির্মিত পরিচয়কে অস্বীকার করে এক গভীরতর আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেয়।
জিজেক যখন বলেন আমাদের ‘পছন্দ’ করার স্বাধীনতা আসলে একটি বিভ্রম, তখন তিনি পুঁজিবাদী সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা লালন কথিত মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদকেই উন্মোচন করেন। এই পছন্দগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে আমরা যাই বেছে নিই না কেন, তা শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান ব্যবস্থা বা সিস্টেমকেই টিকিয়ে রাখে। জিজেকের ভাষায়, আমরা আসলে এক ধরনের ‘জবরদস্তিম‚লক পছন্দ’-এর (ঋড়ৎপবফ ঈযড়রপব) শিকার। তাহলে কি আমাদের তথাকথিত স্বাধীনতা একটি বিভ্রমে মোড়ানো স্যুডো-স্বাধীনতা বা রোগ নয়? এই আলাপের একটি চ‚ড়ান্ত পথনির্দেশ দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনিও প্রচলিত স্বাধীনতা নামক ভয়ংকর ক্রনিক রোগটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর ‘তোতাকাহিনী’ বা ‘অচলায়তন’ তাই হয়ে উঠে ফুকো-প্রস্তাবিত প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। তিনি দেখিয়েছেন, শিক্ষা যখন সৃজনশীলতা নষ্ট করে, তখন তা কেবল তথ্যের ভারে তোতাকে মেরে ফেলে। বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার কথা বলেছেন, যা জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি মনে করতেন, মানুষের মধ্যে এক ধরনের ‘উদ্বৃত্ত’ আছে, যা শুধু মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়; শিল্প, সাহিত্য, প্রেম এবং সৌন্দর্যের জন্যও বটে। এই উদ্বৃত্তই হলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।
আগেই উল্লেখ করেছি যে ফকির লালনের মত অপরাপর নিঃসঙ্গ ধ্যানি সহজ ধারার সোনার মানুষেরা ওই স্যুডো-স্বাধীনতা বা রোগটির বিষয়ে আপাদমস্তক জানতেন। ‘ও সাঁই নিকট থেকে দ‚রে দেখা/ কেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দেখ না’- লালনের এই পংক্তিতেই প্রমান হয় যে স্যুডো-স্বাধীনতা নামক রোগটি কী দারুণ উপায়ে চোখে ধুলো দেয়। এই ক্রনিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়ও জানতেন তাঁরা। উপায়টি কী? এঁরা বলেন ‘মনের মানুষ’ মিললেই স্যুডো-স্বাধীনতা নামক রোগ থেকে মিলবে আসল মুক্তি। এই অধরা, অ-সার্বজনীন ‘মনের মানুষ’ নামক অভ্যন্তরীণ সত্তার ধারণার সঙ্গে জিজেক-প্রস্তাবিত সত্তার সাংবিধানিক শ‚ন্যতার আলাপ গভীরভাবে সাদৃশ্যপ‚র্ণ। জিজেকের লাকাঁনীয় কাঠামোতে সত্তা কোনো প‚র্বনির্ধারিত ‘ঝবষভ’ নয়, বরং ঝরমহরভুরহম ঈযধরহ-এ একটি অভাব (খধপশ)। এটি একটি শ‚ন্য স্থান যা স্বাধীনতার শর্ত। মনের মানুষ এবং অচিন পাখির লালন-বয়াণ জিজেকের বিশুদ্ধ স্বাধীনতার অতল গহ্বরের সঙ্গে মিলে যায়, যা অর্জন করা হয়তো সহজে সম্ভব নয়; লাকাঁর মতে এটাই ‘রিয়েল।’ এটা এমন এক ঝরহমঁষধৎরঃু যা হঠাৎ করে আবির্ভ‚ত হয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। নজরুলের ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ টাইপের গানগুলো যে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার কথা বলে সেগুলোর অভ্যন্তরীণ সত্তাও এই একই সিঙ্গুলারিটি এবং লালনের ‘মানুষ রতন’-এর সঙ্গে সাযুজ্যপ‚র্ণ। এটি হলো সেই শ‚ন্যতা, সেই নির্দিষ্ট পরিচয়ের অনুপস্থিতি, যেখানে প্রকৃতই চরম স্বাধীনতার ক্ষেত্র রচিত হয়, এবং যা কথিত সেই স্যুডো-স্বাধীনতার সম্প‚র্ণ বিলুপ্তি ঘোষণা করে।
‘মাঝেমাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’- এটাই হলো স্যুডো-স্বাধীনতা বা পুঁজিবাদের বিবিধ ফাঁদকে অতিক্রম করবার রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবকৃত প্রাচ্য-ঔষধি। এই ঘটনা বুঝতে পারবার ভেতর দিয়েই ‘জ্যান্তে মরা’ মানুষের সাধনাকে একনলেজ করতে হবে যাতে বিশ্বব্যাপি পুঁজির উপভোগ্য ক্ষতকে উপশম করবার একটি প্রক্রিয়া হিসাবে পুনর্র্নিমাণ করা যায়। আরও বুঝতে হবে যে ‘গভীর নির্জন পথে’র এইসব সাধকদের মনের মানুষের জন্য নিরন্তর অনুসন্ধান কোনো প‚র্ব-বিদ্যমান দেবতাকে খোঁজে না। বরং এই অনুশীলন হল সত্তার কেন্দ্রস্থলে বিদ্যমান শ‚ন্যতার মুখোমুখি হওয়ার প্রাচ্য প্রক্রিয়া। জিজেকীয় ভাষায়, এটি হলো সেই সত্তার খধপশ বা অভাবকে গ্রহণ করা, যা আকাক্সক্ষাকে তার কাঠামো দেয়। কিন্তু পার্থক্য হলো, জিজেক যেখানে এই রোগকে অবশ্যম্ভাবী বলেন, লালন ও অন্যসব সহজিয়া মানুষেরা সেখানে পথ দেখান। ফাঁদের ভেতর থেকেও যে মুক্তির সম্ভাবনা আছে, সে কথা লালন বলেন গানে গানে, ‘একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা...ও সেই অমৃত সাগরের সুধা, সুধা খাইলে জীবের ক্ষুধা-তৃষ্ণা রয় না।’ অর্থ্যাৎ, নিজেকে উপলব্ধি করা (যদি কেউ নিজেকে চিনতে পারে, তবেই সে এই অমৃত সাগরের সুধা বা ‘মানুষ রতন’ লাভ করে) মানে হলো নিজের শ‚ন্যতাকে আলিঙ্গন করা। দেখেন, সক্রেটিসও এখানে ‘কহড়ি ঞযুংবষভ’ রব তুলে দ্রষ্টার মত হাজির হয়ে যান।
৪.
আরেকটা ব্যাপার মাথায় এলো। ‘পছন্দ’ কেবল পুঁজিবাদ বা বাজারই নির্ধারণ করে দিচ্ছে তা নয়, ‘পছন্দ’ নির্ধারণের পেছনে আরও কিছু মতাদর্শের জারিজুরি আছে। বছরখানেক ধরেই দেখছি কতিপয় উগ্রবাদীরা নিরুপদ্রব একাকী সহজপন্থী মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বিঘ্নিত করছে এবং জোরপ‚র্বক মাথার কেশ কর্তন করে তাঁদের বিশ্বাসকে আঘাত করছে। এই যে এরা এসব করে বেড়াচ্ছে তথাকথিত-বিপথগামী মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার নামে; এই ‘পছন্দ’ বা এই সংস্কারবোধ তাদের মগজে কী করে তৈরি হল? তাদের এই ‘পছন্দ’ইবা কিভাবে সামাজিক মৌন অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে? আপামর জনসাধারণ এইসব অনাচারের এই যে মৌন বৈধতা দিচ্ছে সেই ‘পছন্দ’ জনসাধারণের তরফে কী করে উৎপাদিত হল? এইসবও ভাবতে হবে। গভীরভাবে ভাবতে হবে।
৫.
এই লেখা নাজিল হল ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০-এর একটি পোস্টের স‚ত্রে। ফেসবুক মেমোরির বদৌলতে পোস্টটি সামনে এলো।
পোস্টটি এই:জীবন এক বৃহৎ মোহনীয় ফাঁদ। এ-কথা বলতেই-
ভেতর থেকে শতকোটি বহুমাত্রিক ফাঁদ উল্লাসে ফেটে পড়লো। জীবন মাত্রেই বহুরঙ্গা ফাঁদ। এ-কথা যোগ করতেই ভেতরে জিকির বসলো। ফাঁদ থেকে ফাঁদে নিরন্তর আসা-যাওয়া সকলের। এই এতটুকু যোগ করতেই জানা গেলো নিজেকেই তো হয় নাই চেনা। হয় নাই জানা। অতঃপর আরেকটু যোগ করতেই একদিন মৃত্যু নামের বিয়োগান্তক ফাঁদে না-চাইতেও ঢুকে পড়তে হলো। নিরানন্দ ধামে আনন্দের দেখা হলো না রে হলো না। নকল কায়সার, নিত্য খোলে রিপুর বাজার, তাই তো আসল মিললো না।
লেখক: চিকিৎসক। অনকোলজি গবেষক। চিন্তক।
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫; চীন