আজ সেই ভয়াল ৪ আগষ্ট। গত বছরের এ দিনে আবু বকরকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়।
সারা
দেশের ন্যায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
চলছিল কুমিল্লার দেবিদ্বারে। এতে শত শত শিক্ষার্থীর সঙ্গে অংশ নেয় এসএসসি
পরীক্ষার্থী আবু বকর। আন্দোলনের ব্যানারের একটি ছবিতে সামনের সাঁড়িতে দেখা
যায় তাকে। খবর পেয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা হকিস্টিক, রামদা, রড,
গ্যাসপাইপ নিয়ে নিরস্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তারা আবু
বকরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতারি কুপিয়ে মাথার বাঁ পাশের খুলি আলাদা করে
ফেলে। এতে তার মস্তিষ্কে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। বিচ্ছিন্ন করে ফেলে হাত ও
পায়ের রগ। নৃশংস এ দৃশ্য দেখেন আশ-পাশের ভবনের ছাদ থেকে নারী-পুরুষরা। তখন
কেউ কেউ মোবাইলে এই দৃশ্য ধারণ করেন, আবার কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বলছিলেন ‘আর
মারিস না তারে আর মারিস না, ‘মইরা যাইব’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। আবু
বকরকে মৃতভেবেই রাস্তায় ফেলে যায় তারা। এরপর কয়েকজন লোক তাকে তুলে
দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা
শেষে নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরে অবস্থা
আশঙ্কাজনক হওয়ায় নেওয়া হয় কুমিল্লা ট্রমা হাসপাতালে। সেখানে দুই মাস
চিকিৎসার পর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের
হাই ডিপেন্ডেসি ইউনিটে (এইচডিইউ) নেওয়া হয়। সেখানে টানা তিনমাস চিকিৎসা
দেওয়া হয় তাকে। তখন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ
ইউনূস হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে আবু বকরের খোঁজ খবর নেন এবং সরকারি খরচে
চিকিৎসা করানোর নির্দেশ দেন। এর গত তিন মাস আগে তাকে তার গ্রামের বাড়ি
শাকতলায় নিয়ে আসা হয়। ঘটনার এক বছর পার হলেও আবু বকর এখনো কথা বলতে পারছে
না।
আহত আবু বকর (২২) কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার দক্ষিণ গুনাইঘর
ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের মো. আবুল খায়েরের ছেলে। সে একই ইউনিয়নের মাশিকাড়া
উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
গত
মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের বাড়ি শাকতলায় গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে আছেন
আবু বকর। হাতের একটি মোবাইল তাকে মারধরের পুরানো ভিডিও দেখছেন। নাম জানতে
চাইলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, কোন রকম আব্বা আম্মা বলতে পারলেও আর
কোন শব্দ বলতে পারছে না। আবার আন্দোলনে যাবে কিনা প্রশ্ন করায় মুচকি হেসে
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন আবু বকর।
আহত আবু বকরের মা রাবেয়া বেগম বলেন,
ছেলেটা কথা বলতে পারছে না, মাঝে মাঝে কাউকে চিনতে পারে না, গোসল করাই দিতে
হয়, খাওয়াই দিতে হয়। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে, কিছু বললে চেয়ে থাকে,
মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে কান্নাকাটি করে। আমার বড় ছেলে লিভার ক্যান্সারে
আক্রান্ত, ছোট ছেলে এ অবস্থা। যা কিছু ছিল তা বিক্রি করে দুই ভাইয়ের
চিকিৎসা করাইছি। এখন আর পারি না। তাকে ৬ মাস হাসপাতালে রেখে বাড়ি নিয়ে
আসছি। এখনও তার অনেক চিকিৎসা বাকি রয়েছে। তাকে যদি বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা
করানো যেত তাহলে মনে আমার ছেলে ভালো হতো।
আবু বকরের বড় ভাই মো. আলী
বলেন, আমি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমার চিকিৎসাই চলে না। এরপর ছোট
ভাইয়ের এ অবস্থা। ভাইটা আগে কথা বলতে পারত এখন পারে না, শুধু আব্বা-আম্মা
বলতে পারে। কথা বলতে না পারার নিরব আর্তনাদ দেখতেছি চোখের সামনে। হাহাকার
করে বুক কেপে উঠে। তার অনেক চিকিৎসার প্রয়োজন, আমার পরিবারের শেষ
সম্বলটুকুও আরও নেই যে বিক্রি করে চিকিৎসা করাব। তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা
করালে আগের মত করে কথা বলতে পারবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারিভাবে দুই
লাখ টাকা পেয়েছি। এগুলো তার চিকিৎসার খরচে ব্যয় করা হয়েছে। আমার ভাইয়ের
ভাতার তালিকায় তাকে সি ক্যাটাগরি দেয়া হয়েছে,আমরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে
যোগাযোগ করার পর তারা বলছেন জেলা সিভিল সার্জন অফিসে যোগাযোগ করার জন্য।
আমরা সেখানেও যোগাযোগ করি, সিভিল সার্জন অফিসে আমরা কাগজপত্র জমা দেই, তারা
বলছেন বিষয়টা দেখবেন, কিন্তু আজও কোন খবর পায়নি।
দেবিদ্বার উপজেলা
নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খাঁন বলেন, আমরা আবু বকরের
পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে।
জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আবু বকরকে সহযোগিতা করা হয়েছে। আমরা তার উন্নত
চিকিৎসার বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী
নুর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ বলেন, ক্যাটাগরি সিলেক্ট করার জন্য একটি মেডিক্যাল
বোর্ড বসে ওই বোর্ড এসব ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে। সে যদি সি ক্যাটাগরিতে
লিষ্ট হয়ে থাকে আমি এটা কিভাবে হলো আমি খোজ নেব। আপনারা তার পরিবারের কাউকে
আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলিয়েন।
