ফিলিস্তিনি
ও ইসরায়েলি হত্যার সাম্প্রতিক এ ঘটনার দায় শুধু হামাস ও নেতানিয়াহু
সরকারের নয়, রক্তের দাগ পশ্চিমাদের হাতেও লেগে রয়েছে। এটা সত্যি যে,
ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার সন্নিকটে ইসরায়েলি বসতিতে
হামলা চালিয়েছেন। কিন্তু এ হামলা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকে শুরু হয়নি,
কিংবা আগে থেকে সতর্কতাও ছিল না। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা কোনো প্ররোচনা
দেয়নি। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারগুলো ভালো করেই জানে, গাজার
ফিলিস্তিনিদের প্রকৃতপক্ষে কতটা প্ররোচিত করা হয়েছে।
কেননা, এসব সরকার
দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান
চালিয়ে আসছে, তাতে সমর্থন দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিদের তাদের জন্মভূমি থেকে
বিতাড়ন এবং বাকি যারা আছেন, তাদের বসতিতে বন্দি করে রাখার ঘটনায় পশ্চিমা
সরকারগুলো সমর্থন আছে। ইসরায়েলের এসব অপরাধ সম্পর্কে ঠিক সময়েই জানতে
পেরেছে পশ্চিমা সরকারগুলো। নিজেদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গোপন তারবার্তায়
এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে তারা জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্র
ইসরায়েলের অপরাধের কথা জেনে আসছে। নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার
সংগঠন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনটি
পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি
গণহত্যার ভয়ানক চিত্র ফুটে উঠেছে।
আরও সঠিকভাবে বললে, এতদিন যেটা
দৃশ্যত স্পষ্ট ছিল, এখন তারা নিশ্চিত করেছে, গত ১৪ মাস ধরে ইসরায়েল সামরিক
অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে। একই সময়ে
অনাহারে রেখে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুমুখে পতিত করেছে। এমনকি তাদের চিকিৎসা
পর্যন্ত করাতে দেয়নি। গ্যাস চেম্বারের বিষ দিয়ে কিংবা ছুরি দিয়ে গণহত্যা
সংঘটিত হতে পারে। অথবা ২০০০ পাউন্ড বোমা ফেলে কিংবা সাহায্য বন্ধের
মাধ্যমেও গণহত্যা ঘটানো যায়। গণহত্যা যেভাবেই ঘটুক, এর উদ্দেশ্য একটি
জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও
মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)- এই তিনটি সংস্থা এ ব্যাপারে একমত,
এই নির্মূলের চেষ্টাই করছে ইসরায়েল।
গত বছরের শেষ সপ্তাহে এমএসএফ একটি
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম: ‘গাজায় মৃত্যুফাঁদে যে জীবন’।
সংস্থাটি পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘ইসরায়েলি বাহিনীর সহিংসতা এমন মাত্রায়
শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; চিকিৎসা দিয়ে ভালো করা কঠিন। ১৭
বছরের দীর্ঘ অবরোধ দিয়ে ইসরায়েল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে।’
এমএসএফের ভাষায়- ইসরায়েল যদি আজ এই আক্রমণ বন্ধ করে, ধ্বংসের মাত্রা
বিবেচনায় এটা চিন্তা করাও কঠিন যে, গাজাবাসীর তা সারাতে ঠিক কত সময় লাগবে।
এমএসএফের
১৮৫ পাতার পর্যবেক্ষণের পরই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়,
যেখানে সংস্থাটি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, ইসরায়েল গণহত্যামূলক কাজ করছে। একটি
নীতিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে যে, ইসরায়েল গাজাবাসীকে পানির অধিকার থেকে
বঞ্চিত করার পদ্ধতিগত চেষ্টা চালিয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক এই কর্মকাণ্ডের
সাহায্যে যে গণমৃত্যু ঘটেছে, সেটা জেনোসাইড। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের
মধ্যপ্রাচ্যের ডিরেক্টর লামা ফাকিহ বলেছেন, তাদের গবেষণায় প্রমাণিত,
ইসরায়েল ইচ্ছাকৃত গাজাবাসীকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি না দিয়ে
হত্যা করছে। ইসরায়েল চারটি পদক্ষেপের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে এটি করেছে। তারা
গাজার বাইরে থেকে পানি সরবরাহকারী পাইপলাইন বন্ধ করেছে।
এরপর গাজার
নিজস্ব কূপ ও প্লান্ট থেকে পাম্পের মাধ্যমে যাতে পানি সরবরাহ করতে না পারে,
সে জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়। এমনকি তারা সৌর প্যানেল ধ্বংস করে, যা ছিল
বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা ও সর্বশেষ বিদ্যুৎ মেরামতকারী ক্রু ও পানি
সরবরাহে চেষ্টাকারী সংস্থার কর্মীদেরও তারা হত্যা করে। ইসরায়েল এবং
ফিলিস্তিন-বিষয়ক এইচআরডব্লিউর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিল ভ্যান এসভেল্ড
বলেছেন, ‘গাজাবাসী যাতে পানি না পায়, সে জন্য ‘সর্বতোভাবে পানি পেতে বাধা
দেওয়ার নীতি তারা গ্রহণ করে।’ এইচআরডব্লিউর কণ্ঠই প্রতিধ্বনিত হয়েছে
বিশ্বের খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনালের বিস্তৃত প্রতিবেদনে। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত ২৯৬
পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, ইসরায়েল গাজায়
বেপরোয়াভাবে ক্রমাগত গণহত্যা চালাচ্ছে।
অ্যামনেস্টি এই গবেষণা করেছিল
জুলাই মাসে তথা প্রায় পাঁচ মাস আগে। এর পরও ইসরায়েল উত্তর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ
আরও জোরদার করেছে, যাতে সেখানকার নাগরিকদের জোর করে বের করে দেওয়া যায়।
অ্যামনেস্টি তাদের আচরণের ধরন বর্ণনায় লিখেছে, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ
সাহায্য ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধা দেয় এবং ছিটমহলের মতো ছোট্ট পরিসরের গাজায়
এত বেশি বিস্ফোরক দ্রব্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, যা দুটির বেশি পারমাণবিক
বোমা বিস্ফোরণতুল্য। যে কারণে গাজার পানি, পয়োনিষ্কাশন, খাদ্য ও
স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ধসে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা এত বেশি ছিল, সংস্থাটি এটি
বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, যেখানে একুশ শতকের অন্য কোনো সংঘাতের তুলনায় এর
গতি, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের তুলনাই চলে না। অ্যামনেস্টি বলেছে, গত মে মাসে
রাফায় ইসরায়েল নিরাপদ জোনে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাতেই এর জেনোসাইডের
অভিপ্রায় প্রমাণ হয়ে যায়। এমনকি ইসরায়েলকে তখন বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসও (আইসিজে) রাফায় আক্রমণ করার জন্য সতর্ক
করেছিল; কিন্তু ইসরায়েল তা মানেনি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও নেতারা
ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য বোঝা হিসেবে আখ্যায়িত করে
বলেছেন, ইসরায়েলের নেতারা তাদের পথ হারিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে,
তাহলে কী ইসরায়েলকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার সময় এখনো আসেনি?
কোনো দেশের গায়ে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর তকমা সেঁটে দেওয়ার একটি জঘন্য
ইতিহাস রয়েছে। যেসব দেশকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়া
হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে, সেসব দেশকে ঘায়েল করতেই এই শব্দবন্ধকে
অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় ও
মদদের কারণে ইসরায়েল সত্যিকারের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। তবে কানাডা,
নেদারল্যান্ডস, জাপান, স্পেন ও বেলজিয়ামের মতো দেশ ইসরায়েলের এই আচরণের
কারণে তেল আবিবের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেছে। এ থেকে বোঝা যায়,
ইসরায়েলের দুর্বৃত্তায়নকে প্রভাবশালী দেশগুলো স্বীকার করতে শুরু করেছে। মনে
হচ্ছে, যে কারও পক্ষে আশা করা সম্ভব, খুব শিগগির ইসরায়েল তার মিত্রদের
কাছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অসহনীয় বোঝা হয়ে পড়বে এবং এটিই
ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ খুলে দেবে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক