দুই বা তিন
বছর বয়সের শিশু যে বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে যায়; সেই স্কুলকেই কেন্দ্র করে
যদি সংস্কার ভাবনাগুলো করি তাহলে কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে?
প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি বিবেচনায় আনতে হবে তা হচ্ছে তিন বছর বয়সের
মধ্যে একটা শিশুর মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ গঠিত হয়। এখন এই তথ্যটি বিবেচনায়
রেখেই শিশুর প্রয়োজনীয় শিক্ষা, পরিবেশ, অ্যাক্টিভিটির ডিজাইনগুলো করতে হবে।
ডিজাইনের
শুরুতেই শিশুর পারিবারিক পরিবেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে স্কুল
কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখাতে হবে। এর মধ্যে শিশুর
খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টি, বাড়িতে সময় কাটানোসহ অন্যান্য আরও কিছু বিষয় থাকা
দরকার। কেন? এর ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া যেতে পারে-
একজন শিশুর বেড়ে ওঠার
ক্ষেত্রে সামগ্রিক দিকগুলো বিবেচনায় আনতে হয়। এর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক
বিকাশ, শারীরিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ, আবেগিক বিকাশ ও ভাষাগত বিকাশ-এগুলো
চলে আসে। এখন শিশু কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে তার একটা ধারণা স্কুল কর্তৃপক্ষ
রাখলে শিশুর বিকাশের সাথে বর্তমান অবস্থার একটা চিত্র খুব সহজেই আঁকা যায়।
শিশু
কোন অবস্থায় আছে, তাকে কোন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে, বিলম্ব হলে তার কারণ
অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় শ্রেণিভিত্তিক সাপোর্ট সবই ডিজাইন করা সম্ভব।
কাজেই সামগ্রিক বিকাশের দিকগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই সাপোর্টিভ তথ্যগুলো
রাখার প্রয়োজন হবে।
ডিজাইনের দ্বিতীয় ধাপে আসতে পারে লার্নিং এর জন্য
সিলেবাস ও প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল ডিজাইন। সাধারণত বেসরকারি স্কুলগুলোর
নিজস্ব সিলেবাস তৈরি করার একটা স্বাধীনতা থাকে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় লেটার
লার্নিং, এলফাবেট লার্নিং, নম্বর, শেপস, কালারসহ কিছু বাংলা ও ইংরেজি ছড়া
অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন এগুলোই কি এ বয়সের একমাত্র
প্রয়োজনীয় শিক্ষা?
এগুলো দিয়েই কি শুরু হবে? বা শুরু হলেও কীভাবে? কার
জন্য কেমন করে? কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে? কোন ধরনের শিক্ষকের
তত্ত্বাবধানে? কোন পরিবেশে? লার্নিং গ্রোথ এর জন্য কেমন পরিকল্পনা করে?
অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে।
বেশিরভাগ
প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রচুর আর্ট এবং ক্রাফট এর
কাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করেন। এগুলো ব্যয় সাপেক্ষ। কাজেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের
চেয়ে খরচ বহন করতে পারেন এমন সামর্থ্যবান অভিভাবকদের শিশুদের জন্য এগুলো
প্রচুর পরিমাণে রাখা হয়। এর একটা বড় কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এটা বেশ
ভিজিবল একটা বিষয়।
অর্থাৎ শিশু যে শিখছে বা কী, কীভাবে সেটা এই আর্ট এবং
ক্র্যাফট এর মাধ্যমে অভিভাবকদের সাথে কমিউনিকেট করা সহজ হয়। এর পাশাপাশি এ
বয়সের শিশুরা কমিউনিকেশনে অতটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারে না বলেও আর্টের ভাষাকে
কমিউনিকেশন এবং লার্নিং এর ভাষা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। কাজেই নানাভাবেই
ভেবে দেখার সুযোগ আছে।
আমি বলতে চাইছি, আরও অনেক কিছুই করার সুযোগ আছে।
ইদানীং কিছু জায়গায় আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন
অনেকেই ভিন্নভাবে সেন্টারে লার্নিং সিলেবাস বা ম্যাটেরিয়াল ডিজাইনের কথা
ভাবেন। এর মধ্যে পানি, বালিসহ অনেক কিছুই চলে আসে। এটা ভালো কিন্তু এখানেও
ঠিক কতটা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারছি আমরা?
এখানে কি আমরা বিজ্ঞানের নানা
এক্সপেরিমেন্ট যুক্ত করতে পারছি? শিশুর বয়সসহ নানা দিকগুলো বিবেচনায় আনতে
পারছি? এটা অনুধাবন করতে পারছি কি না বিজ্ঞান ভিত্তিক অ্যাক্টিভিটি একজন
শিশুকে শৈশব থেকে কৌতূহলী করে তোলে? সিলেবাস, ম্যাটেরিয়াল ও পরিবেশে একুশ
শতকের উপযোগী বিষয়গুলো আনতে গেলে ভিন্নভাবে দেখা ছাড়া আর অন্য কোনো গতি
কিন্তু নেই!
ডিজাইনের পরবর্তী ধাপগুলোয় আসতে পারে শ্রেণিতে শিক্ষার্থী
অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা। শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের বসার ও খেলার
জায়গার পরিকল্পনা, বোর্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনা, স্কুল ড্রেস
নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভাবনা, অভিভাবকদের সাথে সমন্বয় করে কাজ, লার্নিং গ্রোথ
নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাবা ও মা এর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, এলাকা ভিত্তিক
বা জেলা ভিত্তিক বা বিভাগ ভিত্তিক নানা রকম বিশেষ অ্যাক্টিভিটির
পরিকল্পনা, ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা, পারফর্মিং আর্ট
এর সংযোজন, উপস্থাপন বা প্রেজেন্টেশন ভিত্তিক কনটেন্ট, শ্রেণিতে আলো ও
ছায়ার নানা রকমের প্রয়োগ, সমস্যা সমাধানের নানা রকমের উপায় নিয়ে ভাবনার
সুযোগসহ আরও অনেক কিছু!
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুব আকাশকুসুম বলে মনে
হচ্ছে? মনে হচ্ছে, এত খরচ, ট্রেনিং বা প্রস্তুতির জোগান আসবে কোত্থেকে?
ভাবছেন এসব পড়াবে কে? করাবে কে? শিক্ষক কোথায়? এগুলো বেশ যুক্তিসম্মত
চিন্তা। আমার কখনো মনে হয়নি টাকা আমাদের জন্য সমস্যা কারণ প্রচুর প্রজেক্ট
সারা বছর ধরেই চলে। সেখানে নানা রকমের আধুনিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ
থাকে। সে জায়গাগুলো ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগানোর জন্য বরং বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন
হবে। আর আমাদের প্রধান সংকট একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগের জায়গাতেই!
সংস্কারের
বিষয়গুলো নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চমৎকারভাবে ভাবতে পারেন। বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের
ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইনভলভমেন্ট এর বিষয়টি ছেঁটে ফেলার প্রয়োজন হবে সবার আগে।
প্রয়োজন হবে এমন মানুষ যার শিশু নিয়ে বিশেষ পাঠ, গবেষণা ও পড়াশোনা আছে।
নামধারী এক্সপার্টদের এমন তালিকা থেকে দূরে রাখতে পারলেই ভালো!
আমাদের
দেশের মজা হলো এই যে হাতে কলমে গবেষণা না করেই একজন নিজেকে গবেষক হিসেবে
অনেকটাই গায়ের জোরে প্রচার করতে পারেন। একজন চাইলেই নামের সাথে যুক্ত করে
ফেলতে পারেন, বলে ফেলেন তিনি বিষয়ভিত্তিক এক্সপার্ট তাও গুটিকয়েক কোর্স
করার মধ্যমেই!
দুঃখের বিষয় হলো এগুলো ধরার, বলার বা প্রতিবাদ করার মানুষ
নেই। তাই সংস্কারের ভাবনাগুলো যখনই আসে তখন দেখা যায় একুশ শতকের শিক্ষার
সাথে এলাইন্ড কোনোভাবেই হয়ে উঠতে পারে না! অনেক গ্যাপ থেকে যায়। কাজেই
শুরুর পরিকল্পনাগুলো একজন যথাযথ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে না হলে পরবর্তী
ধাপগুলোতে মান রক্ষার বা ইমপ্লিমেন্ট করার ক্ষেত্রে কোনো রকমের নিশ্চয়তাই
দেওয়া সম্ভব হবে না!
শিশু, শিক্ষা এবং সংস্কার তিনটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ।
এই শব্দ তিনটির একে অপরের সাথে যথাযথ কোলাবোরেশান প্রয়োজন। না হলে শিক্ষা
হবে, শিশুদের জন্য যথাযথ হবে কি হবে না তা নিশ্চিত হবে না এবং একই সাথে
সংস্কার হবে কিন্তু সেটা বাংলাদেশের শিক্ষার জন্য হবে কি না তা নিশ্চিত করে
বলা যায় না!
এই কোলাবোরেশন এর ক্ষেত্রে নবীন ও প্রবীণ মানুষদের সম্মিলন
ঘটাতে হবে। থাকতে হবে এমন মানুষ যারা বই রচনার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের
শ্রেণিকক্ষে পাঠ প্রদান সম্পর্কে সরাসরি ধারণা রাখেন। প্রয়োজন হবে কিছু
ডেডিকেটেড মানুষ যাদের কাছে সংস্কারের কাজ উপরি ইনকাম হবে না।
প্রয়োজন
হবে এমন মানুষ যারা অন্ততপক্ষে একটা লম্বা সময় নিয়ে এই সংস্কার কাজের সাথে
জড়িত থাকার সুযোগ আছে। নিজ প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতে নিতেই বই লিখে ফেলাটা যে
কাজের কিছু হচ্ছে না তা আমরা সবাই দেখতেই পাচ্ছি! জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে
কমিটির সদস্য নির্বাচনও আমাদের জন্য যে ভয়ানক বিপদ বার বার ডেকে আনছে সেটাও
স্পষ্ট!
সংস্কারকে নিয়ে ফুটবল খেলা থামানোর সময় এসেছে! শিক্ষার্থীদের
সব রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বের করে কেবল এবং কেবলমাত্র শেখার স্বচ্ছ পরিবেশ
নিশ্চিত করার সময় এসেছে। আমরা যথেষ্ট এক্সপেরিমেন্ট করেছি! এবং তার ফলাফল
আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি!
স্বাধীনতার এর বছরে আমাদের কাছে
সংস্কার মানেই একটা জটিল, অসম্ভব কিছু; এভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও সরে
আসার সময় এসেছে। শিশুশিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে তাই স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা,
আধুনিকতা, মস্তিষ্কের গঠন, বৈচিত্র্য, নতুনত্ব, এলাকা ভিত্তিক বিশেষ
শিক্ষাসহ আরও সমস্ত কিছু যা প্রয়োজন প্রাধান্য পাক। দেওয়া হোক।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক