শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
রংপুরের নির্বাচন ও আগামীর রাজনীতি
চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:৩৮ এএম আপডেট: ৩০.১২.২০২২ ১:০৩ এএম |


রংপুরের নির্বাচন ও আগামীর রাজনীতি
ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো রংপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন আমাদের দেশের চিরাচরিত ভোট উৎসবকে ফিরিয়ে এনেছে। ঘন কুয়াশা, শীত আর হিমবাতাস উপেক্ষা করে সকাল থেকে নিজ নিজ ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিয়েছেন। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় রংপুর। ভোটযুদ্ধ নয়, রংপুর দেখেছে ভোট উৎসব। নগরীর ২২৯টি কেন্দ্রের কোথাও হট্টগোল হয়নি। এ দেশের মানুষ এখনো যে ভোট দিতে উৎসাহী এবং ভোট দিয়ে আনন্দ পায়, তা আবারও প্রমাণ হলো। আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মাঠ সরগরম করায় এ নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি না থাকলেও তার কোনো ছাপ পড়েনি।
নির্বাচনে উত্তাপ ও প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও কোনো ধরনের অঘটন বা চমক ছিল না। এই নির্বাচনে পুরনো মেয়রই নতুন করে নির্বাচিত হয়েছেন। বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। গত মেয়াদেও তিনি মেয়র ছিলেন।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারই প্রথম সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের কারণে ভোটারদের মধ্যে ছিল এক ধরনের অজানা উদ্বেগ ও অস্থিরতা। ভোটগ্রহণকাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ভোটারদের ইভিএম সম্পর্কে ধারণা দিতে অনেকটা হিমশিম খান। অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ ইভিএম বাটনে না মেলায় ভোটগ্রহণে অনেকটা সময় লেগে যায়। তবে ভোটাররা প্রথমবার ইভিএমে ভোট দিতে পেরে আনন্দিত বলে জানিয়েছেন।
রংপুরে ইভিএম নিয়ে প্রচার কম হয়েছে। এ কারণে ভোটাররা এর ব্যবহার বুঝতে পারছিলেন না। বড় পরিসরে এই যন্ত্র ব্যবহারের আগে আরও মূল্যায়ন ও প্রচার দরকার ছিল। এটা নির্বাচন কমিশনের একটা দুর্বলতা।
আসলে যন্ত্রপ্রযুক্তির প্রতি আমাদের দেশের মানুষের এক ধরনের ভীতি আছে। শুধু প্রথম ব্যবহারের ভয়টা কাটিয়ে দিতে হয়। ভয় কেটে গেলে এটাতেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মোবাইল ফোন এর বড় উদাহরণ। ইভিএমের ক্ষেত্রেও সেটিই। তার পরও প্রশ্ন ও সংশয় থেকেই যায়। যেমন- সদ্য নির্বাচিত মেয়ের ভোটের আগে ইভিএম সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘ইভিএম একটি যন্ত্র। এর পেছনের কারিগররা যদি নিরপেক্ষ থাকেন, তা হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।’ আবার তিনি ভোটের দিন সকালবেলা ভোট দিতে গিয়ে একটু দেরি হওয়ায় ইভিএম নিয়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। জয়ী হওয়ার পর নিশ্চয়ই ইভিএম নিয়ে আর কোনো ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করবেন না। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের এটাও একটা সমস্যা। তারা পরাজয়ের আগেই একটা ছুতা তুলে রাখেন- যেন হারলে দায়টা চাপানো যায়। কিন্তু জিতলে তাদের বক্তব্য ও অবস্থান বদলে যায়। তখন সবকিছুই সুন্দর ও ইতিবাচক মনে হয়।
রংপুরের ভোটে সবচেয়ে বড় বিস্ময় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি। নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. আমিরুজ্জামান। তিনি হাতপাখা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। হাতি প্রতীক নিয়ে লড়া আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. লতিফুর রহমান মিলন তৃতীয় স্থানে ছিলেন। আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া হয়েছেন চতুর্থ।
বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬০ হাজার ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছিলেন ৬২ হাজার ভোট। এবারে ভোটের ব্যবধান লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
ভোটের ফল নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। মেয়র পদে জাতীয় পার্টির জয়কে অনেকে ক্ষমতাসীনদের জয় হিসেবেও দেখছেন। যেহেতু সরকারি দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা মিটিয়ে দিচ্ছেন- সেহেতু এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মন্তব্য করছেন যে, আওয়ামী লীগ দয়া করে আসনটা জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে জাতীয় পার্টিকে হাতে রাখার জন্য। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের ভোট লাঙ্গলে পড়েছে বলে জাতীয় পার্টির এমন বিপুল বিজয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে গেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ে অনেক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ছিল তা যেমন সত্য, তেমনি সবচেয়ে বড় সত্যটা হলো- এই জয়ে মেয়র মোস্তফার ব্যক্তি ইমেজ মূল ভূমিকা পালন করেছে। তিনি মেয়র থাকাকালে সিটির উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন। তা ছাড়া রংপুরে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তাও এ জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় খোদ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তার পক্ষে ততটা সক্রিয় ছিলেন না। দলে তিনি ততটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। আবার তার ব্যক্তি ইমেজও ভোট পাওয়ার পক্ষে সহায়ক ছিল না।
রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আবার নতুন করে প্রমাণ করেছে, রংপুর এরশাদের ছিল এবং এরশাদেরই আছে। অনেকের ধারণা ছিল, রংপুরে এরশাদের আগের মতো জনপ্রিয়তা এখন আর নেই। কিন্তু এই নির্বাচন প্রমাণ করে দিল- রংপুরে এরশাদের জনপ্রিয়তায় একটুও আঁচড় লাগেনি, বরং আগের তুলনায় তা আরও বেড়েছে।
রংপুরের নির্বাচন একটা বার্তা দিয়েছে যে, এখানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই। যে দুই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, ওই দুটি নির্বাচনই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবর্ণ সময়’-এ। তার পরও তারা সিটি নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি।
রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আমাদের দেশে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় কতটুকু কী প্রভাব ফেলে, তা এখনই স্পষ্ট করে বলা যায় না। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে কতটুকু সরে আসবে আর ক্ষমতাসীনরা এ ইস্যুতে কতটুকু ছাড় দেবে, তা কেউই অনুমান করতে পারছেন না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। অর্থ, পেশি, প্রশাসন আর ক্ষমতার জোরে নির্বাচনী মাঠ দখলের প্রবণতা ও নির্বাচনের রায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা সবার আগে সৃষ্টি করা দরকার। এ জিনিসটি আমাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। মূল সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। মনে পড়ছে বছর কয়েক আগে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা। বরিশালের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরন। রাত ২টায় তিনি বরিশাল রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, প্রশাসন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার ফল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে। তাই ঘোষণার আগেই তিনি ফল প্রত্যাখ্যান করেন। এর পর দেখা গেল, তিনি জিতে গেছেন। ব্যস, রাত পেরিয়ে সকাল হতে না হতেই প্রত্যাখ্যাত ফল সাদরে গ্রহণ করে হিরন প্রমাণ করলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই!
আগে বলা হতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় মূলত স্থানীয় ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে। জাতীয় ইস্যু ও রাজনীতি স্থানীয় নির্বাচনে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। মানুষ প্রার্থীর ব্যক্তিগত গুণাগুণ, জনপ্রিয়তা, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করেই প্রতিনিধি নির্বাচিত করত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হতো না, দলীয় প্রতীকও ব্যবহার করা হতো না। তবে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচিতি বা আনুগত্য ভোটারদের অজানা থাকত না। রাজনৈতিক দলগুলোও হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকত না, ‘ঘোমটার নিচে চলত খেমটা নাচ।’

এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা আকণ্ঠ রাজনীতি নিমজ্জিত জাতি হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনেরও রাজনীতিকরণ করেছি। এখন প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে রাজনৈতিক দল। দলীয় প্রতীক ব্যবহার হচ্ছে। কাজেই এখন আর বলা যাবে না সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচন বা রাজনীতিতে পড়বে না, বরং এখন স্থানীয় নির্বাচনের ফল দেখে অনেকে জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতির হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে নেন।
আমাদের অনেকের মধ্যেই এক ধরনের অতিসরলীকরণ প্রবণতা রয়েছে এবং সে কারণেই যে কোনো নির্বাচনের ফলাফলকেই আমরা অতিগুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। নির্বাচন হলেই আমরা তাকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বলে প্রচার করে থাকি। রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা পরিমাপের জন্য নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে তার মানে এই নয় যে, কোনো একটি নির্বাচনের জয়-পরাজয় দিয়ে একটি দলের জনপ্রিয়তার প্রকৃত পরিমাপ করা যেতে পারে।
বিএনপিরও এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। রাজনীতির ইতিবাচক ধারায় অবশ্যই তাদের ফিরে আসতে হবে। বর্জন, প্রতিরোধ কিংবা জ্বালাও-পোড়াওয়ের ইমেজ থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রে ক্ষমতা পরিবর্তন বা নিজের পছন্দের ব্যক্তির মাথায় মুকুট পরাতে কিংবা অপছন্দের ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান অথবা জব্দ করতে নির্বাচন বা ভোটই হচ্ছে একমাত্র লাগসই অস্ত্র। এর কোনো বিকল্প নেই, কোনো শর্টকাটও নেই।
সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছিল বলেই নির্বাচন কমিশন রংপুরে গ্রহণযোগ্য এমন একটি নির্বাচন করতে পেরেছে। দেশবাসী আশা করতে পারে, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও সরকারের সদিচ্ছায় এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যথার্থ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে।

চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক













সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন,আটক ৩
স্বাগত ২০২৩: অকল্যান্ডে আতশবাজির মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ
কুমিল্লায় অভাবের তাড়নায় মা-মেয়ের আত্মহত্যা
সাবেক পোপ বেনেডিক্ট মারা গেছেন
কুমিল্লায় নির্মানাধীন ভবনের প্রহরীর মরদেহ উদ্ধার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় অভাবের তাড়নায় মা-মেয়ের আত্মহত্যা
কুমিল্লায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন,আটক ৩
মাহির মনোনয়ন নিয়ে যা বললেন ডা. মুরাদ
স্কুলে ৪ শ্রেণিতে এবার নতুন শিক্ষাক্রম
আওয়ামী লীগ ১২ স্বতন্ত্র ৫
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft