৪১
রাজা
না হলে যেমন প্রজা হয় না, প্রজা না হলে যেমন রাজা হয় না, তেমনি লেখক না
হলে পাঠক হয় না, পাঠক না হলে লেখক হয় না। লেখকের সঙ্গে পাঠকের একটি অদৃশ্য
যোগসূত্র আছে। লেখকও সেটা জানেন, পাঠকও জানেন সেটা কেউ কাউকে হয়তো চক্ষে
দেখেন নি, দেখবেনও না কোনোদিন। দেখবেন কী করে, যদি দু পক্ষের মাঝখানে হাজার
হাজার মাইলের ব্যবধানে থাকে। যদি থাকে শত শত বর্ষের ব্যবধান। তবু মানতেই
হবে যে যুগযুগান্তরের ও দেশদেশান্তরের লেখকের সঙ্গে যুগযুগান্তরের ও
দেশ-দেশান্তরের পাঠকের একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে। একথা মনে রেখে লেখক শুধু
চেনা পাঠকগোষ্ঠীর সাময়িক চাহিদা মেটানোর জন্যে কলম ধরেন না। তাঁকে অচেনা
পাঠকসমূহের কালোত্তর পরিতৃপ্তির জন্যও যথাসাধ্য করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন
শিলাইদাতে বসে লিখতেন তখন বাংলার বাইরে কেউ তাঁর লেখা পড়তেন না। পরে একদিন
পড়বেন, এটাও কি তিনি জানতেন? তা সত্ত্বেও তিনি এমনভাবে লিখে গেছেন যাতে
দেশবিদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালের পাঠকরা তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ পান। সে
লেখা হয়তো অপর কোনো ভাষায় তর্জমা। হয়তো মূল রচনার অল্পই তাতে মেলে। তবু
লেখকের সঙ্গে তাঁর দূরবর্তী পাঠকদের অন্তরের মিল হয়। সাহিত্য কথাটার ভিতরে
একটা সাহিত্যের ভাব আছে। সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে যাঁরা ব্যাপৃত তাঁদের সঙ্গে
তাঁদের পাঠকদেরও এক প্রকার সহিত অর্থাৎ সাহিত্যের ভাব। লেখা যদিও দৃশ্যত
একজনের কাজ তবু প্রকৃতপক্ষে দুজনের। রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন-
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে।
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে?
তেমনি
একাকী লেখকের নয় তো লেখা, মিলতে হবে দুইজনে। সেই দ্বিতীয় জনটির নাম পাঠক।
তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার উপায় নেই। তাঁকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।
কী করে সেটা সম্ভব, প্রত্যেক লেখককেই এর সমাধান খুঁজে বার করতে হবে।
খামখেয়ালিভাবে যা খুশি লিখে গেলেই চলবে না। তা যদি কেউ করেন তবে তাঁর
পাঠকের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য থাকবে না। অপর পক্ষে এটাও ঠিক যে লেখক তাঁর
পাঠকের জন্যে অপেক্ষা করে জীবন ভোর করে দেবেন না। পাঠক হয়তো প্রস্তুত নন,
হতে সময় লাগবে। লেখক তা বলে লেখা বন্ধ করে বসে থাকবেন না, পাঠকের মুখ চেয়ে
লেখার মান খাটো করতে পারবেন না। সব লেখা সকলের জন্য হলেও সালে সব লেখার
জন্য প্রস্তুত নন। যিনি যখন প্রস্তুত হবেন তিনি তখন উপভোগ করবেন। লেখক
আপাতত তাঁত সৃষ্টির দায় থেকে মুক্ত হতে চান, যে দায় তাঁকে লেখক হতে বাধ্য
করেছে।
পাঠকের প্রতি দায়িত্ব যেমন একটি দিক তেমনি আর একটি দিক হচ্ছে
সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব। কবিতা বা গল্প যখন যেটাই লিখি না কেন সব সময় আমার
একটি চোখ থাকে পাঠকের উপর আর একটি চোখ যা লিখছি তার উপরে। লেখাটি নিজেতে
নিজে সম্পূর্ণ হওয়া চাই, নিজেতে নিজে নিখুঁত হওয়া চাই। যেন একটি নিটোল
মুক্তা। প্রত্যেক সার্থক সৃষ্টির ভিতরে একটি সমগ্রতা আছে, আর আছে একটি
শিল্পগত উৎকার্য। কবিতা বা কাহিনী যদি আর্ট হিসেবে উত্তীর্ণ না হয় তা হলে
লেখকের দিক থেকে কিছু ত্রুটি হয়তো তখনই ধরা পড়ে না। পড়ে একদিন না একদিন
মেননশীলন্য লেখককে আগে থেকে হুঁশিয়ার থাকতে হয়। রস যেন গুরুত্বসম্পন্ন রূপই
তেমনি। রসের ওপর মনোযোগ দিতে গিয়ে রূপকে অবহেলা করা চলে না। অপরপক্ষে রূপও
যেন সর্বস্ব হয়ে না ওঠে।
উপনিষদে বিত্তময়ী সৃঙ্গার কথা বলা হয়েছে। যাতে
বহু মনুষ্য নিমজ্জিত হয়। আজকাল জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার হওয়ায়
সাহিত্যিকের পক্ষে ভয়ের কথা। বাঁধা আয় না থাকলে আর দশজন মানুষের মতো
সাহিত্যিকের ও জীবন যাত্রা দুর্বহ। লেখা থেকে যদি দুটো পয়সা ঘরে আসে তা হলে
তো ভালই হয়। কিন্তু তার জন্যে লেখা যদি বাজারের মুখ চেয়ে উৎপন্ন হয় তাবে
সে আর সাহিত্য পদ বাচ্য হতে পারে না। হয়ে দাঁড়ায় পণ্য। প্রায়ই নালিশ শুনতে
পাওয়া যায় যে একালের লেখকদের বই পড়ে সেকালের মতো তৃপ্তি হয় না। হবে কী করে?
লেখা যে এক প্রকার ম্যানুফ্যাকচার। ম্যানুফ্যাচার তো সৃষ্টি নয়। অপরপক্ষে
লেখক যদি খুঁতখুতে হন তবে তাঁর পক্ষে আজকালকার দিনে জীবনধারণ করা তো
দস্তুরমতো শক্তই, বইয়ের প্রকাশক পাওয়াও কম শক্ত নয়। সুতরাং পাঠকদের ও
প্রকাশকরে উচিত লেখকদের কর্তব্য করতে তাঁদের সাহায্যে করা। দায়িত্ব কখনো
একতরফা হয় না। লেখকের যেমন দায়িত্ব আছে লেখকের প্রতিও তেমনি দায়িত্ব আছে।
লেখকও তো নালিশ করতে পারেন যে পাঠক তাঁর বই কেনেন না, প্রকাশক তাঁর বই
ছাপেন না কিংবা ছাপলেও তাঁর প্রাপ্য দেন না। থাক, এসব কথা তুচ্ছ। আসল কথা
হচ্ছে, সৃষ্টির স্রোতকে বহতা রাখা। স্রষ্টার সৃষ্টির মতো সাহিত্যিকের
সৃষ্টিও বহতা থাকবে, এই সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব।
কয়েক শতাব্দী পূর্বে এক
ইংরেজ পরিব্রাজক পর্তুগাল বেড়াতে দিয়ে দেখেন, একটা শুয়োরকে কী এক অপরাধের
জন্য ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। তার আশেপাশে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহ করছে অন্যান্য
শুয়োর। তাদের কোনও ভাবনা নেই। তারা উদাসীন। বোঝে না যে পরে তাদেরও পালা
আসছে।
মানুষ তো শুয়োর নয়। সে একজন লেখকের বিনা বিচারে ফাঁসি দেখলে
সাবধান হয়। যেখানে আইনের শাসন নেই, আইনকে যে যার হাতে নেয়, সেখানে কেউ
নিরাপদ বোধ করে না। ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনি সালমান রুশদির বিনা বিচারে
প্রাণদণ্ডের ফতোয়া জারি করেছেন। সঙ্গে একজন ইরানী ধনপতি ঘোষণা করেছেন যে
তিনি আততায়ীকে দশ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেবেন। এতে ইংরেজ মার্কিন ফরাসী
জার্মান প্রভৃতি লেখকরা সময় থাকতে সাবধান। তাঁদের দেশের রাজনৈতিক বা
সামাজিক মৌলবাদীরা যদি লেখার জন্য লেখককে খুন করতে চায়, তবে তো কেউ নিরাপদ
নয়। সেসব দেশের স্বাধীনচেতা লেখকরা একদা ধর্মান্ধদের দ্বারা নিহত হয়েছেন।
ইদানীং দেশে দেশে নাৎসী বা ফাসিস্টদের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। তাদের ফতোয়া এই
রকম ভীতিপ্রদ। সিভিল লিবার্টি বিপন্ন। রুশদিকে রক্ষা করতে সবাই বদ্ধপরিকর।
তার
মানে এই নয় যে, তারা রুশদির সঙ্গে একমত। তারাও রুশদীর দোষ ধরেন। কিন্তু
একজন লেখককে বিনা বিচারে হত্যা করা হবে ও তার জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে এটা
তাদের কাছে বিশেষ আপত্তিকর। ব্রিটিশ সরকার প্রচুর অর্থব্যয় করে রুশদিকে
পুলিশ পাহারায় রেখেছেন। এর জন্য ট্যাক্স জোগাচ্ছে সে দেশের নাগরিকগণ। একজন
মানুষের নিরাপত্তার জন্য কোটি কোটি মানুষ ত্যাগ স্বীকার করছে। ইংরেজরা যে
একটি মহান জাতি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বিশ শতকের বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিন
সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। দু-চারজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া তাঁর পক্ষে আর নেউ নেই। তার
সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সংস্থার অনুরোধে। তার
স্বজাতির অনুরোধে নয়।
তসলিমা নাসরিন একবিংশ শতকের মেয়ে। ভুল করে বিংশ
শতকে জন্মেছেন। তসলিমা নাসরিন ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের কন্যা। ভুল করে
বাংলাদেশে জন্মেছেন। তসলিমা আজ যা বলছেন, আরও অনেক নারী কালও তাই বলবেন এটা
যুগের দাবি। যুগের দাবিতেই ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন,
একজন মুসলিম নারী বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আর
একজন নারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার মানে তারা দুজনের
সঙ্গে রাজনীতির ক্ষেত্রে সমান অধিকার পেয়ে গেছেন। কিন্তু পারিবারিক
ক্ষেত্রে পাননি। স্বামীরা কথায় কথায় তালাক দিতে পারেন। ইচ্ছেমতো বহুবিবাহ
করতে পারেন। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অংশ পুত্রের সমান নয়। এমনি কয়েকটি
বিষয়ে নারীবাদীরা সামাজিক ন্যায় দাবি করেন। নারীদের হাতে এখন সমান সংখ্যক
ভোট। তারা ভোট প্রয়োগ করার দ্বারা আইনের সংশোধন করতে পারেন। প্রাণের ভয়
দেখিয়ে মৌলবাদীরা কি চিরকাল তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। তসলিমা নাসরিনের
উদ্দেশ্য একদিন সফল হবেই।