
মেয়ে

কাজী সিনথিয়া আলম মিমি ।।
সোমবার সাদা কাপড় ধুয়ে পাথরের স্তূপে রাখো; মঙ্গলবার রঙিন কাপড় ধুয়ে শুকানোর জন্য দড়িতে রাখো; কড়া রোদে খালি মাথায় হেঁটো না; কুমড়ো বড়া টগবগে গরম মিষ্টি তেলে ভাজো; তোমার ছোট কাপড়গুলি খুলে ফেলার পরেই ভিজিয়ে রাখো; নিজের ব্লাউজ তৈরি করার জন্য কাপড় কেনার সময়, নিশ্চিত হও যেন তাতে আঠা লেগে না থাকে, কারণ তাতে ধোয়ার পরে ভালো থাকবে না; শুটকি মাছ রান্নার আগে সারারাত ভিজিয়ে রাখো; এটা কি সত্যি যে তুমি রবিবারের স্কুলে বেন্না গান করো? এমনভাবে খাবার খাও যাতে তা অন্য কাউকে পীড়িত না করে; রবিবারে নিজের বস্তির চালচলন বদলে একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো হাঁটার চেষ্টা করো; রবিবারের স্কুলে বেন্না শুনিয়ো না; আর অবশ্যই নেশাগ্রস্ত বাজে ছেলেদের সাথে কথা বলবে না, এমনকি রাস্তা বলে দিতেও নয়; রাস্তায় বানানো ফল খাবে না - নাহয় মাছি তোমায় অনুসরণ করবে; কিন্তু আমি তো রবিবারে বেন্না গাই না এবং রবিবারের স্কুলেও না; এইভাবে বোতাম সেলাই করতে হয়; এইভাবে সেলাই করা বোতামের জন্য বোতামঘর তৈরি করতে হয়; এইভাবে একটি জামার পাড় স?েলাই করতে হয়, যখন পাড়টি নিচে নেমে আসে এবং তোমাকে দেখতে বস্তির মতো দেখায় যা হতে তুমি আগ্রহী; এইভাবে তুমি তোমার বাবার খাকি শার্ট ইস্ত্রি কোরো যাতে সেটি ভাঁজ না হয়ে থাকে; আর এইভাবে বাবার খাকি প্যান্ট ইস্ত্রি কোরো যাতে তাতেও কোন ভাঁজ না থাকে; এইভাবে ঢেরশ চাষ কোরো - বাড়ি থেকে অনেক দূরে, কারণ ঢেরশ গাছে লাল পিঁপড়া থাকে; তুমি যখন কচুগাছ বাড়াচ্ছ, খেয়াল রেখো এটি যেন প্রচুর পরিমাণে পানি পায়, নাহয় এটি খেলে গলা চুলকাবে; এইভাবে ঘরের কোণা ঝাড়ু দিতে হয়; এইভাবে পুরো বাড়ি পরিস্কার করতে হয়; এইভাবে বাগিচা ঝাড়ু দিতে হয়; যাকে তুমি খুব বেশি পছন্দ করো না তাকে দেখে এইভাবে হাসতে হয়; আর যাকে তুমি মোটেও পছন্দ করো না তাকে দেখে এইভাবে হাসতে হয়; আর যাকে তুমি সম্পূর্ণরূপে পছন্দ করো তাকে দেখে একজনের কাছে এইভাবে হাসতে হয়; চায়ের জন্য এইভাবে টেবিল সাজাতে হয়; এইভাবে রাতের খাবারের জন্য টেবিল সাজাতে হয়; আর এইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অতিথির সাথে রাতের খাবারের জন্য একটি টেবিল সাজাতে হয়; এইভাবে তুমি লাঞ্চের জন্য টেবিল সাজাও; আর এইভাবে প্রাতঃরাশের জন্য টেবিল সাজাও; এইভাবে এমন পুরুষদের সামনে আচরণ করো যারা তোমাকে খুব ভালভাবে চেনে না, এবং এইভাবে তারা চিনতে পারবে না সেই বস্তির মেয়েটাকে যেটা হওয়ার বিরুদ্ধে আমি তোমাকে সতর্ক করেছি; নিজের থুথু দিয়ে হলেও প্রতিদিন ধুয়ে ফেলতে ভুলবে না; মার্বেল খেলতে উবু হয়ে বসবে না - জানো নিশ্চয়ই যে তুমি ছেলে নও; মানুষের দেওয়া ফুল নিবে না - পোকায় ধরতে পারে; কালো পাখির গায়ে পাথর ছুড়বে না, কারণ এটি কালো পাখি নাও হতে পারে; এইভাবে শাহী টুকরা বানাতে হয়; এইভাবে ডুকোন তৈরি করতে হয়; এইভাবে মরিচের পাত্র তৈরি করতে হয়; এইভাবে সর্দির জন্য একটি ভাল ওষুধ তৈরি করা যায়; এইভাবে একটি শিশুকে শিশু হওয়ার আগেই ফেলে দেওয়ার জন্য একটি ভাল ওষুধ তৈরি করা যায়; এইভাবে মাছ ধরতে হয়; আর এইভাবে পছন্দ নয় এমন মাছকে ছুড়ে ফেলে দিতে হয় যাতে তোমার উপর খারাপ কিছু না বর্তায়; এইভাবে একজন মানুষকে ধমকানো যায়; আর এইভাবে একজন মানুষ তোমাকে ধমকে দিতে পারে; এইভাবে একজন মানুষকে ভালবাসতে হয়, এবং যদি তা কাজ না করে তবে অন্য উপায় আছে, এবং যদি তাতেও কাজ না হয় তখন হাল ছেড়ে দিতে মন খারাপ করো না; মনে চাইলে এইভাবে বাতাসে থুথু ফেলতে হয় এবং এইভাবে দ্রুত সরে আসতে হয় যাতে সেটা তোমার উপর না পড়ে; এইভাবে জীবন চালনা করা যায়; সবসময় রুটি চেপে তা তাজা কিনা বুঝতে হয়; কিন্তু রুটিওয়ালা যদি আমাকে রুটি ধরতে না দেয়? তুমি বলতে চাচ্ছো যে এত কিছুর পরও তুমি এমনই এক মহিলা হবে যাকে রুটিওয়ালা পর্যন্ত তার রুটির কাছে ঘেষতে দেবে না?
জীবন থেকে উন্মাদে
আরিফুল হাসান ||
সেসব উন্মাদনার কথা আমার মনে নেই। যখন আকাশ থেকে ঝরে পড়তো বৃষ্টি ও রোদ এবং জীবন থেকে ঝরে পড়তো দিনরাত্রি। সেসব শীতকালের কথাও আমার মনে নেই। কুয়াশার সাথে ঝরে পড়তে রাজগঞ্জ রাস্তার পাশের টাল দোকান। বেছে বেছে দুয়েকটা কেনার সামর্থ থাকলে দেহে দেবার পর দেখা গেছে সে সবে ছাড়পোকায় ভরা। তখন রেল স্টেশনে শুয়ে থাকা নির্জন দুপুর একটি কুকুরকে কণ্ঠে ধরে কেনো যে তীর্যক স্বরে ককিয়ে উঠতো, সে সবের ভাষা পরিহাস আজ আর মনে নেই। মনে নেই ফুটপাত, পথভুলো মেঠোপথ, মনে নেই তালপাখার বাতাস। সব ভুলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি, সব সব, একদম সব ভুলে গেছি।
মদের গ্লাসটা বাইরে ছুড়ে মেরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ তাকিয়ে থাকলাম মাছে। কোথাও কোনো দোলা বিকেলের চিহ্নপর্যন্ত নেই। ডুবে গেছে। আলগোছে রেখে গেছে অন্ধকারের কপাট দরজা। আমি তাতে ঠকঠক কড়া নাড়ছি বহুক্ষণজুড়ে কিন্তু চাঁদ তার ঘোমটা তুলছে না। আমি আরও দূরে শূণ্যে দৃষ্টি মিলিয়ে দেখলাম, চাঁদটা উঠলো বলে, মেঘের আড়ালটা শাদা হয়ে আসছে। আশান্বিত আমি সিড়ি বেয়ে নিচে নামি। গ্লাসটা কুড়িয়ে আনি। বেসিনের জলে ধুলে তা আবার চকচক করে উঠে। চ্যাপটা ব্রান্ডির বোতলটা আবারও কাত করি, দেড় পেগ সমান নিয়ে তাতে বরফ ছুড়ে দেই, না, আমি ভুলে থাকতে চাই সব, সব।
সে সব উন্মাদনার দিনে আমার মনে হতো আমি ঘুড়ি। যেনো উড়ছি আকাশে সঙ্গী নেই, বান্ধব নেই, ভাসমান এক পাখি। কোনো ডালে আশ্রয় নেই, আশ্রয় পাবার চেষ্ঠা নেই। কোনো হেমন্তে নেই পার্বন, কোনো শরতে নেই কাশফুল। তখন কান্দিরপাড় থেকে চকবাজার, কিংবা বাগিচাগাও ঘুরে শাসনগাছা, হাড্ডিখোলা আর হরিজন পল্লী ছিলো ভাসা। সেসব অস্পষ্ট দিনে কেনো আমি নিষিদ্ধ ছিলাম সেসব ভুলে থাকতে চাই, তাই ভুলে গেছি। মনে পড়ে না তখন একটি পুরি খেয়ে, সিঙারা খেয়ে কিংবা লুচি খেয়ে খুধায় পেটে নিরবে যে পাথর বেঁধেছি, মনে পড়ে না। কেনো আমার মনে পড়ে না।
মদের গ্লাস শূণ্য হলে ভালো। আরো মদ ঢালা যায়। টলটল করে যখন স্বর্ণালি সুরা গ্লাসের তলায় ঝরতে থাকে তখন মনে তৃষ্ণা আরো জেগে উঠেছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। তখন মদ খাওয়া ছাড়া আর কোনো কথা মনে থাকে না। ওই সময়টাতেই সব কিছু ভুলে যাই। তাই গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা হতে থাকলে আমার বরং লাভ। আমি আরেকটি সিগারেট ধরাই। পুড়াই মনের আগুন। বৃথা হাঁপরের বাতাস বুকের ভেতর ঘুরে ফিরে চলে আসে। বলে যায় বয়ে যাওয়া বাতাস তখনো অনুকুলে ছিলো এবং এখনো আসে। আমি চমকে উঠি। আবার সরাবের গ্লাসটা ছুড়ে ফেলি বাইরে। কী ভীষণ রোমান্টিক সন্ধ্যা! তবু বড় নিঃসঙ্গ লাগে, বড় অদ্ভুত একাকী লাগে। এ নিঃসঙ্গতা আরও জমাট বাঁধলে আপনি আপনি আবার চলে আসে কালো মেঘ, হায় মেঘ, তুমি সোনালি ডানার চিল।
উন্মাদের ঘুমভাঙা স্বপ্ন কেমন ছিলো তা তো একদম মনে নেই, মনে নেই কেনো এই মনে না থাকার অপবাদ নিতে হয়েছিলো। দেখা হয়েছিলো কোন নিশানা নতুন? যার ফলে পথ হলো বিভাগী আর আমি হলাম পাগলা গারদ। আমার ভেতর নিজেকে আমি বন্দি করে রাখলাম আর ইচ্ছেকে করে দিলাম অবারিত যেনো সে চলতে পারে যেথা ইচ্ছে তথা, যখন ইচ্ছে তখন। তখন রাত নামার দৃশ্যগুলো ভুলে গেছি। প্রায়ই স্টেশনের কাচা রুটির স্বাদ এখন আর মনে নেই। খালা ডাকতাম তাকে। মাঝবয়সী রমনী ছেড়া কাগজে পিঠা তুলে দিতেন। ফুয়াতে ফুয়াতে সে পিঠা মুখে পুরে দিয়ে আবার চেয়ে থাকতাম। কিন্তু কী করবো, মুখে তো খিদে, বুকে তো পকেট নাই। দুই গ্লাস পানি খেয়ে আবার সে টাউনহলে আর সাথে একটি ছোট্ট পুটলি, তাতে সেভিং রেজার, একটি গেঞ্জি, দুটো পাজামা, তিনটি হয়তো পাঞ্জাবি। পলিস্টারের গুটি উঠা শার্ট। হলুদ, হ্যা, হলুদ রং ছিলো সেটির আর ছিলো বিবর্ণ।
বাইরে কাত হয়ে পড়ে আছে সরাবের গ্লাসটি। ম্লান উঠা আলো চাঁদকে সঙ্গী করে আবছায়ার একটু বেশি দেখা যাচ্ছে, তাতে হয়তো টলমল করছে শেষবিন্দু মদ অথবা টিকে থাকা বরফ কুচি। তার উপর কুয়াশা পড়ছে। নিজের সুয়েটারটা ঠিকঠাক করে আমি এসে বসি চেয়ারে। ফোন দেই মেয়ে অরিত্রিকে। মেয়ে, ও মেয়ে, তুমি কেমন আছো। অরিত্রি ও পাশ থেকে জবাব দেয়, আমি ভালো আছি বাবা, তুমি কী করছো? বসে আছি। ও আচ্ছা, বসে থাকো। মেয়ে! জ্বী বাবা, বলো। মেয়ে, তুমি কী আগামিকাল আসতে পারবে? আগামিকাল? হ্যা, মেয়ে, আগামিকাল। আচ্ছা বাবা, আমি রাতের ফ্লাইটে রওনা হবো। আচ্ছা, রাখছি। আবার জানালার কাছে যাই। চাঁদ উঠেছে আরেকটু বেশি। গ্লাসটা এবার চকচক করছে। আমি আবার নিচে নামতে চাই, তুলে আনতে চাই গ্লাসটি। ব্রান্ডি আরো কোয়ার্টার আছে। চলুক না কিছুক্ষণ। মেয়ে আসলে ওসব খেতে দেয় না। তখন লুকিয়ে চুরিয়ে খাই। খেয়ে ভুলে যাই আমি যে মানুষ, আমার যে অতীত ছিলো।
অতীতে আমি উন্মাদ ছিলাম কিনা সে ধারণা এখন আমার থেকে অতীত। সেসব দিনগুলো মুছে গেছে বাতাস থেকে মুছে যাওয়া শুদ্ধতার মতো। মরে গেছে গোমতি নদীর পারে কাটানো বিকেল, হলুদ হয়ে আসা সকাল দশটার রোদ। খালি পেটে কাজ খুঁজতে যেয়ে নিজেকে শাহান শাহ প্রত্যক্ষ করে আবার ফিরে আসা। আর ফিরে এসে খালি পেটে ঝিমানো রেললাইন। পাথরে টুকরো গুলো ছুড়ে মারতাম একটা আরেকটার উপর আর ছিটকে গিয়ে আমার কাছেই ফিরে আসতো সমস্ত আঘাত। আমি উত্তাপ সহকারে রাতের ফ্লাইওভারের উপর কুড়িয়ে পাওয়া বিরিয়ানির বক্সে উচ্ছিষ্ট খাবার কীভাবে চেটেপুটে খেয়েছি সেসব কিছু এখন নিশ্চই ভুলে গেছি। কারন আমি ভুলে গেছি সাধারণ বিশ্রামাগারের রাত আরও অনেক পুরনো পাগল কেড়ে নিতো।
গ্লাসটা আবার নিচে থেকে আনি। এই অবারিত ঐশ্বর্যের ভেতর আমি আমার টলটল প্রিয় শব্দ শুনবো না তা কি হয়। এই একা নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ প্রান্তে কেনো আমি আবার ঢালবো না মদ, ব্রান্ডির গেলাসে। আমি ঢালছি। টলটল প্রিয় শব্দ আর মনমাতানো ঘ্রাণ আমাকে আবার সবকিছু ভুলিয়ে দিলে আমি তখন ঢালতে থাকি আর পান করতে থাকি। একসময় বোতল ফুরোয়। এবার উঠে জানালা দিয়ে বোতলটি ছুড়ে মারি আর তা পাথরে লেগে ঝনঝন করে ভেঙে যায়। ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসি। স্বাভাবিক জীবনের পৃষ্ঠায় আঁকা একটি ছত্রিশ বছরের সংসার, প্রিয়মুখ, আসা-চলে যাওয়া, আরও কতকি জাগতিক দেখি! দেখতে দেখতে চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠে। সফল জীবন, সমাজের ধনাঢ্য প্রবীন, একমাত্র মেয়ে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করে। সমাজের চোখে আমি তো মহাসুখী। সেই উন্মাদনার দিনরাত্রি ভুলে, হঠাৎ করেই যেনো জেগে উঠেছিলাম। ফিনিক্স ডানায় আবার আঁকলাম ভোর, ভোর হলো, রোদ হলো। ঝকঝকে দুপুরের পরে পড়ন্ত বিকেলের ইচ্ছেপাখির পায়ে শিকল পড়িয়ে আমি এখন একা। কাল মেয়ে আসুক, ওর মায়ের কবর জেয়ারত করতে যাবো।
কবিতা
সংলাপহীন পুষ্প মাদকতা
আহাম্মেদ সাব্বির ||
আমি জেগে উঠি প্রতিটি ভোরে
তোমায় ফুল কুড়াতে দেখবো বলে।
দুটি জানালার আলতো ব্যবধান হতে,
বিরক্ত ঘুমের চোখ নিয়ে তোমায় দেখবো।
লজ্জাবতী কেশ গঙ্গায় জড়িয়ে,
তুমি শিউলী কুড়াবে দেবদাসের উঠানে।
সংলাপহীণ ঐ ট্র্যাজিডির প্রতিটি দৃশ্য শেষে
রোমান্টিক অগ্নিতে আমি।
সংলাপময় তামাক পোড়াবো।
ফুল কুড়ানো শেষে তুমি চলে যাও।
থেকে যায় শুধু গন্ধের স্মৃতি।
শিউলী , দেহ ও তোমার কেশর।
হাত বুলিয়ে মাটির সাথে জুয়া খেলে,
আমি কেড়ে নেই আমার গন্ধম স্মৃতির অধিকার।
এমনি করে প্রতিটি রাত,
দীর্ঘ হয় আমার।
হেয়ালি করে শীতল চাঁদের অন্ধকার,
আমার মদের আড্ডায় দাওয়াত করে।
যেনো তোমার ফুল করাতে দেখার আগেই,
আমি অর্ধ গৃহত্যাগের বাসনায় মত্ত হই।
আতাউর রহমানের একগুচ্ছ কবিতা
যৌতুক
----------
জলেরদামে কেউ নেয়নি তাকে,
শরীরেও ছিল গাছের ছায়া মাখা ;
বাবার পকেট দিতো না দর্জি ভুলে,
সহজ ছিল সিলিং ফ্যানের পাখা ।
চিত্র
......
এই নাও কয়েকটি অন্ধকারমাখা পাঁজর, পলেস্তারা খসে পড়া সাদাকালো স্বপ্ন,
দীর্ঘ অনাহার জিইয়ে রাখা এই নাও পাকস্থলী,
সমুদয় দৃশ্য খসে পড়া অমাবস্যা জড়িত দুটো আকাশ, এই নাও বাজেয়াপ্ত ঠোঁটের অগ্রন্থিত উচ্চারণ...
দীর্ঘ পথ আর পায়ের পাথর;
তুলে নাও অবশিষ্ট রঙ কালো, জলের অনীহামাখা
ধুলোবালি নদী,
হলুদ পাতা আর হাওয়ার শত্রুতা, মরা জ্যোৎস্নার বিলাপ,
বিশ্বাসের ডিঙায় বাঁধা এই নাও প্রবীণ প্রতীক্ষা...
একটা ছবি আঁকো, একটা এমন ছবি আঁকো
যেনো তুমি নিজেই কেঁপে ওঠো চিত্রের বেদনায় ...
যদি
-----
যদি না-পড়ো শীতল চোখেরজল
মুখের প্রচ্ছদ, বাতায়নতলে
জমানো প্রতীক্ষা, নির্বিরোধ চুলের ঢেউ ;
যদি পায়ের আঙুলে বিদ্রোহ না-জাগে
সূর্য ডুবে যাবে দ্রুত নীলদিগন্তে, বাতাসে সাঁতরে
অন্ধকারে প্রেম ফিরে যাবে অপ্রেমে...
যদি স্বীকার শিকার করো
শাদা হরিণের পিছুপিছু নিযুক্ত হবে চোখের ছুরি,
কাঁটাভর্তি শব্দবর্শা মাংসের কোমলে
বিরামহীন খুঁড়ে খুঁড়ে জাগিয়ে তুলবে আগুনের ফসল ।
মরাচাঁদ ধরে আছে পুকুরের জল
মিছিলে মত্ত পাতাদের শব,
যদি ফিরিয়ে দাও আঁখিপল্লবের এককোটি কবিতা ----
আমাদের গৃহস্থালি সন্ধেবেলা
আমাদের হলুদ আলোময় যুবতীরাত
আমাদের গাছের ছায়ামাখা হিমবিকেল
একে অপরের বিরুদ্ধে হবে নির্দয় হন্তারক ।
যদি আর আকাশ ভালো না-বাসো
পণ্ড হবে জলময় মেঘের কাছে মাটির আবদার,
যেহেতু দুর্লভ মানুষের গোপনবিদ্যা মানুষের কাছে !
মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
..................................................
মুখ, ঠোঁট,চুল,চিবুক আমার নয়
সমুদ্রের মতো গভীর চোখ দুটো আমার,
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
সঙ্গীত, কবিতা, কথাবৃষ্টি,চায়ের আড্ডামাখা
মাতাল বিকেল আমার নয়,
মৌনদৃষ্টির বাউল মুহূর্তগুলো আমার,
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
বালিশ তোষক কাঁথা আমার নয়,
মোমের মতো গলে ঝরা মোহিত সঙ্গম আমার নয়,
ঘুমপরা ক্লান্ত শরীরের মাধুরী দৃশ্যরূপ আমার,
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
বাসনকোসন, হাঁড়িপাতিলার ঝনঝনানি আমার নয়,
দু'পায়ে মুদ্রিত নূপুরসঙ্গীত কেবল আমার,
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
ও-কারের মতো আলিঙ্গন নয়
ঈ-কারের মতো ঠোঁটের উষ্ণতা আমার নয়
গোলাপ হয়ে ফুটে থাকা আয়ুর্বেদীক হাসিটুকু কেবল আমার
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
গোমতীপাড়ে শিরশিরে বাতাসে ভাসা পাখি-বিকেলগুলো আমার নয়
চাঁদগলা হলুদাভ রাত্রিগুলো আমার নয়
মধ্য রাতের মখমল স্বপ্নগুলো শুধু আমার
সুদর্শনা, আপনি কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো ?
(দায়বদ্ধ: কবি শহীদ কাদরীর কাছে)
রুগ্ন মৌসুমে
.................
হাত বাড়ালেই হাত পুড়ে যায় মুঠো ভরে যায় ঋণে ,
এতো আলো, তবু কই, আলো কই ! অন্ধকার হাসে দিনে!
পায়ে পায়ে পথ থেমে যাচ্ছে, যন্ত্রণা এসেছে সুখ খেতে,
চেনা মুখ অচেনা মুখোশে দিব্যি কুশীলবে আছে মেতে।
বাজারের পথ ভুলে বাড়ি ফিরে না, ডেকচিরা আধোঘুমে,
জ্যোৎস্নার বার্তা নিয়ে কেউ আসে না এই রুগ্ন মৌসুমে।
খুলেছি হৃদয় এসে দেখো কতো বনভূমি এতে আছে,
কতো বেদনার ভারে এই জীবন মৃত্যুর কাছে বাঁচে।
পরিতোষ লিখে রাখে জলে
........................................
গ্রীষ্মের আগুন খাওয়া মাঠ ধুলো-সজ্জিত নদী, পাতার বাদামি শব
চারিদিক, অনিদ্রায় লুকনো ঋণ ; পরিতোষ জানে
দড়িতে ঝুলানো মৃত্যুপথ ঘৃণা এনে দেয়, নয়তো কবেই...
এইতো কিছুদিন আগেই মাটি ডেকে নিয়েছে পাশের বালিশের সুখ,
বড়ছেলে বুকে পুষছে চাঁদের অসুখ, মেয়েটার পেটে অজগর,
অথচ ডেকচি ঘুমায় শুশ্রূষাহীন ।
গেলো বছর বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে
মাটিকে সেজদা করেছিল মাথারছানি,
নারকেলের মৃত ডানা এখন বৈরী রোদবৃষ্টির,
মাছরাঙা-চোখ শিকার করে অন্ধকার...
পরিতোষ লিখে রাখে জলে
'মানুষের মানচিত্র থেকে খসে পড়ে মানুষ'।
মধ্যবিত্ত
............
পাশ থেকে উঠে এলো দুটো মধ্যবিত্ত হাত, তার অনাবৃষ্টির চোখে চৈত্রনিবাস,
মুখে অব্যক্ত বেদনার ভার, ঠোঁটে পড়েনি বহুকাল বরফজল
অথচ, বরফে জমে গেছে রেখে আসা উদ্বাস্তু সংসার।
কিছু কথা কেনাবেচার পর তিনি দীর্ঘশ্বাসে ছিদ্র করলেন বুক বিধাতার,
আমি হাসি চক্রবৃদ্ধিহারে যেহেতু স্রষ্টা আছেন ভেতরেও আমার ।
আগুন
........
আমাদের যাবার সময় হয়েছে, মিথ্যে হয়ে যায়নি মানুষের ভূগোল।
তুমি নিয়ে যাও যা-কিছু সম্ভব হেমন্তের কবিতা, নক্ষত্রের রাত, মাতাল জ্যোৎস্নার মিহিন ষড়যন্ত্র...
স্নানোৎসবগুলো, বৃষ্টিময় গাঢ় চোখ, বারান্দার কোণে কমবয়েসী চুম্বন, ঘরময় আঙুলে ছাপানো রাত্রির তন্দ্রাহীন মাধুরি গল্পগুলো রেখে যেও...
শহরে বিকেল ঢুকে পড়েছে, আরও কিছু দূরে রাত্রির ছায়া, সময় নেই... এ শহরে কী এক উৎসবের বেলুন উড়ছে!
মুখ ও মুখোশে বিচিত্র দৃশ্য চতুর্দিকে !
প্রিয়তমা, তোমাকে গোপনে বলি শোনো----'বিশ্বাস করো
বিচ্ছেদের চেয়ে ভয়াবহ আর কোনো অস্ত্র নেই...'