গত সোমবার
এসএসসির ফল প্রকাশ হয়েছে। জিপিএ-৫ পাওয়ার আনন্দে ভাসছে সামাজিক মিডিয়া।
যেসব ছাত্রছাত্রী ভালো করেছে, তাদের জানাই অভিনন্দন। যে কোনো কৃতকার্যতা
প্রশংসনীয়। এমন ভালো করে নিজেদের পাশাপাশি সমাজ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করা
সোনার ছেলেমেয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু যারা ভালো করতে পারেনি, তারাও যেন
নজর না এড়ায়। একটা বিশেষ পরীক্ষা বা বিশেষ কোনো সময়ে ভালো করতে পারা, না
পারায় জীবনের তেমন কিছু আসে-যায় না। কারণ জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড়
করায়, তা কেউ জানেন না। আমরা যদি দুনিয়া কাঁপানো সব মানুষের জীবনী পড়ি বা
জানি, তা হলে জানব- তাদের অনেকেই এক সময় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তাদের সেই
অকৃতকার্যতাই পথ করে দিয়েছিল নতুনভাবে চলার। ফলে এমন রেজাল্টই শেষ কথা নয়।
মূল
বিষয়ে আসি। এই যে এত আনন্দ আর উদযাপন, এর পর কী? এর পর বলতে আমি বোঝাচ্ছি
জীবনের কী হবে? জীবনে তাদের ভবিষ্যৎ কী? তাদের ৮০ শতাংশই দেশ ছেড়ে যাবে না।
বড়জোর ২০ শতাংশ পারবে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে ভালো কিছু করতে। দেশ ছেড়ে
যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠছে এ কারণে- আমাদের সরকারি লোকজন যাই বলুক না কেন,
বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। জীবনের নানা খাতে উন্নয়ন আর অগ্রগামিতা সুদূর
পরাহত। খালি দৃশ্যমান উন্নয়নে পেট ভরে না। সেতু, সুড়ঙ্গ বা উড়াল পুল দরকার
আছে। এগুলো আমাদের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এসবই কি সবকিছু?
একটি
জাতির মানদণ্ড হচ্ছে তার শিক্ষা। সেটুকু যদি নিশ্চিত না হয় বা অবহেলার
শিকার হয়, তা হলে তো সে জাতির কপালে দুর্ভোগ থাকবেই। আমাদের দেশে বছর বছর
এত শিক্ষার ফলাও খবরের পরও আমরা দেখি বেকারত্ব বাড়ছে। কারণ লেখাপড়া জানলেই
চাকরি হবে- এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। কেউ জানেন না কী দিলে বা কিসের
বিনিময়ে জুটবে, মিলবে একটি ভালো চাকরি? ভালো কাজ কী, তাও পরিষ্কার নয়।
আমাদের সময়কালে আমরা জানতাম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠাই জীবনের আদর্শ।
আমাদের আগে লেখালেখি বা তথ্য বলছে, পেশা হিসেবে সবার ওপরে ছিল
উকিল-ব্যারিস্টার। কথায় কথায় বলা হতো, বড় হয়ে কোন জজ-ব্যারিস্টার হবে? এখন
এসব চলে না। এখন সরকারি চাকরি আর প্রশাসক হওয়ার জোয়ার চলছে দেশে। আমি মনে
করি, এটা একটা খারাপ লক্ষণ। সবাই জানেন, দেশ ভালোবেসে বা চাকরি ভালোবেসে
কেউ এগোলো বলে না। এর পেছনে কারণ হলো অর্থ উপার্জন। গত এক দশকে দেশে সবকিছু
পাল্টে গেছে। সবার ওপরে চলে এসেছে সরকারি চাকরি। এর মূল কারণ চাকরিতে
বেতনের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা অধিক। টাকা নাকি পায়ে এসে গড়ায়। একদা সরকারি
চাকুরেদের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ার অভিভাবকরা এখন বেঁচে থাকলে কী করতেন,
জানি না।
বলছিলাম পড়ালেখা বা শিক্ষা প্রচারের এত রমরমা সময়ে বেকারত্ব
কী প্রমাণ করে? সরকার নিশ্চয়ই এ কথা বলবে না যে, কেউ ইচ্ছা করে বেকার থাকে?
চাকরি খুঁজতে থাকা যুবক-যুবতী ও তাদের অভিভাবক বা পরিবার জানে এ কেমন
কষ্ট। এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণের জন্য কত মানুষ বাধ্য হয়ে ঘুষ ইত্যাদির শিকার
হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। তার পরও চাকরি জোটে না।
বেকারত্বের পরিসংখ্যান বলছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের
উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে- ১৬ দশমিক ৮
শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। তা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল
আউটলুক ২০১৮’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। এতে ২০০০ থেকে
২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান,
নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি
ইত্যাদির তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে। তথ্য বলছে, কাজের বাজারের চাহিদার
সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা
বেড়েই চলেছে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের
প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছে অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের
(ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ
স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছে কেবল
আফগানিস্তানে- ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে ভারতে এ হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের
বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ ও শ্রীলংকায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক
মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২
শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে।
তাই নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে,
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বৃদ্ধি করা গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮
শতাংশে উন্নীত হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্য মতে, বর্তমানে
বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে
এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম।
সব মিলিয়ে সুখকর কিছু নয়
পরিবেশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে উত্তরণ সম্ভব? বেকার মানুষের কষ্ট লাঘবে
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের যে শিক্ষা, তা নেই; নেই পরিকল্পনা। দেশের যুবসমাজ
কী করে বা কী ভাবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই রাজনীতির। রাজনীতি ব্যস্ত আছে
সরকার আর বিরোধী দলের লড়াই নিয়ে। সে ফাঁকে কখন যে স্বপ্ন ঝরে পড়েছে, তা কেউ
জানেন না। অথচ বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা, তার সঙ্গে চলার জন্য চাই উপযুক্ত
শিক্ষা। জানি না- ধর্ম, না সমাজ, না উদাসীনতা এ জন্য দায়ী। তবে এটা জানি-
শিক্ষা তার আসনে নেই, চলছে না ঠিক পথে। চললে বেকারত্ব হ্রাস পেত, মানুষ
আনন্দে বাঁচতে পারত। করোনার পর বিশ্বে যে নেতিবাচক প্রভাব, তার বাইরে নয়
বাংলাদেশ। সব দেশের মতো আমাদের সমাজেও অভাব-অনটন বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে
আর বিশ্বপরিবেশ ঠিক না হলে চাপ আরও বাড়বে। এই চাপ সামলানোর জন্য দরকার
উপযুক্ত পদ্ধতি আর পরিকল্পনা। সেসব নেই বলেই আজ চারদিকে হতাশা। বেকারত্ব যে
বাড়ছে, সেটি সবাই জানেন। শুধু কেউ বলেন আর কেউ বলেন না। কিন্তু সমস্যার
চাপ সবাই টের পাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন একটাই- সবাই মিলে, বিশেষত শিক্ষার সঙ্গে
জড়িতরা কি মানবেন? তারা কি আমূল পাল্টে দিতে রাজি হবেন সবকিছু- যাতে মানুষ
বেকারত্ব থেকে মুক্তি পায়, উন্নয়ন হয় টেকসই? না হলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ
কি ছেড়ে কথা বলবে?
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক, সিডনি