বাংলাদেশের
অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তিন আর’এর ওপর- রেডিমেড গার্মেন্টস, রেমিট্যান্স আর
রাইস। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ‘রাইস’ মানে ধান ফলায়, আমাদের পেটের ভাত
জোগায়, অর্থনীতিকে সচল রাখে; তারাই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ। তাদের
প্রতি কারও নজর নেই। তাদের সুখ-দুঃখ কাউকে ভাবায় না। মূলধারার গণমাধ্যমেও
তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কৃষকরা যেহেতু পাঠক বা দর্শক নয়, তাই তারা
মিডিয়ার নজর পায় না। হঠাৎ করেই পাবনার ১২ কৃষক মূলধারার গণমাধ্যমের শিরোনাম
দখল করে ফেলে। চমকে ওঠার মতো খবরই বটে।
তবে শিরোনাম দেখে আমার একটি
ভারতীয় সিনেমার কথা মনে পড়ে গেলো। ছবির নাম মনে নেই। সম্ভবত তামিল সিনেমা।
একটি গ্রামের মানুষ পানির সমস্যায় পড়েছে। করপোরেট লোকজন কারখানা বসিয়ে
তাদের পানির উৎস কেড়ে নিয়েছে। তারা শহরে এসে দ্বারে দ্বারে ঘুরলো, আদালতে
গেলো, পত্রিকা অফিসে গেলো। কোথাও ন্যায়বিচার পেলো না, মনোযোগ পেলো না। শেষ
পর্যন্ত কৃষকরা শহরের মানুষের পানি সরবরাহের পাইপলাইন দখল করে নেয়।
আত্মহত্যার হুমকি দেয়। তাতেই টনক নড়ে সবার। বাংলাদেশের কৃষকদের অবশ্য
শিরোনাম হতে অত সাহসী হতে হয়নি। নিরীহ কৃষকরা ক্ষেতে কাজ করছিল। পুলিশ গিয়ে
সেখান থেকে ১২ জনকে ধরে নিয়ে আসে। খবর শুনে বাকিরা পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য
জাতীয় পর্যায়ের হইচই শুনে দ্রুত তাদের জামিন হয়ে যায়। তারা অবশ্য অপরাধী।
চাষের কাজে তারা সমবায় ব্যাংক থেকে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল।
আংশিক ঋণ শোধও করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ঋণ নিলে পুরোটা শোধ করতে হয়।
নইলে হাত থেকে লাঙল কেড়ে নিয়ে সেখানে দড়িবেঁধে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।
আদালতও তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। আইন সবার জন্য সমান।
কৃষক হলেও রক্ষা নেই। আইনের প্রতি সরকারের, পুলিশের, আদালতের এই গভীর
নিষ্ঠা দেখে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। তবে আইন যদি সত্যি সত্যি সবার
জন্য সমান হতো, সব ঋণখেলাপির হাতে যদি হাতকড়া পড়তো; তাহলে শুধু মাথা নত নয়,
সরকারকে আমি নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানাতাম।
এবার আপনারা আরেকবার একটু
পেছনে যান। এই কৃষকদের কারাগারে যেতে হয়েছে ‘২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা’ ঋণ
নিয়ে পুরোটা শোধ না করার অপরাধে। ভুল পড়েননি, ঠিকই লিখেছি, লাখ টাকা, কোটি
টাকা নয়, হাজার কোটি টাকা নয়; এই কৃষকরা ঋণ নিয়েছিল হাজার টাকার ঘরে। আইনের
এই কঠোর প্রয়োগ দেখে যারা খুশি, তারা ভাবতে পারেন হাজার টাকা ঋণ নিলে যদি
মাঠ থেকে ধরে দড়িবেঁধে কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে
না জানি কী হয়। তাদের নিশ্চয়ই ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে নেওয়া হবে। মজাটা এখানেই।
বাংলাদেশে যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় তারা সমাজের উঁচুতলায় বাস করে। আইন
তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। আমার এক বন্ধু একসময় গার্মেন্টস ব্যবসা করতো।
একবার একটি অর্ডারের টাকা না পাওয়ায় তার ব্যবসায় ধস নামে। সে প্রায় ফতুর
হয়ে যায়। ব্যাংকের করা মামলায় একবার জেলও খেটেছে। তারপর জমিজমা বিক্রি করে
সে কিছু টাকা জোগাড় করে ব্যাংকে আবেদন করেছে, সুদ মওকুফ করে শোধ করার
প্রক্রিয়াটা সহজ করে দিতে। টাকা দেওয়ার জন্য সে ব্যাংকের পিছে পিছে ঘুরছে।
কিন্তু ব্যাংক কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি নয়। এখন তাকে আবার কারাগারে যাওয়া
ছাড়া আর উপায় নেই। কারণ, তার সামর্থ্যের সীমা এটুকুই। আমার এই বন্ধুর
ক্ষেত্রেও ব্যাংকের অনড় অবস্থানে আইনের শাসনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আবার
বেড়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পারসোনাল লোন নেওয়ার অভিজ্ঞতা
থেকে আমি নিজেও দেখেছি, দুই কিস্তি বাকি পড়লেই ব্যাংক থেকে ফোনের পর ফোন
আসে। অনেকের বাসায় বা অফিসে ব্যাংক থেকে মাস্তান পাঠানোর কথাও শুনেছি। টানা
তিন কিস্তি বাকি পড়লে নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন
ব্যুরো-সিআইবিতে রিপোর্ট চলে যাবে। সিআইবি তালিকায় নাম থাকলে আর ঋণ পাওয়া
যাবে না। ঋণ আদায়ের এই কঠোর ব্যবস্থা দেখে আমি বারবার আশ্বস্ত হই।
বাংলাদেশে তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
খালি
মনে একটা প্রশ্ন জাগে, ক্ষুদ্র আর মাঝারি ঋণের ক্ষেত্রে এক কড়াকড়ি হলেও বড়
ঋণখেলাপিরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান কীভাবে? এত কঠোর আইন, আর আইনের এত
কঠোর প্রয়োগ থাকার পরেও বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যায়
কীভাবে? তাও অনেক ছাড় দিয়ে, অবলোপন করে, পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো খেলাপি
ঋণ কম দেখায়। নইলে খেলাপি ঋণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতো।
পত্রিকায়
একদিকে যখন কৃষকদের কারাগারে যাওয়ার খবর, অন্যদিকে থাকে ব্যাংকে লুটপাটের
খবর। ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার রহস্যজনক ঋণ নিয়ে তোলপাড়
চলছে। সোনালী ব্যাংকের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে সংসদীয় কমিটি।
সোনালী ব্যাংকের অনেক ঋণের জামানত নেই। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহককে খুঁজেই
পাওয়া যাচ্ছে না। বেসিক ব্যাংক বা ফারমার্স ব্যাংকের লুটেরাদের সবাই চেনে।
কিন্তু তাদের ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না।
হাইকোর্ট বারবার তাগিদ
দেন। কিন্তু সেই তাগিদেও কারও টনক নড়ে না। এই ঋণখেলাপিদের সামনে হাইকোর্ট,
দুদক সবাইকে অসহায় মনে হয়। ঋণখেলাপি কৃষকদের গ্রেফতারে উষ্মা প্রকাশ করে
হাইকোর্ট বলেছেন, ‘২৫ হাজার টাকার জন্য সাধারণ কৃষকদের কোমরে দড়িবেঁধে টেনে
নিয়ে যেতে পারেন, অথচ যাদের কাছে লক্ষ-কোটি টাকা পাওনা, তাদের কিছু হয়
না।’ অপর এক মামলার শুনানিতে উচ্চ ঋণখেলাপিদের প্রসঙ্গে দুদকের আইনজীবীকে
হাইকোর্ট বলেছেন, ‘এদের কেন ধরতে পারছেন না। এদের ধরবে কে? ধরা হচ্ছে
চুনোপুঁটি। এতে কী বোঝা যায়, যারা অর্থশালী, ক্ষমতাবান তাদের কি কিছু হবে
না। এরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে?’ এই প্রশ্ন আমারও, এই ক্ষমতাবান
ঋণখেলাপিরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে?
সব দেখে শুনে আমার একটা জিনিস
মনে হয়েছে, এই দেশে হাজার তো নয়ই, লাখের অঙ্কেও ঋণ নেওয়া যাবে না। ঋণ
নেয়াটা তখন অপরাধ। তিন কিস্তি না দিলেই ব্যাংক আসবে, পুলিশ আসবে। ঋণ নিতে
হবে লাখ কোটি বা হাজার কোটির ঘরে। তাহলে আপনি নিরাপদ, নিশ্চিন্ত। ১০ হাজার
কোটি ঋণ নিয়ে ৫ হাজার কোটি টাকায় সবাইকে কিনে ফেলবেন। বাকি ৫ হাজার কোটি
টাকায় আয়েশ করবেন। ব্যাংক আপনাকে সালাম দেবে, পুলিশ আপনাকে স্যালুট দেবে।
ভুলেও কৃষকের মতো ২৫ হাজার টাকা ঋণ নেবেন না। কথায় বলে না, মারি তো গন্ডার,
লুটি তো ভান্ডার।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ