৩৭
ইংরেজিতে যাকে নভেল বলে বাংলায় তাকেই বলে উপন্যাস। কেউ কেউ নবন্যাসও বলেন। তার কারণ নভেল কথাটার অর্থ নবীন বা অভিনব। নভেলের কাছে লোকের প্রত্যাশা অভিনবত্ব। লোকে চায় নিত্য নতুন আখ্যান। আখ্যান যদি নিত্য নতুন না হয় তবে ব্যাখ্যান হবে নিত্য নতুন। বলবেন যাঁরা, লিখবেন যাঁরা তাঁরা যদি নতুন কিছু বানাতে না পারেন তবে নতুন ভঙ্গীতে বলবেন, নতুন আঙ্গিকে লিখবেন, নতুন ছদ্মবেশ পরাবেন। চরিত্রের মধ্যে নতুনত্ব আনবেন।
উপন্যাস যখন ছিল না তথ্য লোকে পুরাণ শুনত বা পড়ত। তাতে হয়তো অভিনবত্বের সাধ মিটত না, কিন্তু গল্প শোনার সাধ মিটত। মানুষমাত্রেই শিশুবয়স থেকে বা আদিকাল থেকে কাহিনী শুনতে ভালবাসে। কাহিনী না শুনে শিশু ঘুমোতে যায় না। আদিমানব ছিল শিশুর মতো। সন্ধ্যা হলে তার হাতে আর কাকজর্ম থাকত না। শুনত পুরাণ কথা অলৌকিক উপকথা।
সেই যে গল্প শোনার চিরকালের সাধ সেই সাধই নিত্য নতুন উপন্যাস পড়ার সাধ। একালে কথক নেই, তাঁদের জায়গায় আছেন কথাসাহিত্যিক। তাই বানিয়ে বানিয়ে শোনান। তফাতের মধ্যে এই যে বিষয়বস্তু পুরানের থেকে নেওয়া নয়, জীবনের থেকে নেওয়া। অবশ্য জীবনের থেকে নেওয়া হলেও কল্পনার খাদ দেওয়া। কল্পনার খাদ না মেশালে পুরাণও হয় না, উপন্যাসও হয় না। আর কল্পনার খাদ না মেশালে তাকে উপন্যাস না বলে জীবনী বা ইতিহাস বলাই সঙ্গত। নতুনই হোক আর পুরাতনই হোক উপন্যাসকে গোড়াতেই হতে হবে আখ্যান বা কাহিনী বা গল্প। যাতে কল্পনার ভাগ হয়তো অল্প। অথচ শ্রোতার বা পাঠকের কাছে তা কল্পনার মতো মনে হবে না। মনে হবে সেইটাই প্রকৃত। উদ্ভট বা উদ্দাম কল্পনার কথা হচ্ছে না। লোকে সেটাকে অপ্রকৃত বলেই জানে আর জেনেও ভালবাসে। একপ্রকার উপন্যাস আছে সেইটাই যার বিশেষত্ব। কিন্তু সাধারণত উপন্যাস বলতে আমরা যা বুঝি তাতে কল্পনার পক্ষবিস্তারও স্বাভাবিকতার নিয়ম মেনে চলে সেই জন্যে পাঠকের বিশ্বাস করতে বাধে না যে উপন্যাসে। আগাগোড়া সত্য। যদিও তার অনেকখানি বানানো বা ফেনানো।
লেখকের সে পরিমাণ স্বাধীনতা না থাকলে তিনি বছর বছর নতুন নতুন উপন্যাস লিখবেন কি করে? বছর বছর দূরে থাক সারা জীবনেও লিখতে পারবেন না। পাঠকের কাছে সে একটা সনদ আদায় করে নিয়েছে। সে সত্য কথা বলবে, কিন্তু সত্য কথা বানিয়ে বলবে। এটা আমার নিজের উক্তি নয়, রবীন্দ্রনাথের উক্তি।
লেখকরা তাঁদের সিক্রেট কাউকে জানতে দেন না। তা হলেও এটা বোধ হয় সকলেরই জানা যে লেখকদের অমুক অমুক চরিত্র সম্পূর্ণ স্বকলোপকল্পিত নয়, অমুক অমুক ব্যক্তিকে মডেল করে আঁকা। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি স্বীকারোক্তি হাতের কাছে পাচ্ছি, তাই তুলে দিচ্ছি। চিরকুমার সভা নিয়ে আলোচনা।
‘চন্দ্রমাধববাবুর চরিত্রে অনেক মিশল আছে, তার মধ্যে কতক মেজদাদা, কতক রাজনারায়নবাবু এবং কতক আমার কল্পনা আছে। নির্মলাও তথৈবচ-এর মধ্যে সরলরা অংশ অনেকটা আছে বটে, কিন্তু বিয়াল মানুষ প্রত্যহ আমাদের কাছে যেরকম প্রতীয়মান সেরকমভাবে কাব্যে স্থান পাবার যোগ্য নয়। কারণ রিয়াল মানুষকে যথার্থ ও সম্পূর্ণভাবে জানবার শক্তি আমাদের না থাকাতে আমরা তাকে প্রতিদিন খন্ডিত বিক্ষিপ্ত এবং অনেক সময় পূর্বাপরবিরোধী ভাবে না দেখে উপায় পাইনে-কাজেই তাকে নিয়ে কাব্যে কাজ চলে না। সুতরাং কাব্যে যদি কোনো কোনো রিয়াল লোকের আভাসমাত্র থাকে তবু তাকে সম্পূর্ণ করতে অন্তর বাহির নানা দিক থেকে নানা উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়। চন্দ্রমাধবে মেজদার শিশুবৎ স্বচ্ছ সারল্যের ছায়া আছে এবং নির্মলায় সরলার কল্পনাপ্রবণ উদ্দীপ্ত কর্মোৎসাহ আছে-কিন্তু উভয় চরিত্রেই অনেক জিনিস আছে যা তাঁদের কারোরই নয়।” (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় খন্ড। কাজী আবদুল ওদুদ)। টলস্টয়ের উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের মডেল তিনি কোথায় কোথায় পেয়েছিলেন সেটাও জীবনীকারদের অবিদিত নয়। ডসটয়ভস্কির পাত্রপাত্রীদের সম্বন্ধেও অনুরূপ তথ্য আবিস্কৃত হয়েছে। আরো অনেকের নাম করতে পারি, কিন্তু আসল কথাটা হলো প্রত্যেক চরিত্রেই এমন অনেক জিনিস আছে যা তার মডেলের নয়। মডেলকে সামনে রেখে আঁকলেও কথাসাহিত্যিকরা ঠিক প্রতিকৃতিচিত্রকর নন। তাঁরা একটির সঙ্গে আরো পাঁচটি মিশিয়ে দিয়ে আর কল্পনা ফলিয়ে যে চরিত্র সৃষ্টি করেন তা প্রকৃতির হাতে গড়া নয়, তা মানুষেরই মনগড়া। অথচ অকৃত্রিম।
চরিত্রের কথা যখন উঠল তখন বলি যে, উপন্যাস কখনো চরিত্র বাদ দিয়ে হতে পারে না। নাটকও তাই। নায়ক থাকবে, নায়িকা থাকবে, আরো কয়েকটি পার্শ্বচরিত্র থাকবে, এইটিই পাঠকের প্রত্যাশা। একালের উপন্যাসে অনেক সময় নায়ক বা নায়িকা বলে কাউকে চিনিয়ে দেওয়াটা রীতি নয়, বিভিন্ন চরিত্রের উপর সন্ধানী আলো ফেলে এক এক করে প্রত্যেককে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে চরিত্র জিনিসটা এখনো উপন্যাস থেকে উঠে যায়নি। ওটা যদি কোনদিন বাহুল্য হয়ে ওঠে উপন্যাসকে আর উপন্যাস বলে চেনা যাবেই না। তেমন পরীক্ষানিরীক্ষা যে আদৌ চলছে না তা নয়। হাজার পরীক্ষানিরীক্ষার পর হয়তো দেখা যাবে যে, নায়কনায়িকাবর্জিত উপন্যাস অসম্ভব নয়, কিন্তু চরিত্রবর্জিত উপন্যাস পাত্রপাত্রীবর্জিত নাটকের মতোই অসম্ভব। ভাস্কর্যে ও চিত্রকলায় অ্যাষ্ট্রাকট চলতে পারে, কিন্তু নাটকে উপন্যাসে নয়।
উপন্যাসের থাকবে অভিনবত্ব, থাকবে আখ্যান, থাকবে নায়ক নায়িকা বা চরিত্র। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়। চরিত্র থাকলেই তার বিকাশ থাকে, নিয়তি থাকে। তার মানেই হলো অ্যাকশন বা ক্রিয়া। ক্রিয়াবর্জিত নাটক হয় না, উপন্যাস হয় না। হতে পারে কবিতা বা প্রবন্ধ। তবে চলতি অর্থে অ্যাকশনবর্জিত। চেতনাপ্রবাহকে আমি অ্যাকশন বলিনে, কারণ অ্যাকশন এক জায়গায় শুরু হয়, এক জায়গায় সারা হয়, মাঝখানে থাকে সময়ের ধারাপাত, অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ। চেতনাপ্রবাহ কালের করোট মানে না। তার গতিতেও নেই অনিবার্যতা। অথচ অনিবার্যতা না হলে নাটক-উপন্যাসের পরিণতি হয় না। আবহমানকাল আমরা যেসব নাটক উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত তাদের শেষটা শুধু ঘড়ির হিসাবে শেষ নয়, ঘটনার হিসাবেও শেষ ক্রিয়ার হিসাবেও শেষ। উপন্যাসের অ্যাকশন কোথাও এক জায়গায় পৌছে দেয়। অনিবার্যভাবেই পৌঁছে দেয়। নাটকের তাই।
ধারাবাহিকতা না থাকলে উপন্যাস হয় না। তবে সে ধারা মাঝে মাঝে উজানে বইতেও পারে। ফ্ল্যাশব্যাক যার নাম সে জিনিস আগেকার দিনেও ছিল। ফাউষ্টে ও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকও অবশেষে ক্রিয়ার পরিণামকে অতীতের থেকে বর্তমানে ও বর্তমানের থেকে ভবিষ্যৎ অভিমুখী করে। অর্থাৎ কাহিনীটা যতবার দরকার অতীতমুখী হলেও শেষ পর্যন্ত তার পরবর্তীকালের অভিমুখী। সময় যেন একটি বহমান নদী। সে কাহিনীর কার্যকারণ সম্পর্কও থাকে কিংবা থাকতে পারে। যদিও সর্বত্র লক্ষিত নয়। অ্যাকশনের পরিনতির জন্যে, কার্যকারণ সম্পর্কের প্রতিপাদনের জন্যে, চরিত্রের বিকাশের জন্যে, নিয়তির অনিবার্যতার জন্যে নাটকে যত সময় অতিবাহিত হয় উপন্যাসে হয তার চেয়ে সাধারণত বেশী, অনেক বেশী। উপন্যাস এক্ষেত্রে মহাকাব্যের সঙ্গে তুলনীয়। মেঘদূত ফাউষ্ট ইলিয়াড অডিসি প্রভূতি মহাকাব্যও এক হিসাবে উপন্যাস। তখনকার দিনে গদ্য রচনা ছিল না, থাকলে হয়তো ওসব গদ্যেই রচিত হতো। আজকাল যাঁরা শাহনামার মতো বিরাট গ্রন্থ লিখতে চান তাঁরা পদ্যের আশ্রয় না নিয়ে গদ্যের আশ্রয় নেন। ফলে মহাকাব্য না হয়ে মহা উপন্যাস হয়। উপন্যাসের মধ্যেও মহাকাব্যের লক্ষণ মেলে টলস্টয় ডষ্টয়েভস্কির গ্রন্থে। টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি অনেকের মতে একখানি এপিক। ডষ্টয়েভস্কির ‘কারামাজভ ব্রাদাস’ সম্বন্ধেও সে কথা কাটে। আয়তন বৃহৎ হলেই যে মহাকাব্য বা এপিক উপন্যাস হয় তা নয়। আরো দীর্ঘ উপন্যাসও লেখা হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে এপিকের জীবনদৃষ্টি নেই। ক্যানভাস বড়ো না হলে সত্যিকারের ভালো উপন্যাস হয় না, এটা ঠিক। তা হলে ক্যানভাসটাকে যত খুশি বড়ো করলেই যে এপিক উপন্যাস হবে তাও নয়। আমাদেরই কালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে, তা নিয়ে বড়ো বড়ো উপন্যাস যদি ইতিমধ্যে লেখা হয়ে না থাকে তবে একদিন একদিন হবে। কিন্তু লিখলেই যে এপিক উপন্যাস হবে তা জোর করে বলা যায় না। ক্যানভাসের চেয়ে আরো বড়ো জিনিস জীবনদৃষ্টি। সেই জীবনদৃষ্টি সবাইকে দেওয়া হয় না। সেই জন্যে মহাকাব্য যদিও রাশি রাশি লেখা হয়েছে এপিক বলতে অল্পই বোঝায়। তেমনি এপিক উপন্যাস বলতে।
সে যাই হোক উপন্যাসের আয়তন সাধারণ নাটকের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। কারণ উপন্যাস হলো বিবরণাত্মক। নাট্যাত্মক নয়। বেশ খানিকটে পরিসর না পেলে উপন্যাসের রস জমানো যায় না। কিন্তু ছোট উপন্যাসও অনেক লেখা হয়েছে। সে সব উপন্যাসও রসোত্তীর্ণ হয়েছে। তবে একথা বলা শক্ত সেগুলি ছোট উপন্যাস বা বড়ো গল্প। নভেল নামের একটা মহিমা আছে, বড়ো গল্প নামের তেমন কোন মহিমা নেই। অপর পক্ষে ছোট গল্পও অনেক সময় উপন্যাসধর্মী। সংক্ষিপ্ত বলেই যে তা অন্য জাতের, তা নয়। উপন্যাস ও ছোটগল্প দুই স্বতন্ত্র জাত।