দীর্ঘ মন্দার পর হঠাৎ একটানা উত্থান, এরপর আবার অব্যাহত দরপতন। শেয়ারবাজারের এমন আচরণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এতে শেয়ারবাজার ছেড়ে দিচ্ছেন অর্থাৎ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ।
এক মাসের ব্যবধানে মে মাসে বিও হিসাব কমে গেছে সাড়ে সাত হাজারের ওপরে। অথচ এর আগে ডিসেম্বর থেকে টানা বিও হিসাবের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে গত নভেম্বর থেকে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরে দেশের শেয়ারবাজার। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে বাড়ে মূল্য সূচক ও লেনদেনের পরিমাণ। সূচক ও লেনদেনের সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেও অব্যাহত থাকে। ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাওয়া লেনদেন হাজার কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করে দুই হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। আর সাড়ে চার হাজার পয়েন্টের নিচে থাকা ডিএসইর প্রধান সূচক টানা বেড়ে ৫ হাজার ৭০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়।
শেয়ারবাজারের এমন উত্থানে আবার নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা অনেক বিনিয়োগকারী সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে বাজারে আসতে থাকেন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী। ডিসেম্বর মাসে বাজারে প্রবেশ করেন নতুন প্রায় ১৯ হাজার বিনিয়োগকারী। নতুন বিনিয়োগকারীদের এ আগমন অব্যাহত থাকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী প্রবেশ করেন অর্থাৎ বিও হিসাবের সংখ্যা বাড়ে ২১ হাজার ৩৩৫টি। এ সময়ে প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে বাড়ে বিও হিসাবের সংখ্যা।
তবে এপ্রিলে এসে আবারও দরপতনের কবলে পড়ে শেয়ারবাজার। দুই হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করা লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে চলে আসে। আর ডিএসইর প্রধান সূচক কমতে কমতে সাড়ে পাঁচ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। মে মাসেও এ দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন ৯ এপ্রিলের পর গত আড়াই মাসে আর হাজার কোটি টাকা স্পর্শ করতে পারেনি। এমন টানা উত্থানের পর টানা পতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। যে কারণে মে মাসে বেশকিছু বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব বন্ধ করে দেন।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে আস্থার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। যে কারণে মাঝে মধ্যে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলেও তা স্থায়ী হয়নি। ফলে দীর্ঘ হয় দরপতনের ধারা। ২০১০ সালের ধসের পর বেশ কয়েকবার বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলেও এবারের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
সঞ্চয়পত্র, এফডিআইসহ সব ধরনের আমানতের সুদের হার বেশ কম। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের খুব বেশি বিকল্প উৎসও নেই। ফলে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসা অনেকটা স্বাভাবিক। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাজারে যেভাবে উত্থান ঘটে এবং এরপর যেভাবে পতন হয় তা অনেকটা অস্বাভাবিক। যে কারণে হয়তো অনেকের মধ্যে আবারও বড় লোকসান হতে পারে এমন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
তাদের মতে, ডিসেম্বরের পর মঝে কিছুদিন অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হলেও এখন বাজার অনেকটা স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের বাজার ছেড়ে যাওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। সামগ্রিক মুদ্রা বাজারের যে অবস্থা তাতে আশা করা যায় শিগগিই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
সেন্ট্রাল ডিপোজেটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, মে মাস শেষে বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৮৬টি। যা এপ্রিল মাস শেষে ছিল ২৯ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৮টি। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে বিও হিসাব কমেছে ৭ হাজার ৫৬২টি।
মাসটিতে মোট বিও হিসাব কমলেও প্রাতিষ্ঠানিক, অমনিবাস ও ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্ট বিও হিসাবের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ মে মাসে যেসব বিও হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে এর সবই ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে এক বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ৩ হাজার ২৩৬টি। আর যৌথ বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ৪ হাজার ৩৯৩টি। অর্থাৎ মাসটিতে একক ও যৌথ মিলিয়ে বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ৭ হাজার ৬২৯টি।
এদিকে, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়লেও প্রতিষ্ঠানিক ও ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্ট বিও হিসাব বেড়েছে। মে মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিও হিসাবে বেড়েছে ৬৩টি। অমনিবাস হিসাব বেড়েছে ২টি। আর ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্ট বিও হিসাব বেড়েছে ২টি। এর মধ্যে প্রিন্সিপাল একটি এবং ক্লিয়ারিং বিও হিসাব রয়েছে একটি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, এ মুহূর্তে বিও হিসাব কমলো কীভাবে এটি আমি বুঝতে পারছি না। বিনিয়োগকারীদের এখন বিও হিসাব ক্লোজ (বন্ধ) করে দেয়ার মতো যুক্তিসংগত কোনো কারণ আমি দেখছি না। তবে বাজার এখন খুব একটা ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে না, এতে ক্যাপিটাল গেইন সেভাবে হচ্ছে না। সে কারণে হয়তো কেউ কেউ বিও হিসাব বন্ধ করে দিতে পারেন।
তিনি বলেন, ডিসেম্বরের পর বাজারে কিছুদিন টানা উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটলেও সেটা খুব বড় মাপের ছিল না। আর এখন বাজারে টানা উত্থান বা টানা পতন নেই। বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। এক-দু’দিন বাড়ছে আবার কমছে। খুব বড় ধরনের উত্থান বা পতন বাজারে নেই।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, এখন আইপিও কম আসছে। আবার আইপিওতে আবেদন করলে লটারিতে তেমন একটা বাধছে না। আইপিও পেলেও তা বিক্রি করে তেমন লাভ পাওয়া যাচ্ছে না। আগে আইপিওতে পাওয়া শেয়ার বেশি দামে অর্থাৎ ১০ টাকার শেয়ার ৮০ টাকায় বিক্রি করা যেত, এখন আর তেমন হচ্ছে না। এখন ১০ টাকার শেয়ার বড়জোর ২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে বিও হিসাব কিছু কমছে। আর যেসব বিও হিসাব কমছে সেগুলো থেকে মূলত আইপিও আবেদন করা হতো।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার হাসান বলেন, বিও হিসাব সচল রাখতে বিনিয়োগকারীদের একটি খরচ বহন করতে হয়। এখন আইপিও সেভাবে আসছে না। ফলে আইপিওতে আবেদন করে বিনিয়োগকারীরা যে মুনাফা পাচ্ছেন তাতে বিও হিসাবের খরচ মেইনটেইন করে হয়তো বিনিয়োগকারীরা খুব একটা লাভ করতে পারছেন না। যে কারণে কিছু বিনিয়োগকারী তাদের আইপিও’র বিও হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী সঞ্চয়পত্র ধরতে শেয়ারবাজার ছাড়ছেন। কারণ অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে। সুতরাং এখন সঞ্চয়পত্র কিনে রাখলে বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। এ চিন্তা থেকেও কিছু বিনিয়োগকারী আইপিও হিসাবে অর্থ খরচ না করে সঞ্চয়পত্র কিনছেন। সূত্র: জাগোনিউজ।