আনোয়ারুল হক ||
তৃতীয় পর্ব-২৫
স্মৃতির
মতো বেদনায় মুগ্ধ প্রশান্তি আর কী আছে! টোকা দিলেই যেন ধূলোবালি জমে থাকা
মনের দেয়াল থেকে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়তে থাকে। আর তার কী মধুর ভাললাগা। মনে
থাকে। মনে আছে। ভুলে যাওয়া গেল না কিছুতেই।
ভৌগলিক দূরত্বে আমার এখান
থেকে পৃথিবীর ঠিক উল্টোদিকে থাকে আশু। আমেরিকার ডালাসে। সেই যে গেছে প্রায়
তিরিশ বছরের ওপর হয়ে গেল আজ পর্যন্ত একবারও সে দেশে এলো না। ছবিতে দেখলে
অথবা ফোনে কথা হওয়ার সময় বুকের ভিতর চাপা ভারী বাতাস যেন ফুঁ দিয়ে থেকে
থেকে লেখা পাতাগুলো উল্টিয়ে দেয়। চোখে দেখি, জীবনের সাদা-কালো নড়াচড়া করে।
বলে রাখি, এই লেখা আমার প্রিয় বন্ধু, একদা দিবা-রাত্রির সহচর স্টেশন রোডের
মুন্সি বাড়ির ছেলে আশু পড়বে না। কেননা, মাসাধিককাল হয়ে গেলো সে আমাদের
সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে লোকান্তরিত হয়েছে।
ধরা যাক মেয়েটির নাম ছিল
শশি। সে ছিল আশুর মনের মতো মেয়ে। প্রথম দেখাতেই তার মনে হয়েছে আরাধ্য এই
কন্যার মন মাখনের মতো নরম। আমি বন্ধুকে শশির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার
পরপরই খুব দ্রুত ওদের দু’জনের নাম বিশ^বিদ্যালয়ের লাভলেনের বাকুম বাকুম
তালিকার হিট লিস্টে চলে আসে। আমরা সবাই জানতাম এই জোড় কখনো ভাঙবে না।
ইতিহাসের পাতায় ওরা সার্থকতার নাম লেখাবে।
লিখিয়েছে বটে, সেটাই- যা কিনা বিধির খাতায় চিত্রগুপ্ত আগেই লিখে রেখেছিলেন। ঝরাপাতা ঝরে যাবে সময়ে।
কুমিল্লায়
থাকতে আমার সহপাঠি শশির প্রফেসর পাড়া সমবায় অফিসের পশ্চিমপাশে (একসময়
সাপ্তাহিক ‘রঙধনু’ পত্রিকার অফিস ছিল) বাসায় আমার যাওয়া আসা ছিল দিনরাত,
যখন তখন। একসাথে পড়াশুনা চলাফেরা করলে, আড্ডা দিলে সবাই যেমন ভাবে তেমনি
ভেবেছে কেউ কেউ। আমার সাথে শশির গভীর কোন সম্পর্ক আছে। কিছু রটনা ছিল।
কিন্তু বান্ধবির জন্যে আমার নিজের দিক থেকে তেমন কোন দুর্বলতা কখনোই ছিল
না। আমার জীবনে আমি নিজের অবস্থা অবস্থান বিচার করেই সব সময় এগিয়েছি। কী
করা যাবে আর কী করা যাবে না এই সিদ্ধান্ত আমাকে বুঝে শুনেই সবসময় নিতে
হয়েছে।
জানা ছিল আমার, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। শশি খুব ভালো মেয়ে
সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর মতো মেয়েদের যে মানসিকতা এবং পারিবারিক পরিবেশ তার
সাথে আমাদের মতো কারোরই কোনদিন খাপ খাওয়ার কথা না। আর প্রথম থেকেই সে ছিল
আমার ভাল বন্ধু। ওর সঙ্গ, একসাথে পড়ার কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা সবই আমার পছন্দ
এবং ভালো লাগার বিষয় ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, পিতৃহীন শশির মা, বোনসহ
তাদের বাসায় সময় কাটাতে আমাদের আনন্দের কোন অভাব ছিল না।
আশুও আমার
প্রথম পছন্দের প্রিয় বন্ধু। আমার মতো সেও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
কুমিল্লা রেলস্টেশন রোডে প্রাচীন বনেদি পরিবার মুন্সি বাড়ির ভোলাভালা বাপের
বড় ছেলে আশু। বিশাল আকাশের মতো তাদের চিত্তের উদারতা থাকলেও তখন আর আগের
মতো বিত্ত ছিল না। দেখতে শুনতে খুবই স্মার্ট এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের
যুবক আমার বন্ধুটি । একবার ভেবেছিলাম তাকে নিষেধ করি, করলাম না। করলে যদি
ভুল বুঝে!
আর ততদিনে ডুবে ডুবে জল খাওয়া প্রেমিক প্রবর আমাকে জানিয়ে
দিয়েছে, শশির দিকে তার নজর আজ থেকে নয়, ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন
থেকেই ছিল। বাংলা অনার্সে ভর্তি ফরম জমা দিতে গিয়ে শশি আর পিলু দুই বান্ধবী
যে লাইনে দাঁড়িয়েছিল তার পাশেই অন্য লাইনে অর্থনীতিতে ভর্তি হওয়ার জন্যে
অপোয় ছিল আশু। বলা ভালো, সে আমলে উচ্চবিত্তের মেয়েরা যেমন পোশাক পরিধান করে
সেইরকম আধুনিক পোশাকই ছিল মেয়েটির পরনে। হাঁটুর ওপরের দিকে স্কিন টাইট আর
নিচের দিকে ঢোলা যাকে তখন বলতো ‘বেলবটম’, সেলোয়ার তার ওপর সাদা জমিনে নীল
অপরাজিতা ফুলের ছাপ দেয়া হাফ হাতা কামিজ এর সঙ্গে মানিয়ে ওড়না। চোখে পড়ার
মতো সাজ অবশ্যই। সেদিন পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে আশু এবং শশি দু’জনের দৃষ্টি
বিনিময় হয়েছে বটে তবে কোন কথা হয়নি।
শুনেছি. বিধির হাত নাকি থাকে অনেক
লম্বা। তার দশটি আঙুল। তার মানে দশদিকে তার নজর। পালাবার কোন উপায় নাই।
জানতেই পারা যাবে না কখন যে ঘটনার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ! কী
সাংঘাতিক! গ্রীক নাট্যকার সফোকিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের হতভাগ্য চরিত্র রাজা
লেয়াসের পুত্র ইডিপাসের! বেচারা জানতেই পারলো না কী জঘন্য পাপ করে সে
সিংহাসনে বসে আছে!
তেমনি সদা হাস্য আশু কী জানতো তার পরিণতি বিষাদের আঁচড়ে একদিন এমন বিপর্যস্ত হবে? সবকিছু ওলটপালট, অপ্রত্যাশিত হয়ে যাবে?
জানতো না সে। ভাবিনি আমরাও।
তবে
যারা নারী চরিত্র বুঝেন তারা যখন এইসব কথা আগেই বলে দেন তারপরেও কি কেউ মন
দেওয়া নেওয়া এড়িয়ে যায় ? নাকি নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য বাংলা সিনেমার
ভিলেন হয়ে গদা হাতে মাঠে নেমে পড়ে! কোনটাই না।
চোখেমুখে প্রকাশ পেতো
সবসময়, শশির কথাবার্তা, রসবোধ, পরিমিত সাজসজ্জা, সহজে আপন করে নেয়ার মতা
সবই সেইসময় আশুকে মুগ্ধ শিশু বানিয়ে রেখেছিল।
তবে ওদের দু’জনের সাথে
খুব বেশি দেখা হতো না আমার। নিয়মিত ওদের খবর পেতাম। ভালো আছে। শুনতাম, ডানা
থাকলে নাকি আকাশের নীলে উড়ে যেত। যখন তখন। লাভলেনে দেবদারু ছায়ার নিচে
বিকেলে গোধূলি এবং সন্ধ্যায় জোনাকীর সাথে তাদের খুব মিতালী।
মনে দৃঢ়
বিশ্বাস জন্মেছিল আমাদের, তারা দু’জন দু’জনকে খুব ভালবাসে। অন্তিমে জেনেছি,
জেনে খুব মর্মাহত হয়েছি। আমার ধারণা ভুল ছিল। নারী চরিত্র দুর্জ্ঞেয়। যে
ভালবাসে মেয়েরা নাকি তাকে ভালবাসবে না। কিছুতেই না, কোনদিনও না। এটাই নাকি
নিয়ম। যে ঘৃণা করবে তাকেই জয় করার জন্যে এগিয়ে যাবে।
আশু ভালবেসেছে কোন
বিচার না করেই। কিন্তু শশি তা নয়। দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সে হিসেব
করে দেখেছে। এক বন্ধে কুমিল্লা গিয়ে মুন্সি বাড়িতে ঘুরেও এসেছে। মিলিয়ে
দেখেছে, হবে না, হয় না। তাই শশি ওর সময়মতো ‘সরি’ বলে সরে গেছে। সরে এসে
শশিরা আর পিছনে তাকায় না। তারা জানে, ভবিষ্যতের মুখ থাকে সামনের দিকে।
এদিকে
আমি অলকার চিঠি পাই নিয়মিত। ভিতরে শুকনো গোলাপের পাপড়িও থাকে কিন্তু আগের
সেই সুরভীটা কেন জানি খুঁজে পাই না। মনটাকে শান্ত রাখার জন্যে নিকির সঙ্গে
ইচ্ছে হলে ঘুরে বেড়াই। একদিন একা যেতে সাহস পায় না বলে একবিকেলে কেনাকাটা
করার জন্যে নিকি আমাকে নিয়ে শহরে গেল। নিউমার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে কথায় কথায়
জানালো, আগামীকাল ওর জন্মদিন।
শুনে সৌজন্যবশত: একটা কিছু গিফট করার
ইচ্ছে হলো। ততদিনে আমি বেশ কিছু টাকা স্কলারশিপ পেয়ে গেছি। এতে বাপজান একটু
স্বস্তি পেয়েছিলেন। ডাইনিং হলে খাওয়া বাবদ প্রায় ছ’মাসের টাকা দেয়ার পর
পকেটে ইচ্ছেমতো খরচ করার জন্যে আরও কিছু টাকা অবশিষ্ট ছিল। এজন্যে নিকির
পছন্দেই তাকে একটা সুদৃশ্য গলার ইমিটেশন ‘লকেট’ কিনে দিলাম। খুব খুশি হলো
সে।
উপহার দেয়ার দিন দুয়েক পর-বলেছি আগে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দিন
নিকির শর্ত ভঙ্গের খবর পেলাম রফিকের কাছে। শুনে রাগ হলো খুব। আরও বেশি রাগ
হলো যখন শুনলাম, নিকি অর্থনীতিতে পড়ে আমার সহপাঠি খোরশেদ, যাকে আমি আগে
থেকেই কোন কারণে পছন্দ করি না, তার সঙ্গে জোবরা গ্রামের প্রান্তে লেকের জলে
নৌকা বিহার করতে গেছে। খুব খারাপ লাগলো ভেবে, আহা! কী ভুল পথে পা বাড়িয়েছে
নিকি। খোরশেদকে যে আমি চিনি।
যাই হোক, আমার কী? পরদিন সকাল দশটার দিকে
ক্যান্টিনে নাস্তা খেয়ে মেয়েদের হলে গিয়ে প্রথমে সহপাঠি সালেহা ভাবীকে
ডাকলাম। সালেহা ভাবী আমাদের সিনিয়র সাথী ভাইয়ের বউ। সকলের ভাবী। খুব
হাসিখুশি এবং মিশুক। বর্তমানে তিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রথম সারির কর্মকতা।
ভাবীকে বললাম,
-‘ভাবী নিকিকে ডেকে আনো। কথা আছে’।
সালেহা ভাবী কল্পনাও করেনি আমি কী করবো। নিকি হাসতে হাসতেই সামনে এলো।
গলায় লকেটটা ঝুলছে তখনো যথারীতি। বললাম,
-‘নিকি, তুমি শর্ত ভঙ্গ করেছো। আমার দেওয়া গলার লকেট পড়ে ঘুরে বেড়াবে খোরশেদের সঙ্গে ? তা হয়না। তুমি আমার লকেট ফেরৎ দাও’।
আমার কথা শুনে সালেহা ভাবী হাসছে পাগলের মতো। আমি ডান হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি নিকির সামনে!
(চলবে)
১২.০১.২০১৭
প্রফেসর (সাবেক),বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। কুমিল্লা। ০১৭১৫১২৭০৪৪