চাইলেই চলে যাওয়া যায় বিশ্বের যেকোন প্রান্তে। ভ্রমণের আসলেই কোনো সীমা নেই, যেমন নেই ভালোবাসারও। কিন্তু ঘরের পাশেই যদি চমৎকার কিছু নয়নাভিরাম জায়গা পাওয়া যায়, তাতেও ভ্রমণের আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। যারা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে কলকাতাও যা, কুমিল্লাও তা। সৌন্দর্য উপভোগই যার মূল উদ্দেশ্য, সাথে ইতিহাস জানাটা যোগ করে অতিরিক্ত এক মাত্রা। সেই সব এলাকার মানুষের জীবন-যাপন, সামাজিক রীতি-নীতি এ সবই ভ্রমণের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ।
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম কুমিল্লা। এর আগেও গিয়েছি, কিন্তু শহরটির গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো ঘুরে দেখাই হয়নি। তাই মাত্র দু’দিনের জন্য গিয়েছিলাম সেখানে। ঢাকা থেকে যাওয়াটাও বেশ সহজ। যেখানে আপনার অবস্থান হোক না কেন, চলে যাবেন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। অর্থ-কড়ি বেশি থাকলে রয়্যালের এসি বাসের টিকেট কেটে বসে পড়তে পারেন। ভাড়াও বেশি না ৩০০ থেকে সাড়ে তিন’শ টাকা। আড়াই তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন রসমালাই আর খাদি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত এ জেলাটিতে।
আর অর্থকড়ি কম থাকলে যেতে পারেন এশিয়া, তৃষা কিংবা অন্য অনেক গাড়ি আছে। এসব গাড়িতে ভাড়া পড়বে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। যা দেরি করবে, তা সায়েদাবাদেই। এরপর এই গাড়িগুলোও, কোথাও দাঁড়ায় না। সোজা চলে যাবে কুমিল্লায়। এছাড়া দেশের যে কোনো জেলা থেকে কুমিল্লা যেতে আপনি রেলপথ বা সড়কপথের যে কোনোটি বেছে নিতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনেও যেতে পারেন কুমিল্লায়।
এবার কুমিল্লায় গিয়ে উঠেছিলাম রেড রুফ ইন হোটেলে। আধুনিক সব সুবিধাসহ একটি ডাবল বেডের ভাড়া ১৫০০ টাকা। মজার ব্যাপার হলো, এটিই কুমিল্লার সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেল। এর মানে অন্য হোটেলগুলোতে ভাড়া অনেক কম পড়বে। এছাড়াও থাকতে পারেন হোটেল নূরজাহান (পদুয়ার বাজার), আশিক (নজরুল এভিনিউ), আল রফিক, নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে হোটেল সোনালী, হোটেল মেরাজ ও হোটেল আমানিয়াতেও।
কি কি দেখবো, এটাই ছিলো প্রথম প্রশ্ন। উত্তরটাও সহজ। ত্রিপুরার রাজারা এক সময় গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবে গোড়াপত্তন করেছিলেন গোমতীর তীরের এই কুমিল্লার। কুমিল্লার বুকজুড়ে রয়েছে আদি নিদর্শন।
• ওয়ার সিমেট্রি
• শালবন বিহার
• শালবন রুপবানমুড়া
• ইটাখোলামুড়া
• ময়নামতি ঢিবি
• রানীর বাংলো
• নীলাচল পাহাড়
• ময়নামতি জাদুঘর
• ফান টাওয়ার
• ওয়াটার পার্ক
• ধর্মসাগর
• কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
• পুরান এয়ারপোর্ট এলাকা
• লালমাটির লালমাই পাহাড় এবং
• গোমতী নদী।
একটু বেশি সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন:
• সচীনদেব বর্মণের বাড়ি
• অভয় আশ্রম
• নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি
• মুরাদনগরের জাহাপুর জমিদার বাড়ি
• জামবাড়ি
• নূরজাহান ইকো পার্ক
• রাজেশপুর ইকো পার্ক
• কেটিসিসি পর্যটন কেন্দ্র
• শাহ সুজা মসজিদ
• বায়তুল আজগর জামে মসজিদ
• নূর মানিকচর জামে মসজিদ
• ৭০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ
• চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন
প্রাচীন সভ্যতার নীরব সাক্ষী। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত প্রাচীন জেলা কুমিল্লা। প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত এ জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। আমরা একটা মাইক্রো ভাড়া করেছিলাম, ভাড়া পড়েছিলো ১৫০০ এর মতো। সেটাতেই ঘুরেছি সবগুলো স্পট। চলুন জেনে আসি প্রত্যেকটি স্পটের অল্প কিছু বর্ণনা।
ওয়ার সিমেট্রি: ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’ কুমিল্লাতে অবস্থিত একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান, জাপানী, আমেরিকান, ভারতীয় ও নিউজিল্যান্ডের ৭৩৭ সৈন্যের সমাধিস্থল এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মায়ানমার, আসাম এবং বাংলাদেশে ৯টি রণ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থানও বটে।
বাংলাদেশে দুটি কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র আছে, যার একটি কুমিল্লায় এবং অপরটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। কুমিল্লা ছিলো তখনকার একটি অত্যন্ত বৃহৎ হাসপাতাল ও সমর সরবরাহ কেন্দ্র এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাটি। তারপরও ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে ইস্ফলে স্থানান্তরিত হওয়া অবধি চতুর্দশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর। এখানকার ৭৩৬টি সমাধিতে সমাহিত প্রধানত হাসপাতালের মৃতরা। তবে যুদ্ধের পর বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র থেকে স্থানান্তরিত কিছু শবও এখানে রাখা হয়েছে। বাহিনীওয়ারী হিসেবে এতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন ৩ নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক ও ১৬৬ জন বৈমানিক। যুদ্ধকালীন সময়ের সমাধি ছাড়া এখানে আরো একটি কবর আছে। সারিবদ্ধভাবে সমাধিস্থল যেমন আপনাকে শ্রদ্ধাবনত করবে, তেমনি পরিপাটি, পরিচ্ছন্নতা মুগ্ধ করবে আপনাকে। ভালো লাগবে।
শালবন বিহার : আগে এই প্রত্নতত্ত্বটি শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খননের পর ১১৫ টি ভিক্ষু কক্ষ বিশিষ্ট একটি বৌদ্ধ বিহার নামে অভিহিত করা হয়। বিহারটির মধ্যভাগে একটি মন্দির ও উত্তর বাহুর মাঝামাঝি স্থানে প্রবেশ তোরণ দেখতে পাবেন। এটাই এর মূল আকর্ষণ। বিহারটিতে ৪টি ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে ৬টি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির মুদ্রক থেকে জানা যায়, এই বিহারটি দেব বংশের ৪র্থ রাজা শ্রীতবদেব খ্রিষ্টীয় আট শতকে নির্মাণ করেছেন। সুতরাং এর আসল নাম ছিল ভবদেব মহাবিহার। এই বিহারে খননে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ প্রত্নবস্তু ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
ইটখোলা মুড়া : শালবন বিহারের উত্তর-পশ্চিমে কালিবাজার সড়কের সংলগ্ন উত্তর কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত আরেকটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের নাম ইটাখোল মুড়া। বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প এর উত্তর পাশের টিলায় ইটাখোলা মুড়া অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি প্রাচীন প্রত্নস্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এগুলো একটি মন্দির ও অপরটি বিহার। আবিস্কৃত পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে চুনবালিজাত উপকরনে তৈরি একটি বড় আকারে লোকত্তোর বৃদ্ধ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে একটি বৌদ্ধ মূর্তি আছে। মূর্তিটির উর্ধাংশ জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রায় সর্বদাই দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত থাকে এ স্থানটি।
আনন্দ বিহার : ময়নামতি লালমাই পাহাড়ের অসংখ্য বৌদ্ধ স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে আনন্দ বিহারই সর্ববৃহৎ। অষ্টম শতকের দেব বংশীয় প্রভাবশালী রাজা আনন্দ দেব কর্তৃক এখানে শালবন বিহারের অনুরূপ একটি বিশাল বৌদ্ধ বিহার স্থাপিত হয়েছিল। এখানে আবিষ্কৃত সম্পদের মধ্যে মৃন্ময় দীপ, বৌদ্ধ দেব-দেবীর বিভিন্ন ব্রোঞ্জের মূর্তি, মদ্রালিপি সম্বলিত ফলক, মৃৎ পাত্র ও গুটিকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রূপবানমুড়া : ইটাখোলা মুড়ার দক্ষিনে কালিবাজার সড়কের অপর পার্শ্বে অবস্থিত অপর একটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের নাম রুপবান মুড়া। কোটবাড়িতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ একাডেমী ফর রোরাল ডেভেলপমেন্টর প্রধান ফটকের অদূরে এ স্থানটি অবস্থিত। এটি সমভূমি থেকে ১১.মি উঁচু টিলার উপর নির্মিত। তিনটি বসতি আমলের অস্তিত্ব রয়েছে এই শৈলীতে। ক্রুসাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত রূপবান মুড়াটি। পেছনের অংশটি মূর্তিকোঠা এবং সামনেরটি মণ্ডপ। মূর্তির চারদিকে আছে ঘোরানো পথ। প্রত্মমানের বিচারে মন্দির ও বিহারটি খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর নির্মিত যা আজও কালের সাক্ষী। খননকার্যের পর এখানে একটি বিহার, একটি মন্দির, একটি ক্ষুদ্র স্তূপ ও একটি উচ্চ মঞ্চের স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়। এখানকার কারুকাজ খচিত প্রাচীন মন্দিরটি সত্যিই দেখার মতো।
চন্ডিমুড়া মন্দির : কুমিল্লা শহরের ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে জেলার লাকসাম-বরুড়া-সদর এ তিন উপজেলার মিলনস্থল। পাশেই ছোট্ট পাহাড়। এর চুড়ায় ২ একর ৬৮ শতক জায়গাজুড়ে চণ্ডি ও শিব নামক দুটি মন্দির। চন্ডি মন্দিরের নামানুসারে এলাকাটি কালক্রমে চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিতি পায়। এর অদূরেই রয়েছে দুতিয়া দীঘি। মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় তিনটি উৎসব। এতে দেশ বিদেশের বহু ভক্ত-দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
কুটিলা মুড়া : এই স্থানটি শালবন বিহার থেকে উত্তরে তিন মাইল দূরে ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে অবস্থিত। খননের ফলে এখানে প্রাচীনকালের তিনটি স্তূপ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
চারপত্র মুড়া : এই স্থানটি কুটিলা মুড়া থেকে প্রায় ১.৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত। এই পাহাড়ের শীর্ষ দেশ সমতল, আকারে ছোট এবং আশপাশের ভূমি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু। ১৯৫৬ সালে সামরিক ঠিকাদারদের বুলডোজার ব্যবহারের ফলে একটি ছোট চতুষ্কোণ বৌদ্ধ মন্দির আবিষ্কৃত হয় এখানে। যা আয়তনে পূর্ব পশ্চিমে ১০০ ফুট দীর্ঘ ও উত্তর দক্ষিণে ৫৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট ছোট এই চতুষ্কোণ বৌদ্ধ মন্দির আবিষ্কৃত হয়।
রানীর বাংলো : জেলার বুড়িচং উপজেলার সাহেববাজারের কাছে আছে রাণী ময়নামতির প্রাসাদ স্থানীয়রা একে বলে রানীর বাংলো। রানীর বাংলো অবস্থিত কুমিল্লা-সিলেট সড়কের পাশে। এর দেয়ালটি উত্তর-দক্ষিণে ৫১০ ফুট লম্বা ও ৪শ’ ফুট চওড়া। সেখানে স্বর্ণ ও পিতলের দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে। এটি রীতিমতো ছোটখাটো একটি পাহাড়ের চূড়াতেই অবস্থিত অষ্টম শতকের স্থাপনা।
ময়নামতি জাদুঘর : কুমিল্লায় প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন গুলো সংরক্ষণের লক্ষ্যেই এখানে একটি জাদুঘর নির্মিত হয়। শালবন বিহারের পাশেই যাদুঘরটির অবস্থান। সময়ের ব্যবধানে এটি একটি সমৃদ্ধ প্রত্নত্বত্ত্ব জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। এই যাদুঘরে রয়েছে দর্শনীয় সব পুরাকীর্তি এবং বিভিন্ন রাজবংশীয় ইতিহাস, ব্যবহৃত তৈজসপত্র, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের ছোট ছোট বুদ্ধ মুর্তি, দেব-দেবির মূর্তি, পোড়া মাটির ফলকচিত্র, অলংকৃত ইট, পাথরের মূর্তি, মাটি ও তামার পাত্র, দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রী- দা, কাস্তে, খুন্তি, কুঠার, ঘটি, বাটি, বিছানাপত্র ইত্যাদি। যাদুঘরের পাশে বন বিভাগ নতুন ২টি পিকনিক স্পট করেছে। বাংলাদেশে বেশ কয়টি জাদুঘরের মধ্যে ময়নামতি উল্লেখযোগ্য। এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে শ্রী ভবদেব মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চাপত্র মুড়া, রূপবান মুড়া, ইটাখোলামুড়া আনন্দবিহার, রানীর বাংলো ও ভোজ রাঙার বাড়ি ইত্যাদি থেকে উদ্ধারকৃত মূল্যবান পুরাবস্ত। জাদুঘরটি আকারে নির্মিত এবং পাশে বিশ্রাগার আছে ও ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা সবুজে সবুজে।
বার্ড : কুমিল্লায় ঘুরতে আসবেন অর্থচ বার্ড দেখবেন না, এক বেলা খাবেন না বার্ডের সেল্ফ সার্ভিস ক্যাফেটেরিয়াতে, তা কি করে হয়। ছায়া সুনিবিড়ি মমতা ঘেরা রাস্তা। দুপাশে নানা রকমের নানা রংয়ের ফুল ও ফলের বাগান। পাখির কুজন আর ফুলের গন্ধে চারদিক ঘিরে রেখেছে বার্ডকে। এখানে ঘুরতে আসা অনেক পর্যটকই হয়তো প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনলে ভাবেন এখানে অনেক অনেক পাখি থাকবে, মনে করবেন পাখির কলকাকলীর জন্যেই হয়তো এর নামকরণ ‘বার্ড’।
নীলাচল পাহাড় : বার্ডের ভিতরে রয়েছে নীলাচল পাহাড়। নির্জন প্রকৃতির এক অকৃত্রিম ভাললাগার জায়গা হচ্ছে নীলাচল। একটু পাহাড়ী স্বাদ পাবেন ভ্রমণপিপাসুরা। ছোট ছোট গাছ আর একটু উচু পাহাড় আপনাকে মনে করিয়ে দেবে কত প্রাচুর্যে ভরা আমাদের প্রকৃতি।
লালমাই পাহাড় : লংকার রাজা রাবণ রামের স্ত্রী সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলে রাম তার ভাই লক্ষণকে নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালায়। এতে লক্ষণ আহত হলে কবিরাজ বিশল্যাকরণী গাছের পাতা হিমালয় পাহাড় থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে এনে দেয়ার কথা বলেন। হনুমান গাছটি চিনতে না পেরে পুরো পর্বত নিয়ে আসে এবং কাজ শেষে পাহাড়টি যথাস্থানে রাখতে যাওয়ার সময় অনেকটা আনমনা হয়ে যায়।
ময়নামতি পাহাড় : কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বুড়িচং এলাকায় ময়নামতি পাহাড় অবস্থিত। চতুষ্কোণ এ পাহাড়টির উপরিভাগ সমতল, উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। এখানকার আবিষ্কৃত স্থাপত্য নিদর্শনগুলো আনুমানিক ১২শ-১৩শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
ধর্ম সাগর : জনগণের সুপেয় পানীয় জলের সুবিধার জন্য ১৪৫৮ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ ধর্মামাণিক্য একটি দীঘি খনন করেন, যার নামকরণ করা হয় ধর্মসাগর। দীঘির একপাশে তাম্রলিপি পাঠ আছে ফলকে। বিশ্রামের জন্য রয়েছে বেদি যা অবকাশ নামে পরিচিত। দীঘিটির বাম পাস ঘেঁষে রয়েছে ড. আখতার হামিদ খানের বাংলো যা রানীকুঠির নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে যার অবদানে বাংলা আজ বাংলা নামে পরিচয় এমন কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ি, বিপ্লবী অতীন্দ্র মোহন সেনের বাড়ি এবং রয়েছে নজরুল ইসলামের কুমিল্লা জীবনের অনেক স্বাক্ষর।
গোমতী নদী : কুমিল্লাবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী গোমতী নদী। এটি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আপনি সন্ধ্যে বেলায় গোমতীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন নগরীর পাশে বানাশুয়া বা চান্দপুর ব্রিজে গিয়ে।
কাকড়ী নদী : খরস্রোতা এ নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদী থেকে সংগৃহীত বালি পাকা ইমারত নির্মাণের কাজে বেশ উপযোগী।
দীঘির জেলা কুমিল্লা : ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর হিসেবে পরিচিত এই কুমিল্লা। উপমহাদেশের প্রথম ব্যাংক স্থাপিত হয়েছিলো কুমিল্লার কান্দির পাড়ে। ওই ভবনটিতে বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের শাখা চালু আছে। আর ছোট-বড় অসংখ্য দীঘি রয়েছে এই শহরে। এজন্যেই একে জলাধার বা ট্যাংকের শহর হিসেবে পরিগণিত করা হতো। এর মধ্যে নানুয়ার দীঘি, উজির দীঘি, লাউয়ার দীঘি, রানীর দীঘি, আনন্দরাজার দীঘি, ভোজ রাজার দীঘি, কৃষ্ণসাগর, কাজির দীঘি, দুতিয়ার দীঘি, শিবের দীঘি ও জগন্নাথ দীঘির নাম উল্লেখযোগ্য।
বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন (টাউন হল) : ত্রিপুরা জেলার মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর’ ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন এর অনুরোধে বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির উপর এটি নির্মাণ করেন। ১৮৮৫ হালড় ৬ মে প্রতিষ্ঠিত ওই ভবনই কুমিল্লার গনপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত।
জাতীয় কবি কাজীর স্মৃতি বিজড়িত দৌলতপুর : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ও তার স্ত্রী নার্গিস এর স্মৃতি বিজড়িত স্থান কবি তীর্থ দৌলতপুর। ১৯২১ সালে (বাংলা ২৩ চৈত্র ১৩২৭) নজরুল ইসলাম কুমিল্লা হয়ে মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন এবং ৭১ দিন অবস্থান করেন। নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- বেদনা-অভিমান, অবেলা, অনাদৃতা, পথিক প্রিয়া, বিদায় বেলা প্রভৃতি। কবির পূর্ব পরিচিত আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে কুমিল্লায় কবির প্রথম আগমন ঘটে মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে।
জাতীয় কবি কাজীর স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা শহর : কবির দীপ্ত পদচারণা কুমিল্লাকে করেছে মহিমান্বিত। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত কবি ৫ বার কুমিল্লায় আসেন। এই ৫ বারে তিনি ১১ মাসের বেশি সময় কাটান কুমিল্লা শহরে। কবির বিয়ে থেকে শুরু করে দু’দফায় গ্রেফতার হন এ জেলায়। প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে কবিতা গানের আসর, ঝাউতলায় গ্রেফতার হওয়া, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দীঘির পাড়, দারোগা বাড়ি, ইউছুফ স্কুল রোড, মহেশাঙ্গন, কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও মাঠ, দক্ষিণ চর্থায় শচীন দেব বর্মনের বাড়ি, নবাব বাড়ি, ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ি, নজরুল এভিনিউ, কান্দিরপাড়, ঝাউতলা, রানীর দীঘির পাড়, রেলস্টেশন, কোতোয়ালি থানা, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বহু স্থানে কবির স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
ভাষা সৈনিক ধীরেন দত্তের বাড়ি : বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা/রাষ্ট্রভাষার প্রথম দাবিদার ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি কুমিল্লায়। নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবহুল বাড়িটি দেখে যেতে ভুলবেন না যেন। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই সর্বপ্রথম আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গণপরিষদে আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শচীনদেব বর্মণের বাড়ি : জাতীয় কবির গান শেখার সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত নগরীর বর্মণ হাউস। এ বর্মন হাউসেই একদিন জন্মেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মণ। বাড়িটি এখানো বিদ্যমান। দেখে যেতে ভুলবেন না যেন। ইতিমধ্যেই বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
অভয় আশ্রম : মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান কুমিল্লার অভয়াশ্রম। নগরীর প্রাণকেন্দ্র লাকসাম রোডে আড়াই একর জমির ওপর অভয় আশ্রমের অবস্থান। এখানে মহাত্মা গান্ধী ছাড়াও কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খান, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ বহু গুণীজনের আগমন ঘটেছিল। এ আশ্রমে থাকা দরিদ্র মানুষেরা খাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।
নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি : বেগম রোকেয়ার জন্মেরও দেড়’শ বছর আগে যিনি নারী শিক্ষায় জোর দিয়েছিলেন তার নাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা। লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে ডাকাতিয়া নদীর তীরে দেখে আসুন নারী জাগরণের পথিকৃত নবাব ফয়জুন্নেছার (১৮৩৪-১৯০৩) বাড়ি। তিনি ছিলেন হোমনাবাদের জমিদার, একজন লেখিকা হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। এখানে রয়েছে তার নির্মিত ঐতিহ্যবাহী দশ গম্বুজ মসজিদও।
মুরাদনগরের জাহাপুর জমিদার বাড়ি : কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুরে গোমতি বিধৌত জাহাপুরের জমিদাররা। মুখোমুখি অবস্থানে দুটি সিংহ আপনাকে এ বাড়িতে নিঃশব্দে স্বাগত জানাবে। তবে জীবন্ত নয় ইট পাথরের সিংহ। প্রধান ফটকে সবসময় দু’জন রক্ষী থাকত। জমিদারি আমলে এলে পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হতো।
জামবাড়ি : নগরীর প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে জামবাড়ির অবস্থান। জামবাড়ি এলাকা নাটক ও চলচ্চিত্রের শুটিং-এর জন্য নির্মাতাদের নিঃসন্দেহে পছন্দের স্থান। কয়েক বর্গমাইল বিস্তৃত এই এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় কয়েকটি উঁচু-নিচু ঢিবি।
নূরজাহান ইকো পার্ক : মহানগরীর ইপিজেডের পূর্বপার্শ্বে নেউরা এলাকায় ব্যক্তি উদ্যেগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ইকোপার্ক। ৬৪০ শতক জমিতে নির্মিত এ পার্কের নাম নূরজাহান ইকো পার্ক। সম্পূর্ণ গ্রামীণ আর বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের আদলে করা হয়েছে নূরজাহান ইকো পার্ক।
রাজেশপুর ইকো পার্ক : ৫৮৭ দশমিক ৮৯ একর এলাকা নিয়ে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার গড়ে তোলা হয়েছে রাজেশপুর ইকো পার্ক। পূর্ব জোড়কানন এলাকা থেকে সড়কপথে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন রাজেশপুর ইকো পার্কে যাওয়া যায়। এই ইকো পার্কে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছপালা, পশু-পাখি এবং কৃত্রিম বাঘ-বানর, ভাল্লুকসহ নানান প্রাণীর ভাস্কর্য। শীতকালে এ পিকনিক স্পটে অনেক পিকনিক পার্টির আগমন ঘটে।
কেটিসিসি পর্যটন কেন্দ্র : কুমিল্লা সদর উপজেলা পরিষদের পাশে অবস্থিত কেটিটিসির পর্যটন কেন্দ্র। এখানে শিশুদের জন্য রয়েছে চমতৎকার একটি পার্ক। বাগিচাগাঁওয়ে রয়েছে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম নেতা অতীন রায়ের বাড়ি।
শাহ সুজা মসজিদ : ৩৫২ বছর ধরে কুমিল্লায় জেলায় স্ব মহিমায় টিকে আছে একটি কারুকার্য খচিত ধর্মীয় স্থাপনা যার নাম শাহ সুজা মসজিদ। এ মসজিদের নামকরণ, প্রতিষ্ঠাতার নাম ও প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এ মসজিদ যে পাক ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন মসজিদ গুলোর মধ্যে অন্যতম সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। গোমতী নদীর কোল ঘেষে কুমিল্লা শহরের মোগলটুলীতে এ মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল।
বায়তুল আজগর জামে মসজিদ : দেবীদ্বারের ঐতিহ্য গুনাইঘর বায়তুল আজগর সাত গম্বুজ জামে মসজিদ এটি নির্মাণশৈলীর দিক থেকে দেশের বিখ্যাত মসজিদগুলোর অন্যতম মসজিদ হিসাবে দাবী করা হচ্ছে। গুনাইঘর বায়তুল আজগর সাত গম্বুজ জামে মসজিদটি কুমিল্লা জেলা সদর থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে উত্তর-পশ্চিম কোনে দেবীদ্বার পৌর এলাকায় এবং দেবীদ্বার সদর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণে গুনাইঘর গ্রামে অবস্থিত।
নূর মানিকচর জামে মসজিদ : দেবীদ্বারের সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ নূর মানিকচর মসজিদ, যার বয়স প্রায় পাঁচশত বছর। জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে মরহুম সৈয়দ নূর আহমেদ কাদেরী পীর সাহেব এ মসজিদ নির্মাণ করেন। সৈয়দ নূর আহমেদ কাদেরী পীর সাহেব’র নামানুসারে ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় নূর মানিকচর গ্রাম। এ মসজিদটি সাতগম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, প্রস্থ ০৫ ফুট।
৭০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ : বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা গ্রামে রয়েছে প্রাচীনতম একটি মসজিদ। প্রায় ৭শ’ বছরের পুরানো এ মসজিদ। তাই একে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ বলেও কেউ কেউ বলে থাকেন। মুসল্লিরা এখনও এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন।
চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন : কুমিল্লায় এসে একটু কৃত্রিম বিনোদনের ইচ্ছে জাগতেই পারে আপনার। তাহলে সোজা চলে যাবেন জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করেন সেখানে।
কুমিল্লা আসবেন আর চলে যাবেন খালি হাতে, এটা ভালো দেখায়না। চোখ বন্ধ করে কুমিল্লার কিনতে পারেন কুমিল্লার রসমালাই। যার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। কিনতে পারেন খাদি কাপড়ও। কেউ কেউ একে খদ্দরও বলে থাকেন।