জহির শান্ত:
ক্ষণে
ক্ষণে সমীকরণ বদলানো কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে
চতুর্মুখি লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। যদিও নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করছে ৬ জন প্রার্থী। তবে হাড্ডাহাড্ডি ভোটের লড়াই হবে চার প্রার্থীর
মধ্যে। এ চারজনের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ‘ভোট ব্যাংক’ এবং বিশাল কর্মী
বাহিনী। গ্রুপিংয়ের রাজনীতির জন্য বরাবরই আলোচনায় থাকা কুমিল্লার দুটি
আলাদা দলের চারটি গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এ চারজন। তারা হলেন- আওয়ামী
লীগ মনোনীত প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল
হক রিফাত, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মাসুদ পারভেজ খান
ইমরান, সদ্য বিদায়ী মেয়র ও বিএনপির বহিস্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু এবং অপর
বহিস্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। এছাড়াও কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাশেদুল ইসলাম এবং
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল। তবে
তাদেরকে হিসাবে রাখছেন না কেউ।
আগামী ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে
ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ১৭ মে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে ৬ জন মেয়র
প্রার্থীসহ মোট ১৬৪ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এরমধ্যে ১৯ মে যাচাই-বাছাইয়ে
৯ জন কাউন্সিলর এবং ১ জন সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মনোনয়ন
বাতিল ঘোষণা করা হয়। বাছাই শেষে কুসিক নির্বাচনে তিন পদে বৈধ প্রার্থীর
সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৪ জনে।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এ
পর্যন্ত দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি নির্বাচনেই মেয়র পদে জয়লাভ
করেন মনিরুল হক সাক্কু। প্রথমবারের নির্বাচনে (২০১২ সালে) সাক্কু পরাজিত
করেন কুমিল্লার বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আফজল খানকে। দ্বিতীয়
নির্বাচনে (২০১৭ সালে) সাক্কুর কাছে ভোটের লড়াইয়ে হারেন আওয়ামী লীগ
প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা। সীমা প্রয়াত আফজল খানের কন্যা। প্রথম দু’টি
নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পায় আফজল পরিবার। অভিযোগ রয়েছে, দলীয়
গ্রুপিংয়ের কারণে দুইবারই পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে তাদেরকে।
কুসিকের
মেয়র পদটি পেতে মরিয়া আওয়ামী লীগ এবার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে আফজল
খান গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আ ক ম
বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী আরফানুল হক রিফাতকে। রিফাত মহানগর আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক। কুমিল্লার রাজনীতিতে আফজল-বাহার গ্রুপের দ্বন্দ্ব
চলে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকেই। এক গ্রুপের মনোনয়নে বেঁকে বসে আরেক গ্রুপ।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে
আছেন আফজল খানের পুত্র এবং ওই গ্রুপের শীর্ষ নেতা মাসুদ পারভেজ খান ইমরান।
তার মনোনয়নে পাল্টে গেছে আওয়ামী লীগের ভোটের হিসাব।
কুমিল্লার রাজনীতিতে
আফজল খান গ্রুপের নিজস্ব ‘ভোটব্যাংক’ রয়েছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে এমপি বাহারের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে ২০ হাজার ৭৩২ ভোটের ব্যবধানে
হেরেছিলেন ইমরান। এমপি বাহার পেয়েছিলেন ৫৯ হাজার ২৫ ভোট ও মাসুদ পারভেজ
ইমরান পেয়েছিলেন ৩৮ হাজার ২৯৩ ভোট। সেই নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেয়নি।
কিন্তু ইমরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জয় পেতে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়েছিলো
সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে। এবারের সিটি নির্বাচনেও
ইমরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয় পেতে বেশ ঘাম
ঝরাতে হবে বলে মনে করছেন কুমিল্লার নাগরিকরা। আর সেই সুযোগটা নিয়ে নিতে
পারেন সদ্য বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। এর আগের দুই নির্বাচনেও আওয়ামী
লীগের গ্রুপিংয়ের সুযোগটা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন সাক্কু।
যদিও
এবার সাক্কুর জন্য পথটা ততো মসৃণ নয়। কারণ নির্বাচনের মাঠে এবার প্রার্থী
হয়েছেন বিএনপির অপর গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার।
কুমিল্লার বিএনপির রাজনীতি স্পষ্টতই দুই গ্রুপে বিভক্ত। মনিরুল হক সাক্কু
গ্রুপ এবং হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন গ্রুপ। কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক
দলের সভাপতির পদ থেকে বহিস্কার হওয়া নিজাম উদ্দিন কায়সার হাজী ইয়াছিনের
শ্যালক এবং এই গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কায়সার নির্বাচন করার ঘোষণা
দেওয়ার পর থেকেই বলা হচ্ছে- গুঞ্জন রয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ইশারায়
সাক্কুকে ঠেকাতেই এবার মাঠে নেমেছেন তিনি। বিষয় যাই হোক- হাজী ইয়াছিন
গ্রুপের সব ভোট কায়সারের বক্সেই যাবেÑ এ কথাও স্বীকার করে নিচ্ছেন সবাই।
ভোটের হিসেবে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই কায়সার।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে,
বিএনপি থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কৃত মনিরুল হক সাক্কু যেসব সমীকরণে মেয়র পদে
বিজয়ী হতেন এবার সেসব সমীকরণ আর ধোপে টিকবে না। কারণ আওয়ামী লীগের যে
অংশের সহযোগিতা তিনি গ্রহণ করেন বলে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান- সে অংশেই এবার
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। তাছাড়া যে বিএনপির সমর্থনের কথা
তিনি বলেন, সে বিএনপির মূল অংশ এবার নিজেরাই প্রার্থী দিয়েছে। সেই সাথে
সাক্কুর জন্য বড় বিপর্যয় হচ্ছে, তার সাথে থেকে যেসব বিএনপি, যুবদল,
স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা কাজ করে বিজয় নিশ্চিত করতেন তাদের বেশিরভাগই অনেক
আগে থেকে সাক্কুর সাথে নেই। সাক্কুকে ঠেকাতেই তাদের তৎপরতা বেশি। আর
বিএনপি থেকে বহিস্কার হওয়ার পর সেই সব নেতাদের পাশে পাওয়ার সে সুযোগও আর
থাকছে না। কেননা এবারের বহিস্কারাদেশ আজীবনের জন্য। ফলে সাক্কুকে এবার
সুকঠিন পরীক্ষা দিতে হবে নির্বাচনে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুসিক
নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে বেশ আঁটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছেন প্রধান চার
প্রার্থী। এর মধ্যে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত
প্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। নগরীর
২৭টি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি থাকায় নির্বাচনী
ওয়ার্ক অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে তার জন্য। এছাড়া এমপি বাহারের বিশাল কর্মী
বাহিনী এবং বড় অংকের ‘রিজার্ভ’ ভোটও পাবেন তিনি।
ভোটের হিসেবে পিছিয়ে
নেই ইমরান খানও। তার নিজের বিশাল কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী রাজনীতিতে
‘এন্টি বাহার’ ইজমও কাজে লাগাতে পারবেন তিনি। এছাড়া নতুন এবং তরুণ ভোটারদের
নিজের দিকে টানতেও নানা কৌশল ব্যবহার করছেন ইমরান।
সদ্য বিদায়ী মেয়র
মনিরুল হক সাক্কু কাজ করে চলেছেন নিজস্ব স্টাইলে। কুসিকের মেয়র হিসেবে শেষ
কর্মদিবসের পর থেকেই নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। সেখান থেকেই নানাভাবে
যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে। বিশ্বস্থ সূত্রে প্রাপ্ত খবর,
শুরুতে প্রতিটি ওয়ার্ডের মুরব্বী শ্রেণির লোকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে
চলেছেন সাক্কু। এছাড়াও পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে এক যুগের অধিক সময়
মেয়র থাকার ফলে মাস্টার রোলে দেওয়া অনেকের চাকুরির সুবাদে এ নগরে গড়ে ওঠেছে
তার নিজস্ব ‘ভোট ব্যাংক’। একটি এনজিও এর মাধ্যমে নারীদের কাজে লাগানোর
চেষ্টা করছেন তিনি।
বিএনপি থেকে বহিস্কার-পরবর্তী ভোট-পরিকল্পনার বিষয়ে
জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, বহিরস্কারাদেশ আমার নির্বাচনে কোনো
প্রভাব ফেলবে না। আমি দীর্ঘদিন এই নগরীর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি,
মানুষ আমাকে ভালোবাসে। মানুষের টানেই আমি নির্বাচনে এসেছি। এই নগরীর
বাসিন্দারাই আমাকে বিজয়ী করবে। দল আমাকে বহিস্কার করার আগেই আমি দলীয় পদ
থেকে পদত্যাগ করেছি।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত
বলেন, কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী। জয়ের
ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদটি আমি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চাই। কোনো ষড়যন্ত্রই আওয়ামী
লীগের বিজয় ঠেকাতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাসুদ
পারভেজ খান ইমরান বলেন, আমার বিশাল এক কর্মী বাহিনী রয়েছে। আমার জয়ের জন্য
তারাই মাঠে কাজ করছে। এই শহরের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আমাকে সমর্থন
দিয়েছেন। এর কারন মানুষ দুজনের সমন্বয়ে গড়া লুটেরা বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি
চায়। এছাড়া তরুণ এবং নতুন ভোটাররাও আমার সাথে আছে। তাদের চাপে আমি
নির্বাচনের মাঠে নেমেছি; তারাই আমাকে বিজয়ী করে আনবে।
নিজাম উদ্দিন
কায়সার বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও দলের নেতা-কর্মীরা পরোক্ষভাবে আমার
সাথে আছেন। ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষেরাও আমার সাথে আছেন। আমাকে
কুমিল্লা শহরের নাগরিকরা প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি
কুমিল্লার সকল শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের কণ্ঠস্বর হিসেবে আমাকেই বেছে নিবে।
কুমিল্লা
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন,
কুমিল্লায় নির্বাচনী পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ আছে। সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে
মনোনয়নপত্র জমা ও যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো বিশৃঙ্খলার
খবর পাওয়া যায়নি। আশা রাখি শান্তিপূর্ণভাবেই কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে
ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ভোটগ্রহণে আমরা বদ্ধ
পরিকর।