ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
কোথাও নেই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অবণী মোহন দত্ত!
এমনকি তার জন্মভূমি দেবীদ্বারেও
Published : Wednesday, 15 December, 2021 at 12:00 AM, Update: 15.12.2021 1:01:11 AM

কোথাও নেই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অবণী মোহন দত্ত!এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানাদের মধ্যে অসংখ্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম পরিচয় আগামী প্রজন্মের কাছে অজানা অসচ্ছ রয়েগেছে। তাদেরই একজন দেবীদ্বারের অধ্যাপক অবণী মোহন দত্ত।
মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎন্বর্গকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র খন্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্তের নামে নেই কোনো স্মৃতিস্মারক। শিক্ষার্থীদেরও অনেকে জানে না তাদের এই শিক্ষকের আত্মত্যাগের গল্প। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে একটি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ থাকলেও সেটিও পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়।
২০২১ সালের ২৭ মে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট অধিশাখায় প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে ১৯১ শহীদ বুদ্ধিজিবীর তালিকা প্রকাশ হয়েছে, সে তালিকারই একজন ‘অবনী মোহন দত্ত’। ওই তালিকার ৩ নম্বরে শহীদ বুদ্ধিজিবী অধ্যাপক অবণী মোহন দত্তের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে।
তাকে তার জন্মভূমি কুমিল্লার দেবীদ্বারের মানুষজন চেনেন এমন সংখ্যাও খুব একটা নেই। এমনকি তার পৈত্রিক ভিটে অবস্থানরত বংশধরদের সাথে আলাপ করেও অবণী মোহন দত্ত সম্পর্কে খুব একটা জানার সুযোগ হয়নি। অবণী মোহন দত্তের ছোট ভাই দেবীদ্বার রেয়াজ উদ্দিন মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিক্ষক রবীন্দ্র চন্দ্র দত্তের পুত্র অধ্যাপক বিশ^জিত দত্ত জানান, আমাদের জন্মের পূর্বেই কাকা বাড়ি ছেড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ার পর তার পরিবারের একজন অর্থাৎ ছোট ছেলে এডভোকেট পরিতোষ কুমার দত্ত ছাড়া বাকী সবাই ভারতে চলে গেছেন। পরিতোষ কুমার দত্ত রাঙ্গামাটি কোর্টে আইন ব্যবসা করেন। তাই এলাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অনেকের কাছেই তিনি অপরিচিত।
বিশ^জিত দত্ত আরো জানান, কাকা অবণী মোহন দত্ত নোয়াখালীতে বিয়ে করেন। ওনার  স্ত্রীর নাম ছিল মনিমালা দত্ত। তাদের চার ছেলে এক মেয়ে রয়েছেন। প্রথম ছেলে কুমার দত্ত, তিনি ভারতের আইএস অফিসার। দ্বিতীয় ছেলে প্রদীপ কুমার দত্ত, এমএ-এলএলবি পাস করে তিনিও বসবাস করছেন ভারতে। তৃতীয় ছেলে এডভোকেট পরিতোষ কুমার দত্ত এমএ-এলএলবি পাস করে রাঙামাটি কোর্টে সরকারপক্ষের আইনজীবী (জিপি) হিসেবে কর্মরত আছেন। চতুর্থ ছেলে স্বাধীন কুমার দত্ত গ্রাজুয়েশন শেষ করে বসবাস করছেন ভারতে। একমাত্র মেয়ে মঞ্জুহাসি দত্ত ছিলেন সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যাপক, তার স্বামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ চট্রগ্রাম জেলার সভাপতি ড. সৌরেন বিশ্বাস।
অধ্যাপক অবণী মোহন দত্ত কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম অশি^নী কুমার দত্ত, তিনি ছিলেন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। তার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে ছিলেন। তারা হলেন,- মনমোহন দত্ত, অবণী মোহন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ দত্ত, উষা রানী নন্দী, মায়া রানী পাল, কানন বালা দে। ৬ ভাই বোনের মধ্যে অবণী মোহন দত্ত ছিলেন তৃতীয়।
অধ্যাপক অবণী মোহন দত্ত ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিনে ১৯৩২ সালে দেবীদ্বার রেয়াজ উদ্দিন মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। তিনি ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও একই কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে দর্শন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বদলি হয়ে দর্শন বিভাগে যোগদান করেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগ খোলা হলে তিনি সেখানে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও পাঠদান করাতেন।
বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অবনী মোহন দত্তের তৃতীয় সন্তান এডভোকেট পরিতোষ কুমার দত্ত বলেন, ‘কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল না বাবার। ক্লাস, বই ও লাইব্রেরি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। চিন্তা-চেতনায়  ছিলেন প্রগতিশীল। বিশ্বাস করতেন দেশের স্বাধীনতায়। হয়তো এ কারণেই পাকিস্তানি হায়েনাদের টার্গেট হয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য ছিল বিশাল এক বজ্রাঘাত।’
চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ সাহাবউদ্দিনের প্রকাশিত ’মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ে অবণী মোহন দত্তকে হত্যার আগ মুহূর্তের বর্ণনা রয়েছে, যা থেকে ৮ মে ভরদুপুরে ভাতঘুমে আচ্ছন্ন মানুষটিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জানা যায়।
অবণী মোহন দত্ত দর্শন বিষয়ে দু’টি বই লিখেছিলেন। তার অনেক ছাত্র এখন অধ্যাপনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের অনেকেই দেশের সীমা ছাড়িয়ে জ্ঞান বিতরণ করছেন বিদেশে। তারপরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহেলিত এক নাম অবণী মোহন দত্ত।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টি "দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িক একটি শক্তির দখলে ছিল তাই মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের স্মরণে করা যায়নি অনেক কিছু। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ ও 'বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ'। এখন মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণেরও পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে সরকার, সেখানে শহীদ অবণী মোহন দত্তের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা জরুরী, কারন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন।
জানা যায়, অবণী মোহন দত্তের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়ের মাঝে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিন পরই রাতের আঁধারে উপড়ে ফেলা হয় সে নামফলক। নতুন প্রজন্ম এটিকে কাটা পাহাড়ের রাস্তা নামেই চেনে। এখন চট্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রাম কলেজের কোথাও নেই তার কোনো স্মৃতিস্মারক। এমনকি বুদ্ধিজীবী চত্বরেও নেই তার পরিচিতিমূলক কোনো বর্ণনা। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে না অবণী মোহনের পরিবার। আমরা থাকছি অন্তরালে নীরবে-নিভৃতে।
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক অবনী মোহন দত্ত ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তাঁর শিক্ষাদানের মধ্যে ছিল অনাবিল আনন্দ ও নিরঙ্কুশ আন্তরিকতা। শিক্ষার্থীরা ছিলেন তাঁর সন্তানতুল্য। প্রতিদিন তিনি সর্বধর্মের, সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য প্রার্থনা ও মঙ্গল কামনা করতেন। অধ্যাপনায় ছিলেন সফল। ইংরেজি জানতেন, বলতেন ও লিখতেন নির্ভুল ও অসাধারণ!
এ জন্য ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকেরাও তাঁর কাছে পাঠদানে সাহায্যের জন্য আসতেন। তিনি হাসিমুখে ও আনন্দচিত্তে তাঁদের সাহায্য করতেন।
মৃত্যু সম্পর্কে তিনি একটা কথা বলতেন: হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ দাহ করারই কথা, কিন্তু তা না করে কোনো ফলদায়ী বৃক্ষের গোড়ায় সমাহিত হলে সেই বৃক্ষ আরও কিছু দিন বাঁচার উপাদান পাবে, তাতে তাঁর জীবনের সামান্য হলেও কিছু মূল্য থাকবে।
অজাতশত্রু এই শিক্ষককে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সেনা একাত্তরের ৮ মে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁকে কবে, কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রভূত সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু দেশ রয়েছে মহাবিপদের মধ্যে। এ অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচানো অবনী মোহন দত্ত জরুরি মনে করেননি।