
সৌরভ মাহমুদ হারুন, বুড়িচং ||
মাদ্রাসার
এক শিক্ষার্থীর চানাচুর অন্য শিক্ষার্থীরা চুরি করে খেয়েছেÑ এই অপরাধে
মাদ্রাসার সভাপতি ও শিক্ষকরা মিলে ৫০-৬০ জন শিশুশিক্ষার্থীকে আধাঘণ্টা ধরে
‘হেড-ডাউন’ করে রাখার শাস্তি দেন। এতে ২০-২৫ জন কোমলমতী শিক্ষার্থীর
নাকে-মুখে রক্ত এসে, বমি হয়ে ও মাথায় রক্ত চড়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তাদের শোর-চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাদের সেবা-শুশ্রূষার পর ক্ষোভে
মারমুখী হয়ে মাদ্রাসাটি ঘেরাও করে ফেলে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের
উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় এবং অভিযুক্ত মাদ্রাসা সভাপতি ও ২ শিক্ষকসহ ৪
জনকে আটক করে।
ঘটনাটি ঘটে গত সোমবার সন্ধ্যায় কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার
শংকুচাইল আশ্রাফুল উলুম হাফেজিয়া নুরানীয়া ফুরকানিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায়।
রাতে বুড়িচং থানার ওসি মো. মোজাম্মেল হক পিপিএম সঙ্গীয় ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে
গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্স ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। পরে এক শিক্ষার্থীর
বাবা বাদি হয়ে বুড়িচং থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার বিবরণ ও পুলিশ
সূত্রে জানা যায়, বুড়িচংয়ের ওই মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষার্থী
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বাগড়া গ্রামের জহিরুল ইসলামের ছেলে মো. আল-আমিন (১০)
কয়েক দিন ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে তার মায়ের সঙ্গে সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টায়
মাদ্রাসায় আসে। মা বিদায় নেয়ার সময় ছেলেকে একটি চানাচুরের প্যাকেট কিনে
দেন। আল-আমিন তার মাকে রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে এসে দেখতে পায়, মায়ের দেওয়া
চানাচুরের প্যাকেটটি নেই। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মাকে ফোন করে জানালে মা ফিরে
আসেন এবং মাদ্রাসার সভাপতি ও শিক্ষকদেও বিষয়টি জানান।
পরে সন্ধ্যা সাড়ে
৬টার সময় মাদ্রাসার সভাপতি ও শিক্ষকরা এসে চানাচুর চুরির অপরাধে ৫০-৬০ জন
কোমলমতী শিক্ষার্থীকে হেড-ডাউন করে (পায়ের ফাঁকে মাথা নিচু করে, শরীর উপরে
তুলে রাখা) আধাঘণ্টা শাস্তি দেন। এভাবে শিশুশিক্ষার্থীদের এতটা সময় ধরে
মাথা নিচু হয়ে থাকায় ২০-২৫ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থীর মুখ
দিয়ে রক্ত আসে; অনেকের বমি হয়; কারো মাথায় রক্ত চড়ে যায় আবার কারো
আশঙ্কাজনকভাবে ঝিমুনি আসে। অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুশিক্ষার্থীদের
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে স্থানীয়রা মাদ্রাসার সামনে এসে উত্তেজিত হয়ে মারমুখী
অবস্থান নেয়।
খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. গোলাম মোস্তফা
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে বুড়িচং থানা-পুলিশকে খবর দেন। এসময় বুড়িচং
থানার ওসি মো. মোজাম্মেল হোসেন পিপিএমের নেতৃত্বে সঙ্গীয় ফোর্স ঘটনাস্থলে
পৌঁছে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠান।
এ ঘটনায়
অসুস্থ এক শিশু শিক্ষার্থীর বাবা ফিরোজ মিয়া বাদী হয়ে ৪ জনকে আসামী করে
সোমবার রাতে বুড়িচং থানায় মামলা দায়ের করে। ওই রাতেই পুলিশ মাদ্রাসা
পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ২ শিক্ষকসহ ৪ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। গতকাল
মঙ্গলবার সকালে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। আসামীরা হলেনÑ
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. বাদশা মিয়া (৭০), শিক্ষক মো. মোতালেব
(৩৫), শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান (৩৫) ও হাফেজ মো. সফিকুল ইসলাম।
গুরুতর
অসুস্থ শিক্ষার্থীদেও কয়েকজন হলোÑ ইসমাইল হোসেন বাঁধন (১০), এনায়েত (১০),
হিফজুল করিম (৮), মো. আশ্রাফুল (১০), সাকিব (১২), মো. আশিকুর রহমান (১১),
রুহুল আমিন (৯), জুনায়েদ (১০), সাইফুল ইসলাম (৯), মো. সিফাত (৯) ও মো.
ছাব্বির (১০)।
বুড়িচং থানার ওসি গত রাতে কুমিলার কাগজকে বলেন, ‘আমরা
জেনেছি, ঘরের দেয়াল বা কোনো কিছুর সাপোর্ট নিয়ে মাথা নিচু করে শরীর উপরে
তুলে শিশুদেরকে প্রায় আধাঘণ্টা শাস্তি দেয়া হয়েছে, যা আমাদের বাহিনীর ভাষায়
‘হেডডাউন’ বলা হয়। এমন পরিস্থিতিতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও ৫ মিনিটের
বেশি থাকতে পারে না। আর সেখানে এসব শিশুছাত্রকে এতোণ ধরে শাস্তি দেয়ার
বিষয়টি অমানবিক। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে আমরা গিয়ে তাদের
উদ্ধার করি। এ ঘটনায় ফিরোজ হোসেন নামে একজন অভিভাবক মামলা দায়ের করেছেন।
আমরা চারজনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি।