
রেজাউল করিম শামীম ||
কুমিল্লার বুক চিড়ে বহে যাওয়া ঐতিহ্যে ধারক গোমতী,অবশেষে আক্ষরিক অর্থেই তার আন্তর্জাতিক নদীর মর্জাদা লাভ করলো।বাংলাদেশ-ভারত নৌপথ বাণিজ্যের নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো।খুলে গেলো গোমতীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে কুমিল্লা-ত্রিপুরার ব্যবস্যা-বানিজ্যের নতুন দ্বার।আর তারই আনন্দের হিল্লোল বহিয়ে দিয়ে দু‘দেশের পতাকাবাহী একটি নৌযান কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ত্রিপুরার সোনামুড়ায় নৌবন্দরে পৌঁছে দেয় বাণিজ্যিক পণ্য।দিনটি ছিলো ৫সেপ্টেম্বর।
এপথে নৌ-চলাচল করবে তেমনি প্রচার ছিলো অনেক আগে থেকেই । বিশেষ করে ত্রিপুরার অংশে। সেখানকার সীমান্ত ঘেষে সোনামুড়ার স্থলবন্দরটিকে ইমিগ্রেশন,কাষ্টমস,গোডাউন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত নতুন ভবন তেরী করা হয়েছিলো অনেক আগেই।আর সেসময়ই ঐ ভবনের নিচে ব্যজম্যন্ট ঘিরে গোমতীতে নৌবন্দর নির্মানের কাজও চলছিলো।তবে আমাদের এখানকার মানুষের মনে ছিলো নানা কারনেই অনিশ্চয়তা । বিশেষ করে যেই গোমতীকে ঘিরে ঐপাড়ের মানুষদের এত আশা-প্রস্তুতি,সেই গোমতীর বর্তমান শীর্ণকায় অবস্থা আর নাব্যতা সংকটের কারনে এই পথে বানিজ্যিক নৌচলাচলের বিষয়টিকে অবিশ্বাস্য করে তুলেছিলো।তাছাড়া গোমতীর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ব্রিজ,সেতুর মতো প্রতিবন্ধকতাও এই অনিশ্চয়তাকে আরো প্রকট করে তুলে। তারপরও এমনি আশা-নিরাশার দোলাচালের মধ্যেইে এই পথে নৌ চলাচল ও বানিজ্যের জন্যে দু‘দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মে মাসে।
আর তারই পথ ধরে নানা প্রতিবন্ধকতা মধ্যও নতুন আশার আলো দেখালো।সেদিন দু‘দেশের মধ্যে নৌ-পথ বানিজ্যের উদ্ধোধন হলো।বহুকাঙ্খিত গোমতীর বুক চিড়ে সেদিন একটি মটরচালিত যান(স্থানীয় ভাষায় ট্রলার)ভর্ত্তি সিমেন্ট নিয়ে কুমিল্লার বিবির বাজার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরার সোনামুড়ার শ্রীমন্তপুর বন্দরে গিয়ে পৌঁছে। এ উপলক্ষে দু‘পাড়ে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো।
কুমিল্লার বিবির বাজার চেকপোষ্ট এলাকার অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাই কমিশনার বিভা গাঙ্গুলি দাস অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।সেখানে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যন কমোডর গোলাম সাদেক বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে গোমতী দিয়ে দু‘দেশের মধ্যে বাণিজ্যের সূচনা করেন। অনুষ্ঠানে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর,এএসপি আজিজুল আহসান, তানভীর সালেহীন সুমন, শফিকুল ইসলাম প্রমুখ কর্মকর্তাগন উপস্থিত ছিলেন।ভারতীয় হাই কমিশনার বিবির বাজার যাওয়ার পথে এখানে থামেন এবং এসময় তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
অপর দিকে সোনামুড়াতেও অনুরূপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।তাছাড়া

সেখানকার পরিবহন মন্ত্রী প্রসন্জিত সিংহ রায়,সাংসদ প্রতীমা ভৌমিক,বিধায়ক সুভাস চন্দ্র দাস ও অরুন চন্দ্র ছাড়াও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার বিভা গাঙ্গুলি দাস এবং ত্রিপুরার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনের উপ কমিশনার কিরীট চাকমা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব,সেদিন খুবই উৎফুল্ল ছিলেন বলে সেখানকার স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।তিনি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া ছাড়াও সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি এই নৌ যোগাযোগকে তাঁর সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে দাবি করেনে। তিনি এর মাধ্যমে ত্রিপুরাবাসীর অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হলো বলে উল্লেখ করে বলেন, যোগাযোগের এই নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার ফলে তাঁদের রাজ্য, ত্রিপুরাসহ তাদের প্রতিবেশি অন্যান্য রাজ্যের সাথে কানেকটিভিটি ও ব্যবস্যা-বানিজ্য বৃদ্ধি পাবে,সময় ও ব্যয় শাস্রয়ী হবে।ফলে স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন পণ্য সেখানে সহজলভ্যও হবে।এতে জনগন উপকৃত হবে।মূখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভূয়শী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার মধ্যে একটি মাধুর্য ও মাতৃত্ববোধ রয়েছে। যার ছায়া ত্রিপুরাতেও পরেছে।তিনি ব্যক্তিগত ভাবে শেখ হাসিনাকে খুব পছন্দ করেন বরে জানান এবং এজন্যে তাঁর নিজের,ত্রিপুরা এবং ভারতের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
সোনামুড়ায় অনুষ্ঠান-আয়োজনের ঘনঘটা বেশ উৎসবের আবহাওয়া এনে দেয়।যেমনি সাজস্জ্বায়, তেমনি লোক সমাগম সব দিক থেকেই ছিলো রমরমা অবস্থা।সবার চোখেমুখেই ছিলো যেন আনন্দ আর আশার আলো।তবে সেখানকার স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই আশাহত হয়েই ফিরে যান।কারন, অনেক আগে থেকেই সেখানে প্রচারপ্রচারনা ছিলো গোমতী দিয়ে বড় জাহাজ আসছে।মালামাল বোঝাই হয়ে আসছে জাহাজেএ যেন তাদের জন্যে মহাপ্রাপ্তি।সেই সব কাহিনী আর গল্পতো তারা, তাদের বাপদাদাদের কাছ থেকে শুনে শুনে বড় হয়েছে।শুনেছে এই গোমতী দিয়ে এক সময জাহাজ চলতো।বড় বড় বজরা ,পালতোলা নৌকা মালামাল বোঝাই করে আসতো দূর দূরান্ত থেকে। এমনকি এক সময় যাত্রী সাধারনের চলাচলের একমাত্র পথও ছিলো এই নৌ পথ। মালামালের সহজ আনানেয়ার সুযোগের কারনে পন্যের দামও ছিলো খুবই কম।তাছাড়া এই নদি পথে যুদ্ধবিগ্রহের কথাও শুনেছে তারা। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই নৌপথ হারিয়ে গিয়েছিলো।বহু বছর পর যখন আবার এই পথে জাহাজ আসছে-এই খবরে প্রচার হলো,তখন সেখানকার মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে পারেনি।তাছাড়া,সেখানকার সোনামুড়া টাউন হলে শাসক দল বিজেপির একটি সমাবেশও ছিলো প্রায় এই সময়ে । কথা ছিলো মূখ্যমন্ত্রী,নৌ চলাচল অনুষ্ঠান মেষে এই সভায় এসে যোগ দেবেন।সেইদিন লোক সমাবেশ বেশি হওয়া, এটিও ছিলো একটি কারন।
কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীকে নবগঠিত ভাষমান নৌ জেটির অনুষ্ঠান স্থলে আসতে হয়েছিলো দু‘বার।প্রথমবার সেখানকার স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় নির্ধারিত সময়ই তিনি সেখানে অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে পৌঁছান। কিন্তু, কাঙ্খিত ‘জাহাজ‘ বাংলাদেশ সীমানা পার হলো ঠিকই। কিন্ত্র নৌজেটির প্রায় তিনশ মিটার কাছাকাছি এসে আটকে যায়। বলা হয় নদির নাব্যতা সংকট, সেই সাথে ডুবচর আর গাছের গুড়িতে সেটি আটকে যায়।সেই প্রতিবন্ধকতা সাড়িয়ে মালামাল নিয়ে নৌজানটি আসতে সময় লাগবে।ফলে মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল ত্যগ করেন।তিনি যোগদেন জনসমাবেশে।আর সেই ফাঁকে সেখানকার স্থানীয় জনগন, রেডক্রশের স্বেচ্ছাসেবক আর লেবার দিয়ে মোটা রশি বেঁধে টেনে টেনে নৌযানটিকে ভাষমান জেটির কাছে নিয়ে আসা হয়।বেলা তখন তিনটা মূখ্যমন্ত্রী পুনরায় অনুষ্ঠানস্থলে ফিরে আসেন এবং যতারিতি অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে নৌ-যানটি দেখা গেলো।এরপর অনেকেই নাকি তাতে হতাশা প্রকাশ করেন।বলেন, এটা জাহাজ কোথায়? এটাতো মটর চালিত কার্গো নৌকা। এটাই যদি জাহাজ হয় তবে সেখানকার লোকজন অনেক আগেই এমনি নৌযানে চড়েছে। মেলাঘরের রুদ্রজলার বিল পাড় হয়ে নীড়মহল যাতায়তের সময়।তাছাড়া, নৌযানটি তীরে ভিড়ার পর আরো একটি ন্যক্কারজনক ব্যত্যয় সেখানকার লোকজনের চোখে বিদ্রুপ হয়ে দেখা দেয়।আর তা হলো,নৌযানের মাস্তুলে বাংলাদেশ ও ভারতের যে বড় দু‘টি পতাকা উড়ছিলো-সেখানে ভারতের পতাকাটি উল্টো করে টানানো ছিলো।অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে গোমতীর উৎপত্তি স্থল ডুম্বুরের বিদ্যুত কেন্দ্রের বাঁধসহ বেজিমারার স্ল্যুইস গেইট খুলে দেয়া হয়। যার জন্যে গোমতীতে হঠাৎ করেই পানি বেড়ে নাব্যতা বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। তবে এ সবকেই সেখানকার বিরোধীদের বোধগম্য কারনেই বিদ্রুপ বলেই মন্তব্য করা হয়েছে।
তবে,সেদিন সষ্পূর্ন ‘ট্রায়াল রান“ বা পরীক্ষামূলক ভাবে নৌ পথ চালুর মধ্য দিয়ে দু‘দেশের বিশেষ করে কুমিল্লা-ত্রিপুরাসহ সেখানকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলিয় অন্যান্য রাজ্যগুলোর সাথে পণ্য আমদানি-রপ্তানির যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে তাতে কারো কোনই সন্দেহ নেই।এখন উভয় দেশের লক্ষ হওয়া উচিৎ, এই পরীক্ষা মূলক নৌচালানের মধ্য দিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতা সামনে উঠে এসেছে সেগুলো সমাধানে সচেষ্ট হওয়া।তার মধ্যে প্রথমেই আসছে নদির নাব্যতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের মধ্য থেকে ইতিমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে যে, নদিটি ড্রেজিং করে নাব্যতা বৃদ্ধির জন্যে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।কিন্তু বিষয়টি খুবেই ব্যয় সাপেক্ষ ব্যপার। কারনে বাংলাদেশের দাউদকান্দি থেকে ত্রিপুরার সোনমুড়া পর্যন্ত ৯২ কিলো মিটার পথে ২৩টি ছোট-বড় ব্রিজ ও লোহার সেতু রয়েছ। এগুলোকে সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নতুন করে নির্মান করতে হবে। আবার ত্রিপুরার ডুম্বুর এলাকায় গোমতীর উৎপত্তি স্থলে অবস্থিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ -যেটি এখন অপ্রোয়জনীয় এবং পরিত্যক্ত বলা যায় সেটি খুলে দেয়া, রানীমহল এবং বেজিমারার স্ল্যুইট গেইট দিয়ে নতুন করে পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ভাবতে হবে -যাতে নদির নাব্যতা বৃদ্ধি পায়।ফলে বিষয় গুলো দু‘দেশের যৌথ ব্যবস্থাপনার বিষয় ।সেদিকে নিশ্চই দু‘দেশকে নজর দিতে হবে।তবে একথা বলতেই হয় যে, এই নৌপথ নিয়ে ত্রিপুরা সরকারের সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা রয়েছে।তারা চাচ্ছে,গোমতীর সম্প্রসারিত নৌ পথ হবে খুলনার মঙ্গলাবন্দর পর্যন্ত।যাতে এই পথে পণ্যসামগ্রী সহজেই ত্রিপুরাসহ অন্যান্য রাজ্যগুলোতে আনানেয়া করা যায়।তাতে সময় এবং ব্যয় অনেক কমে যাবে।আগরতলার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জানান, ছোট নৌযান হলেও পরীক্ষামূলক এই চালানে ৯.৮টন ওজনের মোট ১৯৬ বস্তা সিমেন্ট বহন করে আনা হয়েছে।তিনি জানান,তারা প্রতি ট্রাকে ৪শত বস্তা করে সিমেন্ট বহন করেন। সে হিসাবে ট্রাক থেকে অনেক কম খরচে তারা ঢাকা থেকে সিমেন্ট আনতে পারবেন। এমনি ভাবে হিসাব কষেই ব্যবসায়ীগণ বলছেন, নৌবাণিজ্য চালু হলে উভয় দেশের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও বাড়বে।
কিন্তু, অন্তর্জাতিক নদি বলে কথা।গোমতীর ত্রিপুরা অংশের পানি চলাচলের স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার যৌক্তিক সমাধান করা না গেলে,কিংবা এক তরফা পানি প্রত্যাহার এবং প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত থাকলে এই পথের সম্ভাবনা,আশা হয়তো আশঙ্কায় পরিণত হেতে পারে। দূর্জনেরতো আর অবাব নেই। এটাকে ইস্যু করেই শুধু বানিজ্যই শুধু নয়,দুদেশের জনগনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পরিস্তিতি তৈরী করার পরিবেশও উসকে দিতে পারে।তবে দু‘দেশে এখনো শুভবুদ্ধি,খোলা মনের মানুষের অভাব নেই এটুকুই সবচেয়ে বড় আশা।