
‘লাব্বায়েক
আলাহুম্মা লাব্বায়েক’ ‘লাব্বায়েক আলাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনিতে পাপমুক্তি,
রোগমুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় হাজীদের চোখের পানিতে সিক্ত হয়েছে
আরাফাতের ময়দান। দুহাত তুলে দশ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের
কল্যাণের পাশাপাশি করোনার মতো মহামারী থেকে রক্ষা, মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও
সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। সারাবিশ^কে মহামারী করোনা থেকে রক্ষা করতে আল্লাহর
দরবারে ফরিয়াদ জানানো হয়। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সবাইকে সুস্থ করতেও
আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করা হয়। পাপাচার ও অনাচার থেকে দূরে রাখতে আল্লাহর
কাছে প্রার্থনা করা হয়। বৃহস্পতিবার দিনভর আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের
মাধ্যমেই সম্পন্ন হলো পবিত্র হজ। বুখারী মুসলিম শরীফে রয়েছে, মকবুল হজের
প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। করোনা তা-বে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন এক নতুন
মডেলের হজ। যেখানে প্রত্যেক হাজীকে দেয়া হয়েছে ভিআইপি প্রটোকল।
দুনিয়া ও
আখেরাতের কল্যাণ, রহমত প্রাপ্তি ও নিজেদের গোনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তাআলার
দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফরিয়াদ জানান সমবেত ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ। সংখ্যায়
অল্প হলেও মহামারী করোনার এ সময়েও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যের
অবতারণা হয় আরাফাতের ময়দানে। বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণ কামনাসহ মহামারী করোনা
থেকে মুক্তি চেয়েছেন হজে অংশগ্রহণকারীরা। দিনভর কান্নাকাটি দোয়া-ইসতেগফারের
পর সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে রওনা হন মুজদালিফার দিকে। যেখানে খোলা আকাশের
নিচে রাত কাটান মুসলিম উম্মাহ। আর এর মাধ্যমেই পালিত হয়েছে হজ।
তাওবাহ-ইসতেগফার, তাকবির ও তালবিয়ায় মুখরিত ছিল ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দান।
হজে অংশগ্রহণকারীরা এক সামিয়ানায় সমবেত হয়ে মহান আলাহর কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করেন। হাজিদের উপস্থিতিতে এবারের আরাফাতের ময়দান কানায় কানায়
পরিপূর্ণ না হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় জাবালে রহমতের পাদদেশে হজ পালন করেন
তারা। সৌদি আরবের ইতিহাসে এবারই প্রবীণ শায়খ ড. আব্দুল্লাহ ইবনে সুলাইমান
আল-মানিয়া মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করেন। এবার মহামারী
করোনার কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সৌদি আরবের বাইরে থেকে পবিত্র হজ পালনে কোন
লোক অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তবে সৌদিতে বসবাসকারী বিশ্বের ১৬০ দেশের মানুষ
এবারের হজে অংশগ্রহণ করেছেন। যেখানে অন্যান্য বছর প্রায় ২০ থেকে ২৩ লাখ লোক
হজে অংশগ্রহণ করতেন-সেখানে সবমিলিয়ে ১০ হাজার লোকের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত
হয়েছে এবারের হজ। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহও হজ পালনকারীদের সঙ্গে [জঞঋ
নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশআল্লাহর দরবারে
মোনাজাতে শরিক হন।
হজের খুতবা পাঠ করেন সৌদি আরবের-শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে
সুলাইমান আল-মানিয়া। সৌদির স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় শুর হয়ে আধা
ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে খুৎবা। এই সময় তিনি তুলে ধরেন বিশ্বের বর্তমান
পরিস্থিতি ও কোরআন হাদিসের আলোকে করণীয় দিকনির্দেশনা। মসজিদে নামিরা থেকে
খুতবার শব্দ গোটা আরাফাতে শোনা না গেলেও মুসল্লিরা রেডিও এবং টিভির মাধ্যমে
শুনেছেন গুরুত্বপূর্ণ এ খুতবা। তিনি খুতবায় সারাজাহানের মুসলিম উম্মাহর
শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া আরব বিশ্বের সমস্ত
মুসলমানের ঐক্য ও সংহতির গুরুত্বের কথা উল্লেখ ইমাম বলেন, দুনিয়ায় ফেতনা
সৃষ্টিকারী ও শান্তি বিনষ্টকারীরা পরকালে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আল্লাহ ও
রাসুলের তরিকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিংসাবিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষের কল্যাণে ব্রত
হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, শান্তির ধর্ম ইসলাম। এ ধর্মে বিশ্বাসীদের
মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না। মুসলমানরা সবাই ভাই ভাই। সবাইকে মিলে
মিশে থাকতে হবে। মা-বাবা বয়স্ক হলে তাদের দেখাশুনা করতে হবে। বর্তমান
বিশ্বের মুসলমানের ওপর অত্যাচারীদের হেদায়েত করার জন্য আল্লাহর খাস রহমত
কামনা করেন। আরর বিশ্বের বর্তমান সহিংসতার কথা উল্লেখ করে তিনি পশ্চিমা
শক্তিকে হীনরাজনীতি থেকে বিরত থাকা ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান। আল্লাহ
কখনও কখনও বান্দাদের বিপদ-আপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।
আল্লাহ রাত ও দিনের নিয়ন্ত্রণকারী। আল্লাহকে ভয় করতে হবে। তোমরা
পালনকর্তার ইবাদত করো। তোমরা অন্যর সম্পদ গ্রাস করো না। আল্লাহর নির্দেশ
মান্য করো। পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকো। খুতবায় আরও বলা হয়, সৌদি সরকার করোনা
নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মক্কা ও মদিনা সুরক্ষার জন্য কাজ করা
হচ্ছে। হে আল্লাহ আমাদের এই মহামারী থেকে রক্ষা করুন। অসুস্থদের সুস্থ করে
দিন।
দুপুরে খুতবার পর জোহর ও আছরের নামাজ আদায় করেন হাজীরা। পরে তারা
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও
এশার নামাজ আদায়ের নিয়তে রওনা হন। রাতে সেখানে অবস্থান করেন খোলা মাঠে।
শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন এখানেই। আজ শুক্রবার
মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ
হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশে
সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে)
গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এরপর স্বাভাবিক পোশাক
পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের
সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায়
যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ
করবেন। এরপর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যারা মদিনায় যাননি,
তারা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদিনায় যাবেন। যারা আগে মদিনায় গেছেন, তারা নিজ
নিজ এলাকায় ফিরবেন।
উল্লেখ্য করোনা তা-বের দরুন এ বছর বিশ্বের লাখ লাখ
ধর্মপ্রাণ মুসলিম সৌদি আরবে পবিত্র হজ পালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
সৌদি সরকার সবমিলিয়ে এ বছর মাত্র ১০ হাজার জনকে হজ পালনের সুযোগ দিয়েছে।
সুযোগ পাওয়াদের মধ্যে ৩০ শতাংশ সৌদি নাগরিক এবং ৭০ শতাংশ অন্যান্য দেশের
নাগরিক। তবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কোন দেশের কত সংখ্যক নাগরিক এবারের
ব্যতিক্রমধর্মী এ হজ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। কোন
দেশের কত সংখ্যক নাগরিক এবারের হজে অংশগ্রহণ করছেন, সে ব্যাপারে কঠোর
গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ফলে সৌদিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীর মধ্যে থেকে
কতজন সুযোগ পেয়েছেন সে সম্পর্কে তথ্য নেই হজ মিশন কর্মকর্তাদের কাছে। শুধু
বাংলাদেশেরই নয়, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কেউ
সঠিক তথ্য জানেন না। এবার বাংলাদেশ হজ মিশন কর্মকর্তা, অর্থাৎ ডিপ্লোমেটিক
অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের কেউ হজ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে
সুখবর হলো- এ বছর হজযাত্রীরা ভিআইপি মর্যাদায় হজ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন। সব
হজযাত্রীকে মক্কায় পাঁচতারকা হোটেলে পৃথক পৃথক কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রতি ২০ জন হজযাত্রীর ওমরাহ পালন ও তাওয়াফসহ হজ পর্যন্ত সকল আনুষ্ঠানিকতা
পালনের জন্য একজন করে গাইড নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার
আগে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। প্রতিবছর মিনাতে
হজযাত্রীদের তাবুতে রাখা হলেও এবার তাদের পাঁচতারকা সমমানের হোটেলে রাখা
হয়েছে। মক্কা থেকে তাদের অত্যাধুনিক গাড়িতে করে মিনায় নেয়া হয়। সেখানে
পৌঁছানোর পর হাজিদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। প্রতি ৫০ জন হজযাত্রীর
জন্য একজন করে অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খাবার, পানি ও ফলমূলের
পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখা হয়েছে। প্রত্যেক হাজীকে একটি করে রিস্টব্যান্ড দেয়া
হয়েছে, যেখানে তাদের তাপমাত্রা পরিমাপসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশেষ
সফটওয়্যারের মাধ্যমে রাখা হয়েছে। কোন হজযাত্রীর জ্বর হলে বা অন্য কোন
অসুস্থতা দেখা দিলে তা সফটওয়্যারেই ধরা পড়বে। প্রতিটি হজযাত্রীর গতিবিধি
পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সৌদি থেকে সাংবাদিক আবুল বশির জানান- চলতি মাসের
প্রথমে এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে হজ পালনে ইচ্ছুকদের নিবন্ধনের জন্য
আবেদন গ্রহণ করা হয়। সৌদি নাগরিকসহ বর্তমানে দেশটিতে অবস্থানরত বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে যারা ইতোপূর্বে হজ করেননি- যাদের বয়স ২০
থেকে ৬৫ বছর এবং ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতাসহ বিভিন্ন জটিল অসুখে
ভুগছেন তাদের ছাড়া অপেক্ষাকৃত সুস্থদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০
হাজারের মতো হজযাত্রী নির্বাচিত করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে মক্কায়
বাংলাদেশ হজ মিশনের হজ কাউন্সিলর মাকসুদুর রহমান বলেন, এ বছর হজযাত্রীদের
জন্য সৌদি সরকার চমৎকার আয়োজন করেছে। তাদের ব্যবস্থাপনায় সবাই বেশ খুশি।
সৌদিতে অবস্থানরত কতজন বাংলাদেশী হজ পালনের সুযোগ পেয়েছেন-জানতে চাইলে তিনি
বলেনÑ এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য এ মুহূর্তে তার কাছে নেই। আমার জানা মতে ভারত,
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাছেও এ সংক্রান্ত তথ্য
নেই। বাকিদের তথ্যও আমার কাছে নেই।
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এর
মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ করেন। এই দিনেই আলাহ রাব্বুল
আলামিন বান্দার গুনাহ সর্বোচ্চ পরিমাণে মাফ করে থাকেন। হাদীস অনুযায়ী হজের
মাধ্যমে বান্দা যেন সদ্যজাত শিশুর ন্যায় বেগুনাহ মাসুম হয়ে যায়। হযরত
ইব্রাহীম (আ.) এর সময় থেকে শুরু এই হজের মাধ্যমে বান্দার জন্য আল্লাহর রহমত
ও নেয়ামত বর্ষিত হতে থাকবে যুগ যুগ ধরে, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। হজের
তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিজরী
১০ সালে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ চলাকালীন আরাফায় অবস্থিত জাবালে রহমত
পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ
দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবৎকালে এটা ছিল শেষ ভাষণ। তাই সচরাচর
এটিকেই বিদায়খুৎবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ
অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণেই চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া
ছিল।