
আহসান কবির ||
বাঙালির
বাজারে যাবার ‘হুজুগ’ কিংবা বাজার থেকে ফেরার গল্প নিয়ে কয়েক শ পাতার
কয়েকটা সংকলন বের করা যাবে। হুজুগের সাথে সাথে বাজারকে বাঙালি নাকি দেখে
উপর বা দোতলা থেকে। যেমন এক লোক ছয়ফুট লম্বা। সে বাজারে গেছে ছোট মাছ
কিনতে। বিক্রেতাকে সে বললো- গন্ধ শুনে মনে হচ্ছে এই মাছ পঁচা। বিক্রেতা
রেগে গিয়ে বললো- মাছ অবশ্যই তাজা। দেখতে তো আছেন দোতালা থাইক্কা। নীচে
নাইমা মাছ হাতে নিয়া ধইরা দেখেন।
অনেক সময় এই দোতলা থেকে বাজারের
বিক্রেতা পর্যন্ত দূরত্বের মাঝখানে বাস করে গুজব। আর গুজব নিয়ে প্রাচীনতম
গল্পটা হয়ত অনেকেই জানেন। রানী মা মৃত যমজ সন্তান প্রসব করেছেন। গুজবের
ডালপালায় ভর করে দূরতম প্রজার কাছে এই সংবাদ এইভাবে পৌঁছাল যে রানী মা এক
জোড়া কালো কাক প্রসব করেছেন! প্রসবের পরপরই ওড়ার চেষ্টা করায় কাক দুটির
মৃত্যু হয়েছে। কালো সেই কাক দেখার জন্য প্রজারা দলে দলে ভিড় জমাতে লাগলো
রাজমহলের আশেপাশে।
বাজার এবং গুজব নিয়ে শুধু যে বাঙালিকে দোষ দেয়া হয়ে
থাকে ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। গুজবের জিহবার স্বাদ হতে দেশ-বিদেশের মানুষ
নিজেই যেন ছুটে যায়। যেমন ধরুন চীন ও জাপানের ঘটনা। জাপানে ভূমিকম্পের
কারণে সুনামি হলো বা সুনামির কারণে ভূমিকম্প। বিদ্যুৎ ছিল না বলে কয়েক
ঘন্টার মধ্যে বেড়ে গেল মোমবাতির দাম। মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না এমন গুজব
ছড়িয়ে পড়লে সবাই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো মোমবাতি কিনতে। ২০১১ সালে ভূমিকম্পের
কারণে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান
থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এটা জানার পর চীনে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, লবন
খেলে শরীরে তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি কম হয়। সঙ্গে সঙ্গে চীনারা বাজারে হামলে
পড়ে লবন কেনার জন্য। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লবনের দাম হয়ে যায় আগের তুলনায়
তিনগুণ। চীনের মতো বাংলাদেশেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে গুজব ছড়িয়ে পরে যে লবনের
দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশবাসী হুজুগের বশবর্তী হয়ে লবন কিনতে থাকে কিন্ত
একদিন পরেই জানা যায় লবনের দাম আদৌ বাড়েনি এবং মজুদ আছে প্রচুর। হুজুগ
বাঙালিকে টেনে নেয় বাজারের দিকে, গুজবের পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা কাঙাল হতেও
হয়তো দ্বিধা করে না। লবনের দাম বাড়ার ঘটনা গুজব বা হুজুগ হলেও পেঁয়াজ
সেখানে বাস্তবতা। সময়ে অসময়ে পেঁয়াজের ঝাঝ বাড়ে, চেষ্টা করেও তার দাম কমে
না। বাস্তবতাও কী মানুষকে বেশিরভাগ সময় কাঙাল করে রাখতে পছন্দ করে?
ভারতের
এক রাজ্যে একবার হুহু করে বেড়ে যায় দুধের দাম। ঐ রাজ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে,
পিতলের গনেশ মুর্তিতে দুধ ঢাললেই সেটা খাচ্ছে গনেশ। গনেশকে দুধ খাওয়ানোর
সময় দেবতার কাছে কিছু চাইলে নাকি মনস্কামনা পূরণ হয়। সবাই তখন নেমে পড়ে
দেবতাকে দুধ পান করাতে। মাঝখান থেকে বেড়ে যায় দুধের দাম। বাংলাদেশেও
খাবারের দুধনির্ভর একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে। ওই বছরের এপ্রিলে চেরনোবিলে
ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হয়
যে ডানো দুধে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। এদেশে তখন ডানো সবচেয়ে বেশি
বিক্রিত দুধ ছিল। যদিও চেরনোবিল থেকে হাজারো মাইল দূরে অবস্থিত ডেনমার্কের
কোম্পানি ডানো’তে এর প্রভাব পড়ার কথা নয় তবু এই গুজবের প্রতিক্রিয়া ছিল
ভয়াবহ। মানুষ সাময়িকভাবে এই কোম্পানির দুধ কেনা ছেড়ে দেয়,বাজারে রেডকাউসহ
অন্যান্য দুধের বিক্রি বেড়ে যায়। গুজবের পাখায় ভর করা হুজুগ মানুষকে টেনে
নিয়ে যায় বাজারে, মানুষও পাগলের মতো কেনার চেষ্টা করে গুজব বা হুজুগ
আক্রান্ত পণ্য। পরিণাম ‘কাঙাল অনুভব’!
গুজব বা হুজুগের সবকিছু মানুষ
কিনতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্যোতনা দেয় অন্ধ বিশ্বাস। পেতলের
গনেশকে দুধ খাওয়ানোর মতো চাঁদে দেওয়ানবাগী বা সাইদীকে দেখা গেছে টাইপ গুজব
আর মানুষের চাঁদ দেখার হুজুগ মাঝেমাঝেই যেন ফিরে আসে। যে চাঁদ সাধারণ মানুষ
কিনতে পারে না বা যেখানে তারা যেতে পারে না, সেই জায়গাটার দখল নেয় অন্ধ
বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কারণে বাজার থেকে চাল, লবন, পেঁয়াজ কেনার মতো মাজার
থেকে পড়া পানি কিংবা তাবিজ কেনে মানুষ!
বাজার থেকে যে রুই কাতলা মাছ
কেনে সাধারণেরা,গল্পের সময় সেই রুই কাতলার আকার ক্রমশঃ বাড়ে। সাত-আট ইঞ্চির
রুই গল্পে গল্পে পাঁচ-ছয় হাতও হয়ে যেতে পারে। আর স্বাদ? হাত শুঁকবে আর
বলবে যা খেয়েছি না এখনও হাতে লেগে রয়েছে। রান্নার সময়ে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল
সারা গ্রামে! যদিও বাজার করে আসার সময় মাছের লেজটা ব্যাগের বাইরে থেকে দেখা
যাবার দিন কিংবা মাছ কতো দিয়ে কিনলেন সেই দিন হয়তো অনেক আগেই গত হয়েছে।
এখন বাজার করার পরের ছবি ফেসবুকে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া ফ্যাশন।
বাজার থেকে ফেরার সময়ে কেউ জানতে না চাইলেও ফেসবুকে প্রশ্নের ঝড় উঠবে- ভাই
কতো দিয়ে কিনলেন? একইভাবে রুই কাতলার দাম বর্ণনার মতো তাবিজ কবজের প্রশংসাও
পাওয়া যায় ফেসবুকে! কোন পীরের কোন তাবিজে বা আংটিতে কার কী উপকার হয়েছে
সেই বর্ণনা কিংবা বিজ্ঞাপনও মিলবে। হুজুগ এখনও মানুষের নিত্য অনুষঙ্গ!
আগে
গুজব ছিল ন্যাড়া মাথায় বাজ বেশি পড়ে! আর যদি ন্যাড়া মাথায় বাজ পড়ার পর কেউ
মারা যায় তখন সেসব লাশ নাকি কবর থেকে চুরি হয়ে যায়,চড়া দামে বিক্রি হয়।
সীমান্ত পিলার নিয়েও এমন গুজব ছিল। সীমান্ত পিলারের নীচে নাকি ইউরেনিয়াম
থাকে তাই সেসব নাকি চোরাচালানীদের মাধ্যমে বিক্রি হয়। এই হুজুগ নিয়ে কত
মানুষ যে ঘুরে বেরিয়েছে, কতজন যে গ্রেফতার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ইদানীংকার
গুজব সমস্ত সীমান্ত পিলার নাকি ভারত নিয়ে গেছে! হাল আমলের চলমান গুজব
হচ্ছে মোবাইল ফোনের অ্যান্টেনা, ইন্টারনেট এসবের কারণে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে!
গুজব
আর হুজুগ মানুষকে প্রভাবিত করে আসছে শত শত বছর ধরে। এখন ডিম খেয়ে খারাপ
লাগলেই মানুষের সন্দেহ হয়- আরে প্লাস্টিকের ডিম নাতো? সন্দেহ থেকে ছড়ায়
গুজব- চীনারা নকল ডিম বাজারে ছেড়েছে। কেউ কেউ ইন্ডিয়াকেও দোষ দেয়! ভেবে
দেখে না কেমিক্যাল দিয়ে বানানো ডিম উৎপাদন, বাজারজাত, রপ্তানি, পরিবহন
মূল্য এরপর পাইকারি খুচরা বিক্রেতার লাভ মিলিয়ে একটা নকল ডিমের দাম পড়তে
পারে ৭০-৭৫ (আনুমানিক) টাকা। এমন ডিম বাজারের ৮-৯ টাকার আসল ডিমের সাথে
প্রতিযোগিতা করতে আসবে কেন? ডিমের মতো প্লাস্টিকের চাল নিয়েও গুজব আছে।
গুজব
ছিল এক টাকার কয়েনকে নিয়েও। ১৯৯৮ সালে তামার পরিমাণ বেশি এমন একটা এক
টাকার কয়েন বাজারে ছেড়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কয়েনে তামার পরিমাণ ছিল
২.৭৬ ভাগ, দস্তার পরিমাণ ১.২০ ভাগ ও টিনের পরিমাণ ছিল .০৪ ভাগ। ২০১০ সালে
গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তামার দাম কমলেও দ্রুত বাড়ছে কয়েনে থাকা তামার দাম। একই
সময় গুজব ছড়ানো হয় যে, জ্বীনের বাদশা জমানো তামা সোনায় পরিণত করতে পারে। কে
কে তামার বদলে সোনা পেয়েছে সেই হিসেবও চলতে থাকে! হুজুগের পাখায় ভর করে
বাড়তে থাকে কয়েনের দাম, এক টাকার কয়েনের দাম বাড়তে বাড়তে তিনশত টাকায় গিয়ে
ঠেকে! পরে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে এই গুজব থামানো হয় এবং বাঙালির এক টাকার
কয়েন কেনার হুজুগ থামে। জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড বা অ্যামেরিকার গুজব
মূলতঃ ব্যবসানির্ভরই হয়ে থাকে। সেখানে হয়তো চাঁদে কারো মুখ দেখতে পাবার
কিংবা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে না। গুজব ছড়ায়
এমন- ‘অমুক’ কোম্পানির মালিকের হঠাৎ মৃত্যু। সংগে সংগে ঐ কোম্পানির শেয়ারের
মূল্য কমতে থাকে। কম মূল্যে তখন ঐ শেয়ার কিনে রাখে কেউ কেউ। পরে ঘটা করে
জানানো হয় যে ঐ কোম্পানির মালিকের মৃত্যু হয়নি, তিনি বেঁচে আছেন। এবং বেঁচে
ওঠার খবরে আবারো বাড়ে ঐ কোম্পানির শেয়ারের দাম। যারা কম দামে কিনে
রেখেছিলেন তারাই লাভবান হয়ে ওঠেন এই গুজবের কারণে। বাংলাদেশের শেয়ার বাজার
গুজব আর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণে প্রায়শই ধ্বংসস্তুপের ভেতরে থাকে! পথে
বসে যায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা!
হুজুগ আর বাঙালির পথচলা সমান্তরাল হলেও
গুজব-হুজুগের পেছনে কম-বেশি অনেক দেশের মানুষকেই দৌঁড়াতে দেখা যায়। মানুষ
মাত্রই কমদামে তাদের প্রিয় পণ্য কিনতে চায়। কেউ লাভ আর কেউ কেউ নিজ
প্রয়োজনে জমিয়ে রাখতে চায় পণ্য। কেউ কেউ অন্যদের দেখে হুজুগে মাতে। বহু বছর
ধরে এমন চলে আসছে। চাইলে বা চেষ্টা করলেও কী এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব? আমরা
একটা গল্প শুনে বিদায় নেই এবং ভবিষ্যতের গুজব ও হুজুগ নিয়ে ভাবতে থাকি।
গুজব
আর হুজুগের কারণে এক এলাকার লোকজন খুবই অশান্তিতে ভুগছিল। কীভাবে গুজব ও
হুজুগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার উপায় খুঁজছিল। এমন সময় এক সাধুবাবার
আবির্ভাব ঘটলো। সাধুবাবার পরনে নেংটি আর গলায় গামছা। তিনি এলাকাবাসীকে জড়ো
করে বললেন-সমুদ্রস্নানে যেতে হবে। তার দোয়ায় জলের সাথে ভেসে যাবে গুজব আর
হুজুগ। নির্দিষ্ট দিনে সাধুবাবার পেছনে সমবেত হলো এলাকার সব লোক। সাধুবাবার
নেতৃত্বে শুরু হলো প্রার্থনা ও সমুদ্রস্নান। স্নান শেষে এলাকার সব লোক
তীরে উঠে দাড়াল। উঠলেন না শুধু সাধু বাবা। তিনি বুক ডুবিয়ে দাঁড়িয়েই
থাকলেন। লোকজন জানতে চাইলো- সাধুবাবা উঠছেন না কেন?
সাধুবাবা জানালেন-
গুজব ও হুজুগ বিদায় হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে প্রার্থনা ও স্নানের
জলের সাথে আমার পরনের নেংটি ও গামছা যে ভেসে গেছে সেটা বিলকুল বুঝতে পারছি!
লেখক: রম্য লেখক, নাট্যকার ও কলামিস্ট। হেড অব প্রোগ্রাম, বৈশাখী টেলিভিশন।