
আবুল কাশেম হৃদয়।।
কুমিল্লা
ইপিজডে কাজ করছে প্রায় ৩৪ হাজার শ্রমিক। যার মধ্যে প্রায় ৬৬ শতাংশ নারী। এই
বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের মজুরি ভাতা বাবদ প্রতিমাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়
হচ্ছে। ইপিজেডে শ্রমিকরা নির্ধারিত উন্নত বেতন কাঠামোতে প্রতি মাসের সাত
তারিখে বেতন পাচ্ছেন। তাছাড়া শ্রমিকগণ দুপুরের খাবার বা খাবারের জন্য ভাতা,
পরিবহন ভাতা, হাজিরা ভাতা এবং রাত্রিকালীন ভাতাসহ নানা সুবিধাও পেয়ে
থাকেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকে এখন ইপিজেডে নিজের কর্মসংস্থান খুঁজে
নিয়েছেন। তারা মনে করছেন শুধু সরকারি চাকুরি দিকে না দৌঁড়ে ইপিজেডগুলোতেও
উচ্চ মূল্যে চাকুরির সুযোগ রয়েছে। আর উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে পারলে বিদেশী
শ্রমিক নির্ভরতাও কমে আসবে।
জানা গেছে, কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত
শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রায় ৯০ শতাংশই কুমিল্লা জেলার অধিবাসী। নির্মাণাধীন
প্রতিষ্ঠানসমূহ উৎপাদন শুরু করলে কুমিল্লা ইপিজেডের কর্মসংস্থানের পরিমান
২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইপিজেড সূত্র
জানায়, চলতি বছরে কুমিল্লা ইপিজেডে রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার তিন শত
কোটি টাকা থাকলেও মাত্র নয় মাসে তা পৌঁছে গেছে তিন হাজার কোটি টাকায়। আর
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি
করা হয়েছে কুমিল্লা ইপিজেড থেকে। দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে অত্যন্ত
আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসাবে সুপরিচিত কুমিল্লা ইপিজেড বিনিয়োগ,
আমদানী-রপ্তানী এবং কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র হিসাবে এই অঞ্চলের আর্থ
সামাজিক উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কুমিল্লা ইপিজডে বর্তমানে প্রায়
৩৪ হাজার বাংলাদেশী নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে
প্রায় ৬৬ শতাংশ নারী।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে একনেকে
অনুমোদনের পর এপ্রিল মাস থেকে কুমিল্লা ইপিজেডের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ জুলাই, ২০০০ এ আনুষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লা
ইপিজেড উদ্বোধন করেন। যাত্রা শুরুর পর কুমিল্লা ইপিজেড ইতিমধ্যে ১৮ বছর
পূর্ণ করেছে। কুমিল্লা ইপিজেড ঢাকা থেকে ১০০ কিঃমিঃ এবং চট্টগ্রাম থেকে ১৭৬
কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত হওয়ায় তা ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থান
করছে বিধায় ইপিজেডটি দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়
বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসাবে সুপরিচিত। এটি বিনিয়োগ, আমদানী-রপ্তানী এবং
কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র হিসাবে এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে
বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কুমিল্লা ইপিজেডের মোট আয়তন ২৬৭.৪৬ একর। মোট
শিল্প প্লট ২৪০ টি এবং ইতিমধ্যে সবকটি শিল্প প্লট দেশী বিদেশী
বিনিয়োগকারীগণের মধ্যে প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে কোন প্লট খালি নেই।
কুমিল্লা ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস, গার্মেন্টস
এক্সেসরিজ, স্যুয়েটার, ফেব্রিক্স, সুতা, টেক্সটাইল ডাইজ এন্ড অক্সিলিয়ারিস,
ইলেকট্রনিক্স পার্টস, এলিমেনেটিং ব্রাশ, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার আপারস,
ক্যামেরা কেইস, ব্যাগ, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন এক্সেসরিজ, মেডিসিন
বক্স, আই প্যাচ, কার্পেট প্রভৃতি। চীন, তাইওয়ান, হং কং, নেদারল্যান্ড,
আয়ারল্যান্ড, জাপান, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, দক্ষিণ
কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া এবং স্বাগতিক বাংলাদেশের
বিনিয়োগকারীরা কুমিল্লা ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে।
কুমিল্লা ইপিজেডে
নেদারল্যান্ডের গোল্ডেন মুন বাংলাদেশ লিমিটেডের আবাসিক প্রতিনিধি কার্লো
ফেরেত্তি জানান, বাংলাদেশে তিনি বিশ বছর ধরে কাজ করছেন। এর মধ্যে ৫ বছর ধরে
তিনি কুমিল্লায় বসবাস করছেন। সব মিলিয়ে আমি অনেক সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি।
আমার অভিজ্ঞতা খারাপ নয়। আমি কোন সমস্যায় পড়ি নি। বাংলাদেশের শ্রমিকরা ভালো
মানুষ। শতভাগ না হলেও ৯৯ ভাগই আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে। যদি সঠিকভাবে ও
সঠিক উপায়ে শ্রমিকদের ম্যানেজ করা যায় তাহলে আমি কোন সমস্যা দেখছি না।
তিনি
খুব দৃঢ়তার সাথে বলেন, কুমিল্লা ইপিজেডে তার ফ্যাক্টরিতে সমপরিমাণ
মেশিনারিজ ও সম পরিমাণ শ্রমিক দিয়ে আড়াই শত ভাগ বেশি উৎপাদন হয়েছে। আমাদের
সব শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তারা আমাদের এখানে অনেক সাচ্ছন্দ্যবোধ
করে। কুমিল্লা ও বাংলাদেশে শ্রমিক কোন সমস্যা নয় সমস্যা হচ্ছে
মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থাপনা।
শ্রীলংকার ব্রেন্ডিক্স ফ্যাক্টরির সিইও
কানুজা হেরাছ জানান, কুমিল্লা ইপিজেডে শিল্প প্রতিষ্ঠান করে সবচেয়ে সফল
হয়েছে তাদের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান। বিশে^র বিভিন্ন দেশে তাদের ৩৪টি শিল্প
কারখানা আছে, তাদের মধ্যে সেরা উৎপাদন হয়েছে কুমিল্লার কারখানায়। আমাদের
উৎপাদিত পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। শ্রমিকরাও ফ্রেন্ডিলি। ২
হাজার ৬ শত স্থানীয় শ্রমিক এখানে কাজ করছে। আর আমিসহ বিদেশী আছে মাত্র ১২
জন।
সায়মা আক্তার তাজরিন নামের একজন নারী শ্রমিক জানান, পরিবেশসহ সকলের
সহযোগিতায় কুমিল্লা ইপিজেডে কাজ করতে ভালোই লাগে। নিজে কাজ করে নিজের
পড়াশুনার খরচ জোগাই। পরিবারেও সহায়তা করি।
এসএসসি পাশ করে কুমিল্লা
ইপিজেডে নাম্বারিং অপারেটর হিসেবে কাজ করা সামিয়া সুলতানা জানান, সংসারে
বাবার আয়ের সাথে সেও আয় করে অর্থের জোগান দিচ্ছে। সে মনে করে ছেলেদের মতোই
মেয়েরাও সংসারের হাল ধরতে পারে। সমানভাবে কাজ করতে পারে, আয় করতে পারে।
কুমিল্লা ইপিজেডে কাজ করে আমি আমার খরচ জোগাচ্ছি। নিজের পোষাক আষাক নিজেই
কিনছি। নিজেই খরচ করছি। বাবা মাকেও সংসারের জন্য অর্থ জোগান দিচ্ছি। আমরা
চার বোন। দুজনের বিয়ে হয়েছে।
বেন্ডিক্সের ফ্যাক্টরিতে কাজ করা আরেক
নারী শ্রমিক জানান, অফিসিয়াল ট্রিপে শ্রীলংকা ঘুরে এসেছি। কাজ করে ভালো
করায় আমাকে এই সুযোগ দিয়েছে। এখানে কাজ করে সংসারে আর্থিক সহায়তা করছি। যদি
বাসায় থাকতাম তাহলে বসে ঘুমিয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখানে কাজ করে আমি
স্বাবলম্বি ।
কোয়ালিটি সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করা মাকসুদুল আলম
সাদ্দাম জানান, বেস্ট সুপারভাইজার হিসেবে আমাকে শ্রীলংকা নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে আমরা ঐতিহাসিক স্থানসমূহে ঘুরেছি। শ্রীলংকার একটি ফ্যাক্টরিতে
গিয়েছি। তারা কিভাবে কাজ করে তা দেখেছি।
তিনি বলেন আমি একজন রেমিটেন্স
যোদ্ধা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এখানে কাজের সুযোগ রয়েছে। এখানেও উন্নত জীবন
গড়া যাবে। শুধু সরকারি চাকুরির দিকে ছুটলেই হবে না।
বাংলাদেশ রপ্তানী
প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)র মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা
বিনতে আলমগীর জানান, বরাদ্দকৃত শিল্প প্লটসমূহে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প
প্রতিষ্ঠান নিয়মিত আমদানী-রপ্তানীসহ উৎপাদনরত রয়েছে (সম্পূর্ণ বিদেশী ২৪টি,
যৌথ বিনিয়োগে ১০টি এবং দেশীয় বিনিয়োগে ১৩টি)। ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান
নির্মাণাধীন পর্যায়ে রয়েছে যারা অচিরেই উৎপাদন শুরু করবে। কুমিল্লা ইপিজেডে
মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭৮৪ কোটি টাকা। কুমিল্লা ইপিজেড থেকে এ
পর্যন্ত রপ্তানী হয়েছে ২২,৮৬০ কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্য। চলমান অর্থ বছরে
(২০১৮-১৯) কুমিল্লা ইপিজেড হতে রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে
৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩২৮০ কোটি টাকা। চলমান অর্থ বছরের প্রথম ০৯
মাসে রপ্তানীর পরিমান দাঁড়িয়েছে ৩৬৪.৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৯৯২ কোটি
টাকা।
তিনি জানান, কুমিল্লা ইপিজডে বর্তমানে মোট ৩৩,৮৫৬ জন বাংলাদেশী
নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৬৬ শতাংশ নারী।
এছাড়া বর্তমানে কুমিল্লা ইপিজেডে ১৯৮ জন ওয়ার্কপারমিটধারী বিদেশী নাগরিক
কর্মরত আছেন। প্রতি বছর নতুন র্কমসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিপুল
সংখ্যক শ্রমিকের মজুরি ভাতা বাবদ প্রতিমাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
ইপিজেডে শ্রমিকগণ নির্ধারিত উন্নত বেতন কাঠামোতে প্রতি মাসের সাত তারিখে
বেতন পেয়ে থাকেন। তাছাড়া শ্রমিকগণ দুপুরের খাবার বা খাবারের জন্য ভাতা,
পরিবহন ভাতা, হাজিরা ভাতা এবং রাত্রিকালীন ভাতাসহ বিভিন্ন রকম আর্থিক ও
অনার্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন । উল্লেখ্য যে, কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত
শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রায় ৯০ শতাংশই কুমিল্লা জেলার অধিবাসী। নির্মাণাধীন
প্রতিষ্ঠানসমূহ উৎপাদন শুরু করলে কুমিল্লা ইপিজেডের কর্মসংস্থানের পরিমান
২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৫০,০০০ হবে বলে আশা করা যায়।
জানা গেছে, দৈনিক
১৫,০০০ ঘনমিটার শোধন ক্ষমতা সম্পন্ন কুমিল্লা ইপিজেডের ঈবহঃৎধষ ঊভভঁষবহঃ
ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ (ঈঊঞচ) ডিসেম্বর-২০১৪ হতে তাদের অপারেশন শুরু করেছে। এখানে
উল্লেখ্য যে, কুমিল্লা ইপিজেডে নির্মিত ঈঊঞচ এর বর্জ্য শোধনের ক্ষেত্রে
ঈযবসরপধষ-ইরড়ষড়মরপধষ উভয় ধরণের ঞৎবধঃসবহঃ এর ব্যবস্থা থাকায় তা বাংলাদেশে
নির্মিত ঈঊঞচ গুলোর জন্য মডেল ঈঊঞচ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেডে
দৈনিক ১৫,০০০ ঘনমিটার ডধঃবৎ ভড়ৎ ওহফঁংঃৎরধষ ঁংব শোধন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি
ডধঃবৎ ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ (ডঞচ) রয়েছে।
এছাড়া, কুমিল্লা ইপিজেডের জন্য
সুনির্দিষ্ট একটি ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স স্টেশন ও একটি পুলিশ
ফাঁড়ি, আনসার ব্যারাক, কর্মরত শ্রমিকদের সন্তানদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য
বেপজা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের
লক্ষ্যে রয়েছে একটি মেডিকেল সেন্টার। কুমিল্লা ইপিজেড বর্তমানে অত্যন্ত
সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং
স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তায় কুমিল্লা ইপিজেডের এ শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ
বজায় রেখে আরো বেশি পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে রপ্তানী
বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেপজা তথা কুমিল্লা ইপিজেড
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।