ছাতাটা ফেলে এসেছি
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ||
Published : Tuesday, 8 August, 2017 at 1:33 AM
বর্ষাকালে
ছাতা ছাড়া যেদিন বের হয়েছি, হয়তো সেদিনই বৃষ্টি নেমেছে জোরে। আবার যেদিন
ছাতা নিয়ে বের হলাম, সেদিন বৃষ্টির দেখাই নেই। এমন বৈপরীত্য মাঝে মাঝেই
দেখা যায়। তবুও বর্ষার আগমনী বার্তা পেলেই আমাদের ছাতা সংগ্রহের ব্যস্ততা
বাড়ে। যদিও সবার কপালে জোটে না ছাতা। কিংবা জুটলেও ধরে রাখতে পারে না।
আমাদের
বৃহৎ পরিবারে প্রত্যেকের জন্য একটি করে ছাতা কেনার সামর্থ বাবার ছিলো না।
ফলে পুরনো ছাতা জোড়াতালি দিয়ে ঠিকঠাক করে তা দিয়েই চলতে হতো এক বর্ষা।
ছাতার সাইজ দেখলেও কান্না পেত। ইয়া বড় ডাঁট (লাঠি) সম্বলিত ছাতাটা যখন হাতে
ধরিয়ে দেয়া হতো, তখনই চোখে জল আসতো। তবে বৃষ্টির জলে ভেজার ভয়ে চোখের জল
লুকিয়ে ফেলতাম সঙ্গে সঙ্গে।
একটু বড় হওয়ার পর যদিও ছাতা জুটতো। তবে
প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে জুটতো পলিথিন। প্রতিদিন বাজার থেকে তরকারির সঙ্গে
আনা পলিথিন জমিয়ে রাখতেন মা। স্কুলে যাওয়ার সময় বইগুলো সেই পলিথিনে ভরে
হাতে তুলে দিতেন। বইগুলো বুকের সাথে লেপ্টে ধরে চলে যেতাম স্কুলে। যেদিন
সকাল থেকেই বৃষ্টি হতো, সেদিন স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে শার্ট আর
ফুল প্যান্ট পলিথিনে ভরে নিতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুলের একটি কক্ষে
গিয়ে জামাকাপড় পাল্টাতাম।
সেই দুর্দশা তো ঘুচলো। ছাতা ছোট হোক, বড় হোক-
ছাতাই তো। কাঠের ডাঁটওয়ালা কালো রঙের মোটা কাপড়ের ছাতা মাথায় দিয়েই যেতে
হতো বিদ্যালয়ে। কাঠের ডাঁটের ছাতা ছিলো নানার প্রিয়। ছাত্রছাত্রীদের বিদায়
অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি উপহার পেতেন ছাতা, পাঞ্জাবির কাপড়, রুমাল
ইত্যাদি। কখনো কখনো অতিরিক্ত ছাতা হলে মা নিয়ে আসতেন। নানার সেই নতুন
ছাতাটা উঠতো বাবার হাতে। আমাদের হাতে উঠতো বাবার পুরনো ছাতা।
বর্ষা আসার
আগেই মাকড়শার জাল, লোহার জং দূর করতে বের করা হতো ছাতা। সেই ছাতাটিও অনেক
সময় দেখা যায় নষ্ট। কাঁটাগুলো ছুটে গেছে, রং নষ্ট, ঠিকমতো বন্ধ বা ফোটানো
যায় না। এসব ঝামেলা থেকে বাঁচতে অকেজো ছাতাটি মেরামত করা হতো হাটবার।
পিঁপড়ায় কেটে কাপড়ও হয়তো ফুটো করে ফেলেছে। সেখানে জোড়াতালি দিয়েই সাজানো
হতো পুরনো ছাতাটি।
ভাঁজকরা দারুণ ছাতাগুলো তখনো আমাদের হাতে আসেনি। কত
সুন্দর সুন্দর বাহারি ডিজাইনের ছাতা। দেখলে লোভ হতো। যার বাবা-ভাই বিদেশ
থাকে, ওরা ব্যবহার করতো সেই ছাতা। বাজারে কিনতে গেলেও দাম চাইতো অনেক।
যেখানে আশি বা একশ’ টাকায় পাওয়া যেতো বড় ছাতা, সেখানে তিন-চারশ’ টাকা দিয়ে
কেন হালকা ছোট একটি ছাতা কিনে দেবে?
আগে প্রাইমারি স্কুলের কক্ষে
বেশকয়েকবার ছাতা ফেলে এসেছি। বৃষ্টি নেই, ছাতার কথাও মনে নেই। কিছুদূর এসে
যখন মনে পড়তো- দৌড়ে গিয়ে হয়তো নিয়ে আসতাম। তবে মাধ্যমিকে ওঠার পর আমার জন্য
বিশেষ ধরনের একটা সুবিধা ছিলো। নানা এবং বাবা-চাচারা একই প্রতিষ্ঠানে
চাকরি করায় শিক্ষকদের অফিস কক্ষেই রাখতাম আমার ছাতা। তাই ভুল হলেও পরদিন
গিয়ে আগের জায়গাতেই পেতাম। তেমন আর টেনশন করতে হতো না।
একবার মেয়েদের
কমন রুমে গিয়ে একটি কারুকাজখচিত ছাতার দিকে আমার নজর পড়লো। লোভ হলো ছাতাটা
চুরি করার। সে সময় কমন রুম ফাঁকা থাকায় ঢুকে গেলাম সাহস করে। ছাতাটা বন্ধ
করে পকেটে নিয়ে চলে এলাম শ্রেণিকক্ষে। কিছুক্ষণ পর ছুটি হয়ে গেলে চলে এলাম
বাড়ি।
কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায়। ছাতাটা একদিনও বের করতে পারছি না।
রেখে দিলাম ট্র্যাঙ্কের ভেতর। বের করলে পরিবারে জবাবদিহি করতে হবে। কে দিল,
কোথায় পেলাম, কবে কিনলাম ইত্যাদি। বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেও যার ছাতা, সে দেখে
ফেলবে। যদিও কিছুদিন পর জেনে গেছে। সে আমাকে দেখেছিল রুমে ঢুকতে। দেখেও
কিছু বলেনি। বাড়িতে বলেছে, ‘ভুল করে ফেলে এসেছি।’ তবুও ছাতা পড়ে রইলো
ট্র্যাঙ্কের অন্ধকারে। শুধু গভীর রাতে বের করে ঘরের মধ্যেই ছাতা মাথায় দিয়ে
পায়চারি করতাম।
মাধ্যমিক শেষ করে যখন ঢাকায় আসি, আমার পিতৃপ্রদত্ত
ট্রাঙ্কের সঙ্গে ছাতাটাও নিয়ে আসি। তখনো বর্ষা আসেনি। বর্ষার জন্য অপেক্ষা
করতাম। বর্ষা আসবে কবে? প্রতীক্ষার প্রহর যেন ফুরাতেই চায় না। এভাবেই কাটতে
লাগলো সময়। রোজ রাতে ট্রাঙ্ক খুলে দেখি প্রিয় ছাতা।
দেখতে দেখতে বর্ষা
এসে গেলো। প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে থাকলেও বর্ষার দিনে বের হলে ছাতা নিয়ে
বের হবো বলেই ঠিক করে রাখলাম। তখন বর্ষার প্রথম প্রহর চলছে। তেমন বৃষ্টির
আনাগোনা নেই। তবুও কাকার বাসায় যাবো বলে বের হলাম। যধষ্টি আসতে পারে
সন্দেহে ছাতা নিয়েই বের হয়েছি। পত্রিকা কিনে আবহাওয়ার সংবাদটাও দেখে নিলাম।
‘বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে’ লেখাটা দেখে মুচকি হাসলাম। আজই হবে আমার
ছাতার উদ্বোধন।
সুন্দর করে ভাঁজ করা ছাতাটা হাতে নিয়েই গাড়িতে উঠলাম।
ফাঁকা গাড়ি পেয়ে জানালার পাশের সিটে বসে আছি। পাশেই সিটের ওপর কাত করে রেখে
দিলাম সুন্দর করে। বাস থেকে নামলে কিছুদূর পথ হেঁটে যেতে হয়। ইস! তখন যদি
বৃষ্টি নামতো। আকাশে হালকা হালকা মেঘও দেখা যায়। বৃষ্টি আসতেও পারে।
আশ্বস্ত হলাম।
ভাবতে ভাবতে কখন যে গাড়ি চলে এলো- টের পেলাম না। হেলপারের
চিৎকারে ভাবনা টুটে গেলে দ্রুত ছুটলাম গেটের দিকে। তাড়াহুড়ো করে নেমে
গেলাম গাড়ি থেকে। কাকার বাসায় যাওয়ার আনন্দে ফুরফুরে মেজাজে হাঁটছি।
কিছুদূর যেতেই হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। সেকি, আমার হাত খালি! ছাতা কোথায়? মনে পড়ে,
সিটে বসার সময় বামপাশে কাত করে রেখেছিলাম। নামার সময় মনে নেই। গাড়িও চলে
গেছে বহুদূর। ভুল করেই ছাতাটা ফেলে এসেছি! এতদিনের অপেক্ষা আজ তবে বৃথা হয়ে
গেল?
মন খারাপের ক্ষণে দু’ফোটা জল এলো চোখে। আর আকাশের জল ভিজিয়ে দিলো
আমার সমস্ত শরীর। ভাগ্যিস, বৃষ্টির জলে আমার চোখের জল চাপা পড়ে গেল! ছাতাটা
হারিয়ে গেল ভুলের অতলে।